এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে ১১ লক্ষাধিক ছাত্র-ছাত্রা৷ নিঃসন্দেহে এদের বৃহদংশ মাধ্যমিকের গন্ডী ছেড়ে, মাধ্যমিক পাশ করে বেরিয়ে আসবে ৷ এদের একটা বড় অংশ উচ্চমাধ্যমিক বা অন্য কোনো শিক্ষাক্ষেত্রে প্রবেশ করবে৷ এমনিভাবে উচ্চমাধ্যমিকেও লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রা পাশ করে বেরুবে৷ এমনি করে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রা পাশ করে বেরুবে৷ এইভাবে প্রতিবছরই লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রা কৈশোরের আনন্দময় জীবনের গন্ডী ছাড়িয়ে সংসারের রণক্ষেত্রে প্রবেশ করছে৷ দুরুহ জীবন সংগ্রামে তাদের নামতে হচ্ছে৷ এদের ভবিষ্যৎ কী?
ছাত্রজীবন নিজেদের জীবন গড়বার জন্যে৷ বলা চলে, শিক্ষার প্রধানতঃ দুটি অঙ্গ৷ এক,নৈতিক দিক থেকে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া৷ মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর ক্ষেত্রে হয় কী? জন্মেই তারা ওই প্রাণীর স্বভাব প্রাপ্ত হয়৷ বলা হয় জন্মেই একটা বানর বানরের স্বভাব পেয়ে যায়৷ একটা পশু শাবক পশুর স্বভাব প্রাপ্ত হয়৷ কিন্তু একটা মানুষের শিশু জন্মেই প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে না৷ সুশিক্ষার দ্বারাই সে মানুষ হয়ে ওঠে--- মনুষ্যত্বের অধিকারী হয়৷ উপযুক্ত সুশিক্ষা না পেলে তার মনুষ্যত্ব বিকশিত হয় না৷ তার আচরন মনুষ্যত্বের প্রকাশ ঘটে না৷ এই কারণেই সমাজে নৈতিক মান এত নিম্নস্তরের৷ নৈতিক মান উন্নত না হলে সমাজের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি স্বাভাবিক৷ সমাজের সব ক্ষেত্রে সুষ্ঠু বিকাশ, সুষ্ঠু উন্নয়ন দুর্র্দন্তভাবে ব্যাহত হয় সৎ নীতিবাদী সমাজসচেতন মানুষের অভাবে৷ আর এই অভাবের কারণেই সমাজের সর্বক্ষেত্রে দেখা দেয় অবক্ষয়, দেখা দেয় বিপর্যয়, দেখা দেয় সমস্যার পাহাড় দেশের উন্নয়নের পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে৷
এ একটা দিক৷ আর একটা দিক হ’ল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর যোগ্য হওয়া৷ যতদিন সুকল কলেজে পড়াশুনা করত ততদিন তাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিকটা ভাবতে হয় না৷ অভিভাবকরাই অর্থনৈতিক দিকটার কথা ভাবেন ৷ ছাত্র-ছাত্রারা এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত৷ কিন্তু যেই বিদ্যার্জনের গন্ডী পেরিয়ে সংসারে প্রবেশ করলো অমনি কঠোর বাস্তবের সম্মুখীন হতে হ’ল৷ চাকুরী না হলে বা উপযুক্ত কর্মসংস্থান না হলে, রোজগারের ব্যবস্থা না হলে জীবনে অন্ধকার নেমে আসে৷
মেয়েদের দিকটা চিন্তা করলে , মেয়েরা যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হওয়ার যোগ্যতা অর্জন না করে তাহলে সে প্রচন্ড জীবন-যন্ত্রণার শিকার হতে পারে৷ মেয়েরা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারলে পণপ্রথা, শ্বশুর বাড়ীর নির্র্যতন তাদের জীবনকে ততটা দুর্বিসহ করতে পারে না৷ নারীরা অর্থনৈতিকভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াবার যোগ্যতা অর্জন করতে না পারলে তাদের অতিরিক্তভাবে পুরুষ নির্ভর হতে হয়৷ বহুক্ষেত্রেই সেটাই তার জীবনকে বিপন্ন করে তোলে ৷ তাই সমাজে নির্র্যতনের অবসানের জন্যে নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ম্ভর হওয়াটা অত্যন্ত আবশ্যক৷
কথাটা হ’ল এইযে ছাত্র-ছাত্রাদের জীবনের প্রধান দুটো দিকের কথা বলা হ’ল---নৈতিক শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ম্ভর হওয়ার শিক্ষা৷ এই দুটো শিক্ষা ছাত্র-ছাত্রাদের জীবন গঠনের সবচেয়ে বড় কথা৷ কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় এই দুই শিক্ষা ঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে কি? তা না হলে শিক্ষাটা তো অর্থহীন হয়ে গেল, একেবারে অপূর্ণ হয়ে গেল৷
হ্যাঁ, বাস্তবে তো এটাই হচ্ছে৷ আজ সুকল কলেজে এই দুটি শিক্ষার ক্ষেত্রেই বিরাট ঘাটতি থেকে যাচ্ছে৷ শিক্ষা ব্যবস্থা বা শিক্ষা-বিস্তার নিয়ে সরকারের এত কমিশন, এত সব পরিকল্পনা, এত সব রাজসূয় যজ্ঞ সবই তো ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে৷ ছেলেমেয়েরা ছাত্রজীবনে প্রকৃত শিক্ষা কতটুকু লাভ করছে?
বর্তমানে নৈতিক শিক্ষার দিকে সরকারের কোনো নজরই নেই বললে চলে৷ পক্ষান্তরে-সুকল-কলেজগুলি হয়ে উঠছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্যাডার তৈরীর আখড়া৷ সুকল বা বিশেষ করে কলেজগুলিতে ছাত্র সংসদ গড়ার নামে দলীয় রাজনীতির যেভাবে অনুপ্রবেশ ঘটেছে তা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাটাকে চরমভাবে কলুষিত করেছে৷ আজ বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রা কলেজে পড়াশুণার চেয়ে দলীয় রাজনীতির কর্মসূচী নিয়ে ব্যস্ত থাকে৷ শুধু তাই নয়, দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থকে অত্যন্ত বেশী গুরুত্ব দিতে থাকে৷ দলীয় রাজনীতিটাই বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রাদের ক্ষেত্রেই একটা মারাত্মক নেশায় পরিণত হয়৷ আর এই নেশাগ্রস্ত হয়ে ছাত্র-ছাত্ররা পরস্পর মারামারি করে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও অনেক সময় চরমভাবে সম্মানহানি ঘটায়৷ ফলে ছাত্র-শিক্ষকের পবিত্র সম্পর্কটাই উধাও হয়ে যায়৷ এটাই তো বর্ত্তমানে হচ্ছে৷
শিক্ষা ক্ষেত্রগুলিকে দলীয় রাজনীতির বিষবাষ্প থেকে রক্ষা করার জন্যে সবচেয়ে যেটা বড় প্রয়োজন তা হ’ল, শিক্ষার নীতি-নির্র্ধরণ, সিলেবাস তৈরী, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি যাবতীয় শিক্ষা সংক্রান্ত ব্যাপারগুলি সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে পুরোপুরি মুক্ত করে যথার্থ শিক্ষাবিদ্দের নিয়ে তৈরী বোর্ডের হাতেই তুলে দেওয়া উচিত৷ সরকারের দায়িত্ব শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেওয়ামাত্র৷ অনেক রাজনৈতিক নেতাকে বলতে শোণা যায়, আমরা টাকা দেব অথচ আমাদের হাতে অধিকার থাকবে না---এ কেমন করে হয় ? এর উত্তরে বলব, মন্ত্রীরা তো আর নিজেদের বাড়ী থেকে টাকা দেয় না৷ জনগণের প্রদত্ত কর জনসেবায় ব্যবহার করাই সরকারের দায়িত্ব৷ জনসেবার নামে রাজনৈতিক দলবাজি করা সরকারের লক্ষ্য নয়৷ যা বলা হচ্ছিল, নৈতিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষাক্ষেত্রগুলিতে চরম ঘাটতি যেমন খুবই দুঃখ জনক ব্যাপার , অন্যদিকে অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বনির্ভরতা অর্জন করানোর ক্ষেত্রেও শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে প্রচন্ড ঘাটতি রয়েছে৷
পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সরকার আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল মূলতঃ কেরানী তৈরীর লক্ষ্যে৷ এদেশে ব্রিটিশ শাসন চালাতে গেলে যে বিশাল কেরানীকুল প্রয়োজন সেই কেরানী সম্প্রদায় তৈরীটাই ছিল ব্রিটিশদের প্রধান উদ্দেশ্য৷ স্বাধীনতার পরও আমরা সেই ব্রিটিশ প্রবর্তিত নীতিই অনুসরণ করে চলেছি৷
অন্যদিকে সুকল-কলেজগুলিতে পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গে বৈবহারিক ক্ষেত্রে অর্থাৎ হাতে নাতে বিভিন্ন পেশাগত, শিক্ষা, কুটিরশিল্প ক্ষুদ্রশিল্প সংক্রান্ত শিক্ষা থাকাটা খুবই জরুরী৷
এটা করা হ’লে শিক্ষান্তে কেউ বেকার বসে থাকবে না৷ মেয়েরাও স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারবে৷ তাই সরকারের নীতি হওয়া উচিত, শিক্ষান্তে সার্টিফিকেটের সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থানেরও গ্যারান্টি দেওয়া৷
এই সমস্ত দিকে দৃষ্টি দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ঢেলে সাজানো উচিত৷
- Log in to post comments