সম্প্রতি খবরে প্রকাশ বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে৷ ২০০১ সালে যেখানে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৮০৪.৪ মিলিয়ন, ২০১৭ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৮২১ মিলিয়ন৷ অর্থাৎ ৮১ কোটি ১০ লক্ষ৷ রাষ্ট্রসংঘের বিভিন্ন শাখার সমীক্ষা অনুসারে এই চিত্র পাওয়া গেছে৷
ভারতবর্ষেও ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা গত ৫ বছরে ১১ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ১৯ কোটি অথচ এদেশে ২০১৭ সালের হিসেবে ১০০ কোটি ডলার ছাপিয়ে যাওয়া ধনী মানুষ রয়েছে ১০১ জন৷ এ হ’ল বিশ্ব বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনের খবর৷
অর্থাৎ একদিকে বিপুল সম্পদ সঞ্চিত হচ্ছে কারও কারও জিম্মায়, অন্যদিকে অনাহারে অভাবে কুঁকড়ে কঁুকরে মরছে কোটি কোটি মানুষ৷
অথচ, এ বিশ্বের সমস্ত সম্পদে সকলের সমান অধিকার৷ প্রকৃতি মা কারুর নামে কোনও সম্পদ বা কোনো জমি রেজিষ্ট্রি করে দেননি৷ লোভী স্বার্থপর মানুষেরাই অন্যদের বঞ্চিত করে বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিজেদের কুক্ষীগত করেছে৷ বিশ্বের সম্পদ তো সীমিত৷ এক জায়গায় প্রয়োজনাতিরিক্ত বিপুল পরিমাণ সম্পদ সঞ্চয় হওয়া মানেই অন্যত্র অভাব দেখা দেবেই৷ প্রকৃতিতে এমন সম্পদ রয়েছে তা সবার ভালভাবে খেয়ে পরে বাঁচবার মত৷ কিন্তু সেই মানবোচিত পারস্পরিক সহযোগিতা সহমর্মিতা কোথায়? আমরা মানবতার গান গাই, কবিতা আবৃত্তি করি ও বত্তৃণতার তুবড়ি ফাটিয়ে চলি ৷ কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আমরা তো চরম আত্মকেন্দ্রিক৷ তাই তো এই আত্মসুখতত্ত্ব ভিত্তিক --- আত্মকেন্দ্রিকতা ভিত্তিক পুঁজিবাদী সামাজিক কাঠামোকেই আমরা সমস্ত শক্তি-মন-প্রাণ-দিয়ে পুষ্ট করে চলেছি৷ এর বাইরে আমরা কোনো কিছু চিন্তা করতে পারছি না৷
তাই সমাজের জনসাধারণের মনে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাবের ভাবনা মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে৷ এই সেদিনকার একটা চরম দুঃখবহ ঘটনা নিশ্চয়ই অনেকের মনকে বিচলিত করেছে৷ চরম অর্থনৈতিক অভাবের কারণে ব্যারাকপুরের শ্যামল দাস (৫০) তার ছেলে দীপ দাসকে (১০) নিয়ে একসঙ্গে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে নিজেদের শেষ করে দিল৷ কিছুদিন আগে দিল্লির ঝুপড়িতে বীণা ওরফে বেণু সিংহের তিন কন্যা মানসী,পারুল ও শিখা তিনজনই এক সাথে অনাহারে মারা গেল৷ এরা সবাই তো আমাদেরই ভাই-বোন৷ যেখানে শত শত মানুষের এভাবে অনাহারে মৃত্যু হচ্ছে, সেখানে আমরা কিসের সভ্যতার গর্ব করি, কিসের জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের গর্ব করি৷ এই গর্ব করার কোনো অধিকার আমাদের নেই৷
তাই প্রাউট-প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন, ‘‘ ‘সমাজ’ শব্দটার ভাবগত অর্থ-হ’ল এক সঙ্গে চলা৷ শব্দের প্রকৃত তাৎপর্য নিয়ে যদি বস্তু বিচার করতে হয় তা’হলে বিনা দ্বিধায় বলতে হয় যে এখনও পর্যন্ত মানুষ যথাযথভাবে সমাজ জিনিসটা গড়তে শেখেনি৷ গড়া তো দূরের কথা, সমাজ জিনিসটার প্রয়োজনীয়তা আজও তার কাছে আবছা ধোঁয়াটে রয়ে গেছে৷’’
এই পরিপ্রেক্ষিতেই বলতে হয়, বিশ্বের সমস্ত সম্পদের প্রকৃত মালিক ঈশ্বর৷ সমস্ত মানুষই তাঁর সন্তান৷ তাই বিশ্বের সমস্ত সম্পদ সমস্ত মানুষেরই পৈত্রিক সম্পত্তি৷ সমস্ত মানুষেরই এতে যৌথ অধিকার রয়েছে ৷ এটাই ন্যায় সম্মত, এটাই ধর্মসম্মত , এটাই যুক্তিসঙ্গত৷
তাই, এই বিশ্বের সমস্ত সম্পদ যখন সকল মানুষের এজমালি সম্পত্তি, তখন একজন বিপুল পরিমান সম্পদ নিজের জিম্মায় আটকে রাখবে, আর লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে অভাবে শুকিয়ে মরবে , সেটা অন্যায়৷
তাই তিনি বলছেন, প্রকৃত মানবিক সমাজব্যবস্থায় অবাধ সঞ্চয়ের অধিকারী কারুরই থাকবে না৷ প্রাউট-প্রবক্তা বলেছেন, ‘‘এই বিশ্বব্রহ্মান্ড-সকলের যৌথ সম্পত্তি৷ এর ভোগ দখলের অধিকার সকলের আছে, কিন্তু অপব্যয়ের অধিকার কারো নেই৷ কোনো ব্যষ্টি যদি অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ ও সঞ্চয় করে সেক্ষেত্রে সে প্রত্যক্ষভাবেই সমাজের অন্যান্যদের সুখ-সুবিধা খর্ব করে থাকে৷ তার আচরণ প্রত্যক্ষভাবেই সমাজ বিরোধী৷ তাই সমাজের অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো ব্যষ্টিকেই সম্পদ সঞ্চয়ের সুযোগ দেওয়া উচিত নয়৷’’ সোজা কথায় প্রয়োজনাতিরিক্ত সঞ্চয়ের অধিকার কারুর নেই৷
আর জগতের সমস্ত সম্পদের মানব কল্যাণে সর্বাধিক উপযোগ নিতে হবে ও যুক্তিসঙ্গত বন্টন করতে হবে৷ দেখতে হবে, প্রতিটি মানুষ যেন ন্যূনতম চাহিদা পূরণের গ্যারান্টি পায় তথা এর জন্য প্রয়োজনীয় ক্রয়ক্ষমতা অর্জন করতে পারে৷ প্রতিটি মানুষও সমাজের মহা মূল্যবান সম্পদ৷ এই মহামূল্যবান মানবসম্পদের দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক বিকাশ ঘটিয়ে এদের সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করাও সমাজ তথা সরকারের অবশ্য কর্তব্য৷ প্রাউট-প্রবক্তা আরও বলেছেন , সমাজের সমস্ত ধরণের সম্পদের উপযোগের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকা বাঞ্ছনীয়৷ দেশ-কাল-পাত্রের পরিবর্তনে এই সমস্ত উপযোগসমূহের মধ্যেও পরিবর্তন কাম্য আর সেই সব পরিবর্তন হওয়া উচিত প্রগতিশীল--- অর্থাৎ ভৌতিক , মানসিক ও আধ্যাত্মিক সবক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবেই প্রগতি হওয়া উচিত৷
একমাত্র এই প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বই আজকের সভ্যতার চরম সংকট থেকে নিপীড়িত মানবতাকে উদ্ধার করতে পারে৷ এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই৷
- Log in to post comments