শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার দরকার

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

এ বছর মাধ্যমিক  পরীক্ষা দিচ্ছে ১১ লক্ষাধিক  ছাত্র-ছাত্রা৷ নিঃসন্দেহে  এদের বৃহদংশ মাধ্যমিকের গন্ডী ছেড়ে, মাধ্যমিক পাশ করে  বেরিয়ে আসবে ৷  এদের একটা বড় অংশ উচ্চমাধ্যমিক বা অন্য কোনো  শিক্ষাক্ষেত্রে প্রবেশ করবে৷ এমনিভাবে উচ্চমাধ্যমিকেও লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রা পাশ করে  বেরুবে৷ এমনি করে  কলেজ  বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে  লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রা পাশ করে বেরুবে৷ এইভাবে প্রতিবছরই  লক্ষ লক্ষ  ছাত্রছাত্রা কৈশোরের আনন্দময়  জীবনের  গন্ডী ছাড়িয়ে সংসারের রণক্ষেত্রে প্রবেশ করছে৷ দুরুহ জীবন সংগ্রামে তাদের  নামতে হচ্ছে৷ এদের  ভবিষ্যৎ কী? 

ছাত্রজীবন নিজেদের  জীবন গড়বার জন্যে৷ বলা চলে, শিক্ষার  প্রধানতঃ দুটি অঙ্গ৷ এক,নৈতিক দিক থেকে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া৷ মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর  ক্ষেত্রে হয় কী? জন্মেই  তারা ওই প্রাণীর  স্বভাব প্রাপ্ত হয়৷ বলা হয় জন্মেই একটা বানর বানরের স্বভাব পেয়ে যায়৷ একটা পশু শাবক পশুর স্বভাব প্রাপ্ত হয়৷ কিন্তু একটা মানুষের শিশু জন্মেই প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে না৷  সুশিক্ষার  দ্বারাই   সে মানুষ  হয়ে ওঠে--- মনুষ্যত্বের অধিকারী হয়৷ উপযুক্ত সুশিক্ষা না পেলে  তার মনুষ্যত্ব বিকশিত  হয় না৷  তার আচরন মনুষ্যত্বের  প্রকাশ ঘটে না৷ এই কারণেই সমাজে  নৈতিক মান এত নিম্নস্তরের৷ নৈতিক মান উন্নত না হলে সমাজের  সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি স্বাভাবিক৷ সমাজের  সব ক্ষেত্রে  সুষ্ঠু বিকাশ, সুষ্ঠু উন্নয়ন দুর্র্দন্তভাবে ব্যাহত হয় সৎ নীতিবাদী সমাজসচেতন মানুষের অভাবে৷ আর এই অভাবের কারণেই সমাজের সর্বক্ষেত্রে দেখা দেয় অবক্ষয়, দেখা দেয় বিপর্যয়, দেখা দেয়  সমস্যার  পাহাড় দেশের উন্নয়নের  পথকে  রুদ্ধ করে দিয়েছে৷

এ একটা দিক৷ আর একটা দিক হ’ল  অর্থনৈতিক  ক্ষেত্রে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর যোগ্য হওয়া৷ যতদিন  সুকল কলেজে পড়াশুনা করত  ততদিন তাদের বেশির  ভাগ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক  দিকটা ভাবতে হয় না৷  অভিভাবকরাই অর্থনৈতিক দিকটার কথা  ভাবেন ৷ ছাত্র-ছাত্রারা এ ব্যাপারে  নিশ্চিন্ত৷ কিন্তু যেই  বিদ্যার্জনের  গন্ডী পেরিয়ে সংসারে  প্রবেশ  করলো অমনি  কঠোর  বাস্তবের সম্মুখীন হতে হ’ল৷  চাকুরী না হলে  বা  উপযুক্ত কর্মসংস্থান  না হলে, রোজগারের ব্যবস্থা না হলে  জীবনে  অন্ধকার  নেমে আসে৷

মেয়েদের  দিকটা  চিন্তা করলে , মেয়েরা  যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হওয়ার  যোগ্যতা অর্জন না করে  তাহলে সে প্রচন্ড জীবন-যন্ত্রণার  শিকার  হতে পারে৷ মেয়েরা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করতে  পারলে  পণপ্রথা, শ্বশুর বাড়ীর  নির্র্যতন তাদের  জীবনকে  ততটা  দুর্বিসহ  করতে পারে না৷  নারীরা অর্থনৈতিকভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াবার  যোগ্যতা অর্জন করতে না পারলে  তাদের  অতিরিক্তভাবে পুরুষ নির্ভর হতে হয়৷ বহুক্ষেত্রেই সেটাই  তার জীবনকে বিপন্ন করে তোলে ৷ তাই  সমাজে  নির্র্যতনের  অবসানের  জন্যে  নারীকে  অর্থনৈতিকভাবে  স্বয়ম্ভর  হওয়াটা অত্যন্ত  আবশ্যক৷

কথাটা হ’ল এইযে  ছাত্র-ছাত্রাদের জীবনের  প্রধান দুটো দিকের কথা বলা হ’ল---নৈতিক শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ম্ভর হওয়ার শিক্ষা৷ এই দুটো শিক্ষা ছাত্র-ছাত্রাদের জীবন গঠনের  সবচেয়ে  বড় কথা৷ কিন্তু  বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় এই দুই শিক্ষা ঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে কি? তা না হলে শিক্ষাটা  তো অর্থহীন  হয়ে  গেল, একেবারে অপূর্ণ হয়ে গেল৷

হ্যাঁ, বাস্তবে তো এটাই হচ্ছে৷ আজ সুকল কলেজে  এই দুটি শিক্ষার ক্ষেত্রেই বিরাট ঘাটতি থেকে যাচ্ছে৷ শিক্ষা ব্যবস্থা বা শিক্ষা-বিস্তার নিয়ে সরকারের এত কমিশন, এত সব পরিকল্পনা, এত  সব রাজসূয় যজ্ঞ সবই তো ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে৷  ছেলেমেয়েরা ছাত্রজীবনে প্রকৃত শিক্ষা কতটুকু লাভ করছে?

বর্তমানে নৈতিক শিক্ষার দিকে সরকারের কোনো নজরই নেই বললে চলে৷ পক্ষান্তরে-সুকল-কলেজগুলি হয়ে উঠছে, বিভিন্ন  রাজনৈতিক দলের  ক্যাডার তৈরীর আখড়া৷  সুকল বা বিশেষ করে কলেজগুলিতে  ছাত্র সংসদ গড়ার নামে  দলীয়  রাজনীতির যেভাবে অনুপ্রবেশ ঘটেছে তা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাটাকে চরমভাবে কলুষিত করেছে৷  আজ বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রা কলেজে পড়াশুণার চেয়ে দলীয় রাজনীতির কর্মসূচী নিয়ে ব্যস্ত থাকে৷ শুধু তাই নয়, দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থকে  অত্যন্ত বেশী গুরুত্ব দিতে থাকে৷ দলীয় রাজনীতিটাই বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রাদের ক্ষেত্রেই একটা মারাত্মক নেশায় পরিণত হয়৷ আর এই নেশাগ্রস্ত হয়ে ছাত্র-ছাত্ররা পরস্পর মারামারি করে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও অনেক সময় চরমভাবে সম্মানহানি ঘটায়৷ ফলে ছাত্র-শিক্ষকের পবিত্র সম্পর্কটাই  উধাও হয়ে যায়৷ এটাই তো বর্ত্তমানে হচ্ছে৷

শিক্ষা  ক্ষেত্রগুলিকে  দলীয় রাজনীতির  বিষবাষ্প থেকে রক্ষা করার জন্যে  সবচেয়ে যেটা বড় প্রয়োজন  তা হ’ল, শিক্ষার নীতি-নির্র্ধরণ, সিলেবাস তৈরী, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি  যাবতীয় শিক্ষা সংক্রান্ত ব্যাপারগুলি সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে পুরোপুরি মুক্ত করে যথার্থ শিক্ষাবিদ্দের নিয়ে তৈরী বোর্ডের হাতেই  তুলে দেওয়া উচিত৷ সরকারের দায়িত্ব শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেওয়ামাত্র৷  অনেক রাজনৈতিক নেতাকে  বলতে শোণা যায়, আমরা  টাকা দেব অথচ  আমাদের হাতে অধিকার  থাকবে না---এ কেমন করে  হয় ? এর উত্তরে  বলব, মন্ত্রীরা  তো আর নিজেদের বাড়ী থেকে টাকা দেয় না৷ জনগণের  প্রদত্ত কর জনসেবায় ব্যবহার করাই সরকারের দায়িত্ব৷  জনসেবার নামে রাজনৈতিক দলবাজি করা সরকারের লক্ষ্য নয়৷ যা বলা হচ্ছিল, নৈতিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষাক্ষেত্রগুলিতে চরম ঘাটতি যেমন খুবই দুঃখ জনক  ব্যাপার , অন্যদিকে অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বনির্ভরতা অর্জন করানোর ক্ষেত্রেও শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে প্রচন্ড  ঘাটতি রয়েছে৷

পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সরকার আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার  প্রবর্তন  করেছিল মূলতঃ কেরানী তৈরীর  লক্ষ্যে৷ এদেশে ব্রিটিশ শাসন  চালাতে গেলে যে  বিশাল কেরানীকুল  প্রয়োজন সেই কেরানী সম্প্রদায় তৈরীটাই ছিল ব্রিটিশদের  প্রধান উদ্দেশ্য৷ স্বাধীনতার  পরও আমরা সেই ব্রিটিশ প্রবর্তিত নীতিই অনুসরণ করে চলেছি৷

অন্যদিকে সুকল-কলেজগুলিতে পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গে বৈবহারিক ক্ষেত্রে অর্থাৎ হাতে নাতে বিভিন্ন পেশাগত, শিক্ষা, কুটিরশিল্প ক্ষুদ্রশিল্প সংক্রান্ত শিক্ষা থাকাটা খুবই জরুরী৷

এটা করা হ’লে শিক্ষান্তে  কেউ বেকার  বসে থাকবে না৷ মেয়েরাও স্বনির্ভর  হয়ে উঠতে  পারবে৷  তাই  সরকারের নীতি  হওয়া উচিত, শিক্ষান্তে সার্টিফিকেটের সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থানেরও গ্যারান্টি দেওয়া৷

এই সমস্ত দিকে দৃষ্টি দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে  পুরোপুরি ঢেলে সাজানো উচিত৷