শিশুর শ্রেষ্ঠ খাবার মায়ের দুধ

লেখক
ডাঃ আলমগির

বিভিন্ন গবেষণা থেকে এটি প্রমাণিত যে, মায়ের দুধই নবজাতক শিশুর পক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ পুষ্টিকর খাবার৷ মাতৃদুগ্ধ পান করলে শিশুর সংক্রামক রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায়৷ মা’র পুনঃগর্ভধারনের দূরত্ব বেড়ে যায়৷ মায়ের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে৷ এইসব সুফল পেতে হলে বাধাহীনভাবে নবজাতক শিশুকে প্রথম ছয় মাস নিরবচ্ছিন্নভাবে শুধুই মায়ের দুধ পান করাতে হবে৷ এই সময় শিশুকে অন্য কোন খাবার এমনকি জলও পান করানো ঠিক নয়৷ এই প্রক্রিয়া চললে মা ও শিশু দুজনেই উপকৃত হবে, সাথে সাথে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে জাতি উপকৃত হবে৷ সেই কারণে বিভিন্ন মাতৃসেবা সংস্থাগুলি জানাচ্ছে শিশুকে মায়ের দুধ দেওয়া একপ্রকার আবশ্যিক৷

এখন প্রশ্ণ কেন শিশুকে প্রথম ছ’মাস মায়ের দুধই একমাত্র জরুরী খাদ্য তথা পানীয় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে৷ এর উত্তর হচ্ছে মায়ের দুধে এমন সব উপাদান এমন এমন পরিমাণে আছে যা শিশুর শরীরের পক্ষে জরুরী৷ আর একটা বিষয় হচ্ছে অন্য কোন খাদ্যে ওই সব উপাদান সঠিক পরিমাণে নেই যা শিশুর শরীর তথা স্বাস্থ্যের পক্ষে কার্যকরী৷ অনেকে প্রশ্ণ করেন গোরুর দুধ কি শিশুর খাদ্য হতে পারে? সরাসরি ভাবে এর উত্তর হচ্ছে–না৷ গোরুর দুধ ও মায়ের দুধে কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে৷ যেমন শর্করার ক্ষেত্রে৷ মায়ের দুধে শর্করার পরিমাণ প্রতি ১০০ মিলি.তে আছে ৭.৪ মিলি., যেখানে গোরুর দুধে আছে ৪ বা ৬ মিলি. প্রতি ১০০ মিলিতে৷ স্নেহ পদার্থের পরিমাণ গোরুর দুধে এমনভাবে সম্পৃক্ত যা শিশুর পক্ষে সহজপাচ্য নয়৷ কিন্তু একই পরিমাণ স্নেহ পদার্থ মায়ের দুধে থাকলেও তা সহজপাচ্য শিশুর পক্ষে৷ গোরুর দুধে আমিষ খাদ্য বেশী৷ শিশুর মস্তিষ্কের বৃদ্ধির জন্যে প্রয়োজনীয় টনিন মায়ের দুধে আছে৷ গোরুর দুধের চেয়ে মায়ের দুধ শিশুর শরীরে তরলের আনবিক চাপ বজায় রাখার ক্ষেত্রে বেশী উপযোগী৷ তাছাড়া প্রয়োজনীয় ভিটামিন যা মাতৃদুগ্ধে বর্তমান তা গোরুর দুধে নেই৷ সবদিক বিবেচনা করলে দেখা যাবে গোরুর দুধ বা অন্য কোন খাবার শিশুর ক্ষেত্রে মায়ের দুধের বিকল্প হতে পারে না৷

ইমিউন গ্লোবিউলিন ও অন্যান্য সংক্রমণ প্রতিরোধী পদার্থ মায়ের দুধে বর্তমান৷ এই দুধে আছে ল্যাকটোব্যাসিলাস যা বাইফি ডাস নামক একপ্রকার জীবাণু জন্মানোর সহায়ক৷ এই জীবাণু ক্ষতিকর জীবাণুকে বাড়তে দেয় না৷ মায়ের দুধে যে আমিষ থাকে তাতে বাচ্চার অ্যালার্জি হয় না৷ ফলে বাচ্চা অ্যালার্জিজনিত সমস্যা থেকে মুক্ত থাকে৷ এছাড়াও মায়ের দুধে কিছু কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য পরীক্ষায় প্রমাণিত৷

* শিশুর আকস্মিক মৃত্যুর আশঙ্কা কমে যাওয়া

* শিশুর ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ও কর্ণপ্রদাহ কম হওয়া

* টিকার দ্রুত কার্যকারিতা

* দুধের বোতলজনিত দাঁতের সমস্যা থেকে মুক্তি

* মানসিক, আবেগিক ও সামাজিক সমস্যা থেকে মুক্তি

* উচ্চমাত্রায় বুদ্ধিমত্তা৷

মা যদি তার বাচ্চাকে মায়ের দুধ দেয় মায়েরও বিশেষ বিশেষ উপকার সাধিত হয় যেমন–

* মাতৃদুগ্ধ নির্গত হলে পিটুইটারী গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত অক্সিটসিন৷ জরায়ুর রক্তক্ষরণ বন্ধ করে ও সংকুচিত করে৷

* বারে বারে মায়ের দুধ দিলে পরবর্তী গর্ভধারণ বিলম্বিত হয়৷

* গর্ভ–পরবর্তী বিষণ্ণতা কমে যায়৷

* বাচ্চার প্রতি আবেগ সৃষ্টি হয় যা শিশু নির্যাতন রোধ করে৷

* আর্থিক বা অন্য কারণে বাচ্চার খাবার বঞ্চিত হবার আশঙ্কা কমে যায়৷

* খোলা বাজারের কৌটোর দুধ প্রচুর খরচ সাপেক্ষ৷ মায়ের দুধ দিলে বাচ্চার কৌটোর দুধের খরচ বেঁচে যায়৷

নবজাতক শিশুকে ১ ঘণ্ঢার মধ্যেই দুধ পান করানো জরুরী৷ শিশুর কান্না, নড়াচড়া, দুধ পান করা সবই শিশুর শারীরিক অবস্থার জানান দেয়৷ দুধ দেওয়ার সময় মাকে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে শিশুর শরীর এক হাতে ও শিশুর  মাথা এক হাতে রাখলে ভাল ভাবে দুধ পান করানো যায়৷ বাচ্চার শরীর মায়ের শরীরের সঙ্গে মিশে থাকা অবস্থায় দুধ দিলে খুব ভালো হয়৷ অনেক মা–ই বলেন তার বাচ্চা ঠিকমত পর্যাপ্ত দুধ খাচ্ছে না৷ আসলে দুধ দেওয়ার ক্ষেত্রে মায়ের কতকগুলি বিষয়ের নজর রাখতে হবে৷

* ২৪ ঘণ্ঢায় অন্ততঃ আটবার বাচ্চা দুধ খাবে৷

* দুধ খাওয়ার গতি কখনো কমবে, কখনো বাড়বে৷

* পেশী দৃঢ় থাকবে ও ত্বক থাকবে স্বাভাবিক৷

* ২৪ ঘণ্ঢায় ছয় থেকে আটবার প্রস্রাব হবে৷

* ওজন বৃদ্ধি হবে৷

যে সকল মায়েরা সন্তান জন্মাবার পর অন্য কাজকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য তাঁরা শিশুর জন্যে স্তনদুগ্ধ রেখে যেতে পারেন৷ এ বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে৷.