শহীদ ক্ষুদিরাম বসু ও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা

লেখক
গৌতমচন্দ্র চন্দ্র

শহীদ ক্ষুদিরাম বসু ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক কিংবদন্তী যুবক প্রতিভা৷ ক্ষুদিরাম বসুর আত্মবলিদান সমকালে জনমানসে প্রবল আলোড়ন তুলেছিল৷ দেশ প্রেম আর বাঙালী চারণ কবিরা তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে গান গেয়ে দেশ প্রেমের বার্তা গ্রামে ও গ্রামান্তরে ছড়িয়ে দিতেন৷ ফাঁসির পরবর্তী কালে পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে যথেষ্ট ভাবাবেগ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল যা এককথায় অকল্পনীয় ছিল৷Khudiram Bose

ক্ষুদিরাম বসু মেদিনীপুর জেলার হবিবপুর অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর৷ বাল্যকালেই পিতৃমাতৃহীন হয়ে বড় ভগ্ণী অপরূপা দেবীর কাছে সস্নেহে প্রতিপালিত হন৷ বালক ক্ষুদিরামের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রাম্য বিদ্যালয়ে সম্পন্ন হয়েছিল৷ ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দে তিনি তমলুকের বিখ্যাত হ্যামিলটন স্কুলে ভর্তি হন৷ পরে ১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন৷ প্রথাগত বিদ্যালাভে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল না বরং দামালপনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন৷ এই দামালপনা সত্ত্বেও তিনি অন্যায় ও অসাম্য নিজ প্রচেষ্টায় দূরীকরণের চেষ্টা করতেন৷ ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে বড়লাট লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ করবার বিরুদ্ধে যে ব্যাপক গণ আন্দোলন শুরু হয়েছিল বালক ক্ষুদিরামের মনে তার সুগভীর প্রভাব পড়ে৷ জনৈক সহপাঠিকে তিনি জানান যে তাঁর জীবন দেশমাতৃকার রাহুমুক্তির জন্যে বলিপ্রদত্ত৷ সেই সহপাঠি বালক ক্ষুদিরামকে বিপ্লবী নেতা সত্যেন বসুর কাছে নিয়ে যান৷ সত্যেন বসু পুলিসের কাছে সাক্ষ্যদানকারী নরেন গোঁসাইকে হত্যা করে ফাঁসী যান পরবর্তীকালে৷

বালক ক্ষুদিরামের সাহস ও বীরত্ব সত্যেন বসুকে আকৃষ্ট করেছিল৷ সত্যেন বসুর চেষ্টায় ক্ষুদিরাম বসু বিদ্যালয় ত্যাগ করে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন৷ গৃহত্যাগ করে ক্ষুদিরাম বসু বিপ্লবী নেতা সত্যেন বসুর ছোট হস্তচালিত  তাঁতের কারখানায় দিন কাটাতে থাকেন৷ এই ফ্যাক্টরী আসলে   দেশপ্রেমিক বিপ্লবীগণের আশ্রয়স্থল ছিল৷ এই ফ্যাক্টরীতে  থাকাকালীন মানসিক, শারীরিক ও দেশপ্রেমে দীক্ষা পেতেন ক্ষুদিরাম বসু ও অন্যান্যরা৷ রাজনৈতিক জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে ক্ষুদিরাম বসু শ্রীশ্রীগীতা  পড়েন৷ ম্যাৎসিনি ও গ্যারিবল্ডির সংগ্রামের কথা পড়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হন৷ ফরাসী বিপ্লবের কাহিনী বাঙলার দামাল ছেলে ক্ষুদিরামকে আত্মত্যাগে উৎসাহিত করে৷ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে বিদেশী দ্রব্য বয়কটের ডাক দেওয়া হয়৷ ব্রিটেনে তৈরী বস্ত্রাদির দাহকার্যে ক্ষুদিরাম বসু যথেষ্ট আনন্দ অনুভব করতেন৷

সত্যেন বসুকে ক্ষুদিরাম ছাত্রভাণ্ডার গঠনে সাহায্য করেন৷ এই ছাত্রভাণ্ডার স্বদেশী দ্রব্যাদি বিক্রয় করত৷ এই সংস্থা স্থানীয় ভাবে জনকল্যাণে ব্যাপক কর্ম করত৷ ক্ষুদিরাম বসু বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সেবায় অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন৷

১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে মেদিনীপুরে স্বদেশী কৃষিজ ও শিল্পপণ্যের প্রদর্শনী হয়, ক্ষুুদিরাম বসু রাষ্ট্রদ্রোহমূলক লিফলেট ‘সোনার বাংলা’ বিতরণের কালে পুলিশের ঘেরাটোপে পড়েন৷ বাংলার দামাল ছেলে ক্ষুদিরাম বসু পুলিসকে ঘুঁষি মেরে রক্তাক্ত করে পলায়ন করেন৷ পরে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করলে সত্যেন বসুর হস্তক্ষেপে ক্ষুদিরামকে মিথ্যা আবেদনে মুক্ত করান৷ এই কর্ম করতে গিয়ে সত্যেন বসুর কালেক্টর অফিসের চাকরীটি যায়৷ এই ঘটনাকে বিপ্লবী সত্যেন বসু আমলই দিলেন না৷ ক্ষুদিরাম বসু নাবালক বলে মহামান্য আদালত তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়৷ ১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দে বিপ্লবী নেতা সত্যেন বসু মেদিনীপুরে নরমপন্থী মতাবলম্বীগণের বিরুদ্ধে গিয়ে সশস্ত্র আন্দোলন সংঘটিত করেন৷ ক্ষুদিরাম বসু এই সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন৷

১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দে সাগ্ণিক বিপ্লবী নেতা বারীন্দ্র কুমার ঘোষ অত্যাচারী ম্যাজিষ্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্যে বিহারের মজঃফরপুরে প্রফুল্ল চাকীকে পাঠাতে মনস্থ করেন৷ যুগান্তর গোষ্ঠীর এই বিপ্লবী নেতা কিংসফোর্ডের অত্যাচারের জন্যে এই পরিণতি স্থির করেন৷ সেই সময়ে অন্য বরেণ্য বিপ্লবী নেতা হেমচন্দ্র দাস কানুনগোর চেষ্টায় ক্ষুদিরাম বসুকেও কিংসফোর্ডকে হত্যার জন্যে প্রফুল্ল চাকীর সহগামী করা হয়৷ মজঃফরপুরে পৌঁছে এই দুই বিপ্লবী যুবক বোমা হাতে ম্যাজিষ্ট্রেট কিংসফোর্টের গতিবিধি গাছের আড়াল থেকে পর্যবেক্ষণ করেন৷ ইউরোপীয়ান ক্লাব গেটের অদুরে বৃক্ষাদির আড়াল থেকে এই পর্যবেক্ষণ কাণ্ড চলে৷ ঠিক হয় এই গেট দিয়ে ম্যাজিষ্ট্রেট কিংসফোর্ডের গাড়ি বেরোলে গাড়িটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হবে৷ অবশেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল৷ কিংসফোর্ডের গাড়ির অনুরূপ একটি গাড়ি বেরোল গেট দিয়ে৷ এই গাড়িটিতে কিন্তু ম্যাজিষ্ট্রেট কিংসফোর্ড ছিলেন না৷ ছিলেন গাড়ির দুই আরোহী মাতা ও কন্যা৷ বিপ্লবীরা এই খবর সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন৷ তাই প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসুর ছোঁড়া বোমাতে ওই দুই ইংরেজ  মাতা ও কন্যা নিহত হন, ম্যাজিষ্ট্রেট কিংসফোর্ড অক্ষত থাকেন৷ ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দের ৩০শে এপ্রিল এই ঘটনা ঘটে৷

এই দুই ইংরেজ রমনী হত্যার পরে পুলিশের চিরুনী তল্লাশীতে ক্ষুদিরাম বসু পরদিন প্রভাতে ওয়াইনী রেলষ্টেশনে গ্রেপ্তার হন৷ পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তির সময় দুর্ভাগ্য বশত ক্ষুদিরামের রিভলবারটি মাটিতে পড়ে যায়, ফলে আত্মহত্যা করা ক্ষুদিরামের পক্ষে সম্ভবপর হয়নি৷

যুগান্তর গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের অসাফল্যে আত্মহত্যা করবার ঘোষিত নির্দেশ ছিল৷ এই পদক্ষেপ ছিল অসম সাহসিকতার পরিচয়৷ যা যুবক ক্ষুদিরাম দেখাতে পারেননি তাঁর রিভলবারটি মাটিতে পড়ে যাওয়ার কারণে৷ এই বৈপ্লবিক কাণ্ডের অন্য সহযোগী প্রফুল্ল চাকী অবশ্য গ্রেপ্তার এড়িয়ে মাথায় রিভলবার চালিয়ে আত্মহত্যা করতে সক্ষম হয়েছিলেন৷ ক্ষুদিরাম বসু দুই ইংরেজ নারীর হত্যার দায় আদালতে স্বীকার করে আদালতে বলেন, ‘‘ম্যাজিষ্ট্রেট কিংসফোর্ড বেঁচে গেল’’৷ ক্ষুদিরাম বসু শত জেরার মুখে পড়েও অন্য সহকর্মীর নাম বলেন নি৷ ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসীর আদেশ হলে অ্যাপীল না করে ক্ষুদিরাম হাসিমুখে শহীদ হবার সঙ্কল্প নেন৷ ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দের ১১ই আগষ্ট ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রবাদপ্রতিম ক্ষুদিরাম শহীদ হলেন৷

শোনা যায় ক্ষুদিরামের ফাঁসীর পরে শহীদ দিবস পালন সরকারী নিষেধ সত্ত্বেও বালক সুভাষচন্দ্র বসু ও তাঁর কটকের র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্রগণ ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দের ১১ই আগষ্ট শহীদ দিবস পালন করেন৷ বস্তুত পক্ষে শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর যে রকম দেশপ্রেম দুর্জয় সাহস ও বিপ্লবী মানসিকতা ছিল তা আজ স্বাধীনতার ৬৫ বছর পরে ভারতবর্ষের বুকে বিরল৷ এখন বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাসবাদের কারণে লোকে নিহত হয় অহরহ কিন্তু সেইসব হতভাগ্য মানুষের দেশপ্রেম থাকে না৷ এখন প্রায়ই দেখা যায় ভারতবাসীর দেশপ্রেম শুধুমাত্র ক্রিকেট খেলায় জেতার সময় দর্শনযোগ্য থাকে৷ আজকাল মানুষের মনে দেশপ্রেমের স্থান দখল করে নিয়েছে তাদের পেশাজীবি মানসিকতা৷ ভারতবর্ষের এইসব বরেণ্য শহীদ গণের আত্মবলিদানের ঘটনা তারা জানতে চায় না৷ এটা স্বাধীন ভারতবর্ষের লজ্জা৷ বস্তুতপক্ষে এখন দেখা যায় দেশপ্রেম এখন বহু ভারতবাসীর মন থেকে বুদবুদের মতো উবে গেছে৷ পরাধীন ভারতবর্ষের এই বীর শহীদবৃন্দের নবমূল্যায়ন দরকার, তবেই ভারতবর্ষ জগৎসভায় নিজের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবে৷ প্রকৃতপক্ষে আত্মবিস্মৃত জাতি দেশপ্রেমবঞ্চিত হয়ে জড় বস্তুতে পরিণত হয়৷ এই অবস্থা কাটাতে পারলে দেশবাসী স্বমহিমায় উজ্জ্বল হবে৷ শহীদবৃন্দের আত্মবলিদান কখনো বৃথা যায় না৷