সমাজের ‘ভাগাড়ায়ন’---উত্তরণ কোন পথে ?

লেখক
আচার্য প্রসূনানন্দ অবধূত

কিছুদিন ধরে ভাগাড় থেকে মৃত পশুর পচা মাংস কলকাতাসহ শহরতলির  হোটেল-রেস্তোরাগুলিতে  সরবরাহের খবরে  রাজ্য-রাজনীতি সরগরম৷ দক্ষিণ ২৪পরগণায় বজবজেব ভাগাড় থেকে  মৃত পশুর পচামাংস  পাচারের খবর প্রথম প্রকাশ্যে আসে৷ পাচারের সাথে যুক্ত  স্থানীয় এক ব্যষ্টি ধরা পড়ে৷ প্রথমে এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে অনেকের মনে হলেও পরে প্রশাসন নড়েচড়ে বসে৷ পুলিশের তৎপরতা ও তল্লাশির ফলে বিভিন্ন জায়গা থেকে একের পর এক ভাগাড় থেকে মৃত পশুর  পচামাংস  হোটেল-রেস্তঁোরায় সরবরাহের ঘটনার কথা  আসে৷ জানা যায়, পুলিশের ধারণা এর পিছনে আছে এক বিরাট চক্র৷  এই চক্রের মূল পান্ডা বিশু ধরা পড়ে৷ পুলিশি জেরায় তার কাছ থেকে জানা যায় যে, গত ১০ বছর ধরে সে এই পচামাংসের কারবার করে ৬০ কোটি টাকা  আয় করেছে৷ ইতোমধ্যে  সে ‘ভাগাড় বিশু’ নামে তকমা পেয়েছে৷ আশঙ্কা করা হচ্ছে এর পিছনে রাজনৈতিক জগতের  অনেক কেষ্ট-বিষ্টু, রাঘব-বোয়ালরা আছে৷ এই চক্রের জাল অন্যান্য রাজ্যে এমনকি বাংলাদেশেও ছড়িয়ে আছে৷ ভাগাড়ের খবর নিয়ে বঙ্গীয় রাজনীতিতে সচরাচর  যা হয় শাসক বিরোধী দলের পারস্পরিক দোষারোপের তরজা , ফোড়ন কাটা, কটাক্ষ করা ইত্যাদি চলল আশ্চর্যের বিষয় যেটা হল কোনো রাজনৈতিক দলই এই ভাগাড়কান্ড নিয়ে দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবীতে কোনো আন্দোলন এখনও পর্যন্ত  করেনি৷   সোশ্যাল মিডিয়াগুলি সমাজের নানা ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ  করে অথচ এই ‘ভাগাড়কান্ড’ নিয়ে অনেক টিকা-টিপ্পনি, রম্যরচনা, ছড়া ইত্যাদি বেরোলেও দোষীদের শাস্তির দাবীতে কোনো আন্দোলন  গড়ে তোলার প্রচেষ্টা দেখা যায়নি৷ কোনো বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের  উচ্ছন্নের কিছু পড়ুয়া  যারা কথায় কথায়  ‘হোক কলরব’ বা ‘হোক আলিঙ্গন’ নামে আন্দোলন করে, ভাগাড়কান্ডের মতো এত বড় গর্হিত অপরাধের পরও তারা চুপ কেন?

দেখা যাচ্ছে মৎস্যভুক বাঙালীদের মধ্যে অনেকেই  নামী দামী হোটেল- রেস্তোঁরায় লোভনীয় নানা মাংসের পদের আকর্ষণে অজান্তেই এতদিন মৃত কুকুর, বিড়াল, গরু ও  মোষের পচা মাংস গলাধঃকরণ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন৷ তারাই এখন সবার অলক্ষ্যে গলায় আঙুল ঢুকিয়ে বমি করে  সেইসব নিষিদ্ধ মাংস উদগীরনের ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছেন৷

এ পোড়া দেশে  আমরা খাদ্যে ভেজাল একরকম ভবিতব্য বলেই মেনে নিয়েছি৷ কোন জিনিসে ভেজাল নেই? শিশু খাদ্য থেকে দুধ, ঘি, মধু, পনির, ফলমূল, শাক-সব্জি, ওষুধপত্র প্রভৃতি৷ সবকিছুতেই ভেজাল জিনিসে  বাজার ছেয়ে গেছে৷ ভেজাল তথা নিম্নমানের নির্র্মন সামগ্রী দিয়ে তৈরী ঘরবাড়ি ও  ফ্লাইওভার ভেঙ্গে পড়ে কত অসহায় নিরীহ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে৷  আমার এই লেখা যখন লিখছি৷ সেদিনের খবরে প্রকাশ,বারাণসীতে নির্মীয়মান ফ্লাইওভার ভেঙ্গে পড়ে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে৷  কয়েকবছর আগে কলকাতার পোস্তা এলাকায় একইভাবে নির্মীয়মান ফ্লাইওভার ভেঙ্গে পড়ে বহু মানুষের মৃত্যুর খবর  এখনও কেউ ভোলেনি৷

ভাগাড়কান্ড নিয়ে রাজনীতির মাঝেই এসে গেল৷পঞ্চায়েত ভোট, মনোনয়ন, নির্বাচন ও নির্বাচনের পর সন্ত্রাসের বলি হল বহু মানুষ৷ পশ্চিমবঙ্গবাসী আবার দেখল বামফ্রন্ট জমানার ‘হার্র্মদে’র নবসংস্করণদের অস্ত্র নিয়ে দাপাদাপি  পেশিশক্তির আস্ফালন৷  শাসকদল থেকে বলা হল বিরোধী ১০০ভাগ  উন্নয়ন সুনিশ্চিত করতে  বিরোধীশূণ্য পঞ্চায়েত চাই৷ এতে উৎসাহিত হয়ে  ‘কেষ্টা’র অমৃতবাণী--- বিরোধীরা মনোনয়ন জমা দিতে এলে দেখবে সামনে দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন! শাসকদলের এক কেউকেটা নেতা তো প্রকাশ্যে ঘোষনাই করে দিলেন যে বিরোধীশূণ্য পঞ্চায়েত উপহার দিতে পারলে সেই পঞ্চায়েতকে ৫ কোটি টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে৷  মাননীয়া দিদি, আপনি তো অনেক আঘাত সয়ে, রক্তাক্ত হয়ে সিপিএমের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বহু বছর ধরে অনেক আন্দোলন করে আজ বাংলার শাসকের আসনে বসেছেন  মানুষের প্রাণঢালা ভালবাসা নিয়ে৷ রাজনীতিতে দীর্ঘদিন বিরোধী পক্ষের ভূমিকা আপনি পালন করেছেন আর আজ আপনি বলছেন বিরোধী শূণ্য পঞ্চায়েত চাই! গণতন্ত্রে যদি কোনো বিরোধীপক্ষ না  থাকে তাহলে তাকে স্বৈরতন্ত্র /একনায়কতন্ত্র     আখ্যা দেওয়া হয়৷ আপনি কি চীনের মতো এক পার্টিরাজ  কায়েম করতে চাইছেন এই পশ্চিমবঙ্গে?   ১৯৭২ সালে পূর্ববঙ্গের মুক্তি যোদ্ধাদের সাহায্যার্থে  তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে পরিচয় দিয়ে ভারতের সেনা প্রেরণ করেছিলেন৷ ভারতীয় সেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের  মিলিত লড়াইয়ের ফলে পাকিস্তান পরাজিত হয়েছিল৷ তৈরী হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ৷ সেজন্য ইন্দিরা গান্ধী সারাবিশ্বে বন্দিত হয়েছিলেন  ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য ’বলে৷ কিন্তু মাত্র কয়েকবছর পর  ১৯৭৫সালে  তিনিই জরুরী অবস্থা জারি করে  গণতন্ত্রের কন্ঠরোধ করেছিলেন৷ ফলে মুক্তিসূর্য থেকে হয়ে গেলেন খলনায়িকা স্বৈরতন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী৷ মায়ানমারের মানবধিকার আন্দোলনের নেত্রী আং সান সুকি  আন্দোলন করে তৎকালীন সামরিক সরকারের জেলে দীর্ঘদিন অন্তরীণ ছিলেন৷ পরবর্তীকালে  জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি নির্বাচনে জিতে মায়ানমারের প্রধানমন্ত্রী হন৷ তাঁর এই মানবধিকার আন্দোলনের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি  নোবেল শান্তি পুরস্কার পান৷ কিন্তু ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস! একদা মানবধিকারের জন্যে লড়াই করা সেই আংসান সুকির নেতৃত্বে সেদেশের সেনাবাহিনী মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের (প্রাচীন নাম আরাকান প্রদেশ) অধিবাসী বাঙালী রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের ষ্টীমরোলার চালালো, তাঁদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ছারখার করল , হাজার হাজার পুরুষ,নারী ও শিশুদের নৃশংসভাবে হত্যা করল৷ বেঁচে থাকা অসহায় রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে মায়ানমার ছেড়ে পালিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে ও ভারতে আশ্রয় নিয়েছে৷ আংসান সুকির এই স্বৈরতন্ত্রী রূপ দেখে রাষ্ট্রসংঘ  তার নোবেল শান্তি পুরস্কার কেড়ে নেবার হুমকি দিল৷ একদা ক্ষমতায় মদমত্ত ইন্দিরা গান্ধী তার শাসনকালে ‘দেয়ালের লিখন’  পড়তে পারেননি৷  ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে  ৩৪ বছর রাজত্ব করার পর সিপিএম ভাবছিল যে তারা হল অজেয় অক্ষয়৷ সেদিন মদগর্বী সিপিএমও  দেয়ালের লিখন পড়তে পারেনি৷ তারা ভেবেছিল  কেউ তাদের শাসন ক্ষমতা থেকে হটাতে পারবে না৷ পরিণতি কী হয়েছিল তা আপনার থেকে ভাল আর কে জানে? সিপিএমের  গ্রানাইট  পাথরের মতো শক্ত সংঘটনিক ভিতের ওপর তৈরী দলকে ধরাশায়ী  করে  আপনি এলেন ক্ষমতায়৷ আজ রক্তঝরা পশ্চিবঙ্গের বর্তমান  অবস্থা দেখে  মনে হচ্ছে সিপিএমের হার্র্মদরা  সব রঙ পাল্টে আপনার দলে  ঢুকে পড়েছে৷ আপনার উন্নয়নের কাটমানি  খাওয়ার জন্য নিজের দলে  এত গোষ্ট দগ্দ, খুনোখুনী৷  মেঘ উকি দিচ্ছে, আপনার সেই বহু পরিচিত মানবিক মুখের  বদলে  কি তা হলে অন্যকোনরূপ ক্রমশ প্রকট হচ্ছে? পঞ্চায়েত নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি  দেখে  মনে  হচ্ছে আপামোর  নির্দেশ দলের নীচের  তলার নেতৃত্ব মানছে না৷  তারা ক্ষমতার মোহে  আপনার  আদর্শ  সব ভুলে যাচ্ছে৷ অনেকে এক একজন মিনি বস্তু কেনস্টাইন  তৈরী হয়েছে৷ আপনিও কি দেওয়ালের লিখন পড়তে পারছেন? ক্ষমতার রাজনীতিতে টিকে থাকতে ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে  এত মানুষের রক্তে হাতরাঙ্গা করতে হবে৷ বর্তমানের  সব রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই অবশ্য এক নির্মম সত্য! মানুষের  মৃত্যু নিয়েও আমরা ওরার’ রাজনীতি৷  সংখ্যাতত্ত্বের  হিসেব  দিয়ে সব দলই বোঝানোর  চেষ্টা করে যে আমার দলের  থেকেই  বেশী কর্মী মরেছে  ৷ আসলে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলু খাগড়ার প্রাণ যায়৷  যারা মারা গেছে তারা তো কারও ছেলে, স্বামী, ভাই৷  কত মায়ের কোলখালি হল কত স্ত্রী স্বামী হারা, ভাই হারা হল৷ কত যেন! দলগুলোর মধ্যে যদি সত্যিই কোন মানবিক মুখের নেতানেত্রী থাকতেন তাহলে তারা বলতেনঃ

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন,

কান্ডারী  বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র৷

বাংলার মানুষ খুব  খুশী  হতো  যদি মুখ্যমন্ত্রী দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত  স্বয়ম্ভর বাংলা গড়ার  ডাক দিতেন৷  শোষক ও দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের  ডাক দিতেন৷  কিন্তু হায় বাংলার দুর্র্ভগ্য যে  দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণ চোরাগলিতেই  আটকে রইল এখানকার রাজনীতিকরা৷ দলীয় রাজনীতির  স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া  বর্ত্তমানে  কুপমন্ডুক রাজনীতিকরা আর কিছু ভাবতেই পারে না৷ কোন কোন দল তথাকথিত ধর্মের ভিত্তিতে বিভেদের  রাজনীতি করছে৷ যেনতেন প্রকারে রাাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে সমাজকে টুকরো টুকরো করার ধবংসাত্মক খেলায় মেতেছে৷

সুধীপাঠকবৃন্দ, ওপরের আলোচনায় আমরা  খাদ্যব্যবস্থায়  ও রাজনীতির  ভাগাড়ায়ন দেখলুম৷ এখানে ভাগাড়ায়ন কথার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অবক্ষয়, দূষণ৷  এবার আসুন, শিক্ষাজগতের বর্ত্তমান চালচিত্রটা কী  একটু দেখে নেওয়া যাক৷ প্রাক স্বাধীন ও স্বাধীনোত্তর বাংলায় শিক্ষাব্যবস্থার মান ছিল  এখনকার থেকে অনেক উঁচুতে৷  সে সময় পঁুথিগত শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে নীতিশিক্ষায়  খুব জোর দেওয়া হত৷

সেই সময় সত্যিকারের ছাত্রদরদী আদর্শ শিক্ষকগণ ছিল বলেই তাদের শিক্ষায় শোষিত হয়ে এক ঝাঁক দিকপাল নক্ষত্র শিক্ষায়,সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, রাজনীতিতে,  ধর্মদর্শনে  বাংলা  তথা ভারতের মুখ উজ্বল করেছিলেন৷ প্রকৃতপক্ষে সেই সময়টা ছিল  বাংলার রেঁণেশার স্বর্ণযুগ৷ বামফ্রন্টের আমলে  শিক্ষাব্যবস্থার রাজনীতিকরণ করে  গোটা শিক্ষাব্যবস্থার বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হল৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা দানের পরিবর্তে হয়ে উঠল দলীয় ক্যাডার তৈরীর আঁতুড় ঘর৷  শিক্ষাব্যবস্থায় সিপিএম রাজনীতিকরণের  যে ধারা তৈরী করে গিয়েছিল বর্ত্তমান শাসকদল সিপিএমের সেই ছেড়ে যাওয়া নোংরা জুতোয় পা গলালো৷  প্রতিবছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে লক্ষ লক্ষ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার এম.বি.এ ইত্যাদি ডিগ্রীধারীরা বেরোচ্ছে--- এদের মধ্যে ‘প্রকৃত মানুষ’ ক’জন তৈরী হচ্ছেন? আজকের শিক্ষাব্যবস্থা নীতিশিক্ষা ও আধ্যাত্মিক আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে  শুধু কেরিয়ারিস্ট  তৈরীর দিকে নজর দিচ্ছে৷ যাদের মধ্যে অনেকেই আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, ভোগমুখী অর্থোর্পাজনের এক এক জন রোবট পরিণত হচ্ছে৷ যারা নিজেকে ছাড়া আর কারও কথা ভাবে না৷  মা-বাবা,ভাই-বোন, স্ত্রী-স্বামীর ভালবাসার বন্ধনও তাদের কাছে গৌণ হয়ে যাচ্ছে৷  নিজের মাতৃভূমি  তথা দেশ ও জাতির প্রতি  তাদের টান ক্রমশঃ ফিঁকে হয়ে যাচ্ছে৷ আর শিক্ষক! বর্ত্তমানে দুরবীন দিয়ে  প্রকৃত ছাত্রদরদী আদর্শ শিক্ষককে খঁুজতে হবে৷ বেশীরভাগ  শিক্ষকেরই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে টিকি বাঁধা আছে৷ এদের মধ্যে অনেকেই সুকল- কলেজে এসে ছাত্র পড়িয়ে বাজে সময় নষ্ট না করে  নিজের কোচিং ক্লাসে  সময়  দিতে বেশী ভালবাসেন৷  এধরণের শিক্ষকদের নীতি হল ‘আসি যাই  মাইনে পাই, বেশী করে টিউশন পড়াই৷ এইভাবেই শিক্ষাব্যবস্থার  ভাগাড়ায়ন তথা অবক্ষয় সম্পন্ন হয়েছে৷

কম্যুনিজমের অকাল মৃত্যুর পর  বর্ত্তমানে পুঁজিবাদ সারা বিশ্বজুড়ে শোষনের করাল দ্রংষ্টা বিস্তার করেছে৷ এক কথায় বলা যায়, ধনলোলুপ বৈশ্যরা বহুজাতিক সংস্থার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিশ্বায়নের নামে  আসলে শোষণের বিশ্বায়ন ঘটিয়েছে৷ ছলে-বলে-কৌশলে তারা পূর্ব থেকে পশ্চিম গোলার্ধ --- টোকিও থেকে ত্রিনিদাদ, উত্তর থেকে দক্ষিণ গোলার্ধ---ফিনল্যান্ড থেকে ফকল্যান্ড,  প্রায় প্রত্যেক অধিবাসীর অফিস, হেঁসেল থেকে  বেডরুমে পর্যন্ত ঢুকে গেছে৷ বিশ্বের  ৯৯ শতাংশ মানুষের কাছে যা সম্পদের পরিমান আছে তা মাত্র এক শতাংশ পুঁজিপতিদের হাতে কুক্ষিগত হয়ে রয়েছে৷ ফলে সমাজে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট আর্থিক বৈষম্য ৷ একদিকে গগণচুম্বী অট্টালিকার অভ্রংলেহি  স্পর্র্ধ অন্যদিকে বস্তির  অস্বাস্থ্যকর  স্যাঁতসেঁতে ঘর৷ যেখানে নিরন্ন ক্ষুধাতুর মানুষেরা শুয়ে শুয়ে  ভাঙ্গা ছাদের ফুটো দিয়ে  আকাশের তারা গোনে৷

একদিকে সম্পদের প্রাচুর্য, অন্যদিকে  ভুখা মানুষের মৃত্যুর মিছিল, ধনলোলুপ বৈশ্যরা তাদের শোষনের সাম্রাজ্যকে দীর্ঘস্থায়ী করতে ধীরে ধীরে ব্যবসা- বাণিজ্য, শিক্ষা,স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, রাজনীতি ও সাংসৃকতিক জগৎকে গ্রাস করে নেয়৷  পঁ জিপতিরা অর্থের টোপ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিেেক কব্জা করে  নেতাদের  পর্র্দর আড়াল থেকে  পুতুলের মতো নাচায় ৷ তাঁদের স্বার্থে সংস্কারের নামে  কৃষি,শিল্প, স্বাস্থ্য ব্যবসা-বাণিজ্যে  উন্নত প্রযুক্তি রূপায়নের নামে   সবকিছু এক চেটিয়া তথা কুক্ষিগত করে নেয়৷ বর্ত্তমানে ভারতে  ওয়ালমার্ট  , মেট্রো প্রভৃতি বহুজাতিক সংস্থার দাপটে  বহু মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে৷ বৈশ্যরা অর্থমূল্যে বুদ্ধিজীবীদের  বৌদ্ধিক শক্তিকে কিনে নিয়ে  তাদের সাহায্যে শোষনকে  প্রায় শিল্পের পর্র্যয়  নিয়ে গেছে৷ শোষনের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে যাতে কোনোভাবে পুঁজিপতিদের শোষনের বিরুদ্ধে যুব-ছাত্র সমাজের বিক্ষোভ-বিদ্রোহের বীজ অঙ্কুরিত না হয় সেজন্য তারা অতি সুচতুরভাবে যুব-ছাত্র সমাজের  নৈতিক মেরুদন্ড  ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে৷

সে উদ্দেশ্যে হয় তারা নিজেরাই  সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল, কিনে নেয়  ও অর্থমূল্যে একশ্রেণীর তথাকথিত  গায়ক-গায়কী, সাহিত্যিক,  ডাক্তার, গিতিকার, সুরকার, পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রী প্রমুখ সেলিব্রিটিদের  বৌদ্ধিক শক্তিকে কিনে নেয়৷  তাদের সাহায্যে  সমাজে অশ্লীল ও উত্তেজক সাহিত্য, সিনেমা, টিভি সিরিয়াল ও সঙ্গীতের জোয়ার বইয়ে দেয়৷ এভাবেই পুঁজিপতি বৈশ্যরা সাংসৃকতিক জগতের  ভাগাড়ায়ন সম্পন্ন করেছে৷

এতক্ষণ ওপরের আলোচনায় আমরা দেখলুম কিভাবে সমাজের সর্বস্তরে ভাগাড়ায়ন বা অবক্ষয় হয়েছে৷ এখন প্রশ্ণ হচ্ছে এই সার্বিক অবক্ষয় থেকে  মুক্তির উপায় কী?

উদার অর্থনীতিতে শোষনের বিশ্বায়নের ফলে  পৃথিবীটা আজ  পুঁজিপতি বৈশ্যদের হাতের মুঠোয়৷ ধনলোলুপ বৈশ্যদের জীবনদর্শন হলো ‘‘ সর্বে গুণা কাঞ্চনম্ আশ্রয়ন্তি’’৷  বৈশ্যযুগে সবকিছুই  টাকার মূল্যে নির্র্ধরিত হয়৷ বৈশ্যের বল্গাহীন শোষনের  যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্তদের  মধ্যে অধিকাংশই  মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে  অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের দাসে পরিণত হয়েছে৷ শিক্ষা, সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি প্রভৃতি উপাদানগুলো সমাজের এক একটি স্তম্ভ ৷ এই স্তম্ভগুলোর উপর ভর করেই ‘সমাজ’ নামক বহুতল অট্টালিকা তৈরী হয়৷ পুঁজিপতিদের অবাধ শোষনের ফলে  সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রই  আজ ক্ষয়রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েছে৷ পচে গলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে৷ এই দূষিত সমাজের  কোন অঙ্গই সুস্থ নেই৷ তাই এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজের পুরো কাঠামোটাই  সমূলে উপড়ে ফেলে পরিবর্তে স্থাপন করতে হবে৷ নোতুন সমাজের  ভিত্তিপ্রস্তর৷ 

কম্যুনিজমের অকাল মৃত্যু ও পুঁজিবাদের অবাধ শোষনের ফলে সমাজে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট আর্থিক বৈষম্য৷  দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষের সামাজিক মূল্যবোধ,  ন্যায়, নীতি, সততা ও অন্যান্য শ্রেয়বোধগুলি বুলেটের আঘাতে বিধবস্ত হয়েছে৷ মানুষ ধীরে ধীরে পশুত্বের দিকে এগিয়েছে৷  তাই তো আজ ধর্মের নামে এত সন্ত্রাস,  ধর্মীয় মৌলবাদীদের এত আস্ফালন, রনভেরীর এত পাঁয়তাড়া, যুদ্ধের এত হুঙ্কার৷ পশ্চিম এশিয়া থেকে আফ্রিকা ও ইয়োরোপ আজ  ক্ষত-বিক্ষত ,রক্তাক্ত , ধূলিলুন্ঠিত মানবতা, বিপন্ন পৃথিবী৷ সুপার পাওয়ার দেশগুলোর   তত্ত্ব হলো---  ‘Preach the gospel  of peace but keep your powders dry ’’ --- ‘মুখে শান্তির ললিত বানী প্রচার করো কিন্তু  নিজের বারুদ শুকনো রাখ’৷ এদের ব্যবসায়িক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের বলি হচ্ছে বিশ্বের লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ৷

বাংলা, ভারত তথা গোটা বিশ্ব যখন চরম যুগ সংকটের আবর্তে নিমজ্জিত  এইরকম এক ঐতিহাসিক যুগ সন্ধিক্ষণে  যুগপুরুষ , মহান দার্শণিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার দিশাহারা মানব সমাজকে  উপহার দিলেন তাঁর যুগান্তকারী  সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শন ‘‘প্রাউট’’ --- প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব৷  প্রাউটের লক্ষ্য হলো  সমাজে সর্বপ্রকার অবক্ষয়,  দুর্নীতি ও শোষনের মূলোৎপাঠন করে আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক  এক অবিভাজ্য মানব সমাজ  তথা শোষনমুক্ত নোতুন পৃথিবী গড়ে তোলা৷  তাই প্রাউট  হল আজকের যুগের দাবী,  নিপীড়িত মানবতার মুক্তির পথ৷  প্রাউট হল  এক সর্বরোগ হর মকরধবজ৷ সমাজের যেকোনো সমস্যার ওপরই  তা প্রয়োগ করা হোক না কেন, তার সমাধান এনে দেয়৷ 

এবারে আমরা দেখব কিভাবে প্রাউট দর্শনের আলোকে সমাজের অবক্ষয় থেকে মুক্তি মিলবে ৷

রাজনৈতিক অবক্ষয় থেকে মুক্তি ঃ উপরিউক্ত আলোচনায় আমরা দেখলুম পুঁজিবাদের প্রভাবে প্রাউট প্রবক্তার ভাষায় ‘‘জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি জড়াভিমুখী হয়ে যাওয়ার কারণে  মানুষের সমাজে আজ এত সমস্যা, সভ্যতার এত সংকট’’৷ বর্তমানে রাজনীতি মানে হল নীতিহীনতার রাজনীতি৷  রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল,  যশ, অর্থপ্রাপ্তির মোহে আদর্শ, ন্যায়-নীতিবোধ, মানবিকতা সব জলাঞ্জলি দাও৷  ক্ষমতার মোহে অন্ধ মদমত্ত নেতানেত্রীদের  ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থের যুপকাষ্টে বলি হচ্ছে প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষ৷ এই প্রেক্ষাপটে  প্রাউট প্রবক্তার  সতর্কবাণী ঃ- সভ্যতার এই সন্ধিক্ষণে  ব্যষ্টিজীবনে সাধুতার প্রয়োজন  সব চাইতে  বেশী.... তাই সাধু তাই যদি না বাঁচল সভ্যতা বাঁচবে না৷ ব্যর্থ হয়ে যাবে মানুষ জাতির  সুদীর্ঘ সাধনা৷...’’

শাসনব্যবস্থার যতগুলো পদ্ধতি আছে তার মধ্যে মন্দের ভাল বা কানার মধ্যে ঝাপসা হল গণতন্ত্র৷ যদিও গণতন্ত্রের মূল কথা হলো ‘জনগণের দ্বারা, জনগণের, জনগণের জন্যে’৷  আসলে কিন্তু  এটা ‘বোকাদের দ্বারা, বোকার ও বোকাদের জন্যে’৷ গণতন্ত্রের যে মূল স্তম্ভ গণতা বা জনতা,  তাদেরই  বোকা বা নির্র্বেধ করে রাখা হয়, প্রতিপদে তাদের ঠকানো হয়৷ আজকের মূল্যবোধহীন গণতন্ত্রে জনতার দ্বারা নির্বাচিত হবার পর পরই জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই  অর্থের টোপে  বিক্রি হয়ে যাচ্ছে অন্যদলের কাছে৷ এইসব  দলের পিছনে বৈশ্যরা টাকার থলি নিয়ে ঘোরে ৷ জনগণের ভোটে নির্বাচিত  প্রতিনিধিরা জনতার স্বার্থের কথা ভুলে গিয়ে আইনসভায় বৈশ্যদের স্বার্থরক্ষা করতে  বিভিন্ন আইন প্রণয়ণ করে৷ তাদের শোষণের পথ সুগম করে৷ প্রাউট প্রবক্তার ভাষায় ‘রাজনৈতিক গণতন্ত্র জনগণকে কাগজে কলমে ভোটাধিকার দিলেও  কেড়ে নিয়েছে অর্থনৈতিক অধিকার৷ তার ফলে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট অর্থনৈতিক বৈষম্য, জনগণের ক্রয়ক্ষমতায় এসেছে প্রচন্ড অসাম্য, সৃষ্টি হয়েছে বেকার সমস্যা, খাদ্য ঘাটতি, দারিদ্র ও সামাজিক সুরক্ষার অভাব৷ ...... ভারতের সংবিধান তিন শোষকগোষ্ঠী দ্বারা রচিত--- ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী, দেশী সাম্রাজ্যবাদী আর ভারতীয় পুঁজিদের প্রতিনিধিত্ব করা শাসকদল৷  তাই ভারতীয় সংবিধানে  সমস্ত নীতি নিদের্শনার  এই সুবিধাভোগীদের কায়েমী স্বার্থরক্ষা করা হয়েছে ’’৷  এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের সার্বিক কল্যাণ সম্ভব নয়৷  তাই প্রাউটের শ্লোগান হচ্ছে--- ‘‘ রাজনৈতিক গণতন্ত্রের  ধাপ্পাবাজি নয়, আমরা চাই অর্থনৈতিক গণতন্ত্র, শোষন মুক্ত সমাজ’’৷ অর্থনৈতিক গণতন্ত্র হল- মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির  একমাত্র চাবিকাঠি৷

প্রাউটের মতে  ‘‘গণতন্ত্র সফল হবার  প্রাক শর্তগুলি হচ্ছে--- নৈতিকতা, শিক্ষার প্রসার আর সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সচেতনতা’’৷ রাজনীতি মানে শ্রেষ্ঠনীতি ৷ যার  মূলকথা হল জনগণের কল্যাণ ---তাই নেতৃত্বের পদে যারা আসীন হবেন, তাদের  মান অবশ্যই  অনেক উঁচুতে থাকতে হবে, নাহলে  সামাজিক কল্যাণ  ব্যাহত হতে বাধ্য৷ কিন্তু আজ অধিকাংশ  গণতান্ত্রিক  দেশে দুর্নীতিগ্রস্ত  ও কায়েমী  স্বার্থবাদীরাই  নির্বাচিত  হয়৷  এমনকি  কুখ্যাত খুনী , ডাকাত, মাফিয়া নির্বাচনে  জিতে সরকারে অংশগ্রহণ  করে৷  উদা- সম্প্রতি   পঞ্চায়েত  নির্বাচনে  জয়ী বিভিন্ন পার্টি  আশ্রিত খুনী, মাফিয়া৷ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই মাফিয়া ও খুনীদের আশ্রয় দেয়৷  অর্থনৈতিক  গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার  জন্য  নিম্নলিখিত  কর্মসূচীগুলি বাস্ত বায়িত  করতেই হবেঃ

১) সকলের জীবনধারণের  নূ্যনতম  প্রয়োজনপূর্ত্তি  সুনিশ্চিত  করতে হবে৷

২) প্রত্যেকের  ক্রয়ক্ষমতার  ক্রমবৃদ্ধি  সুনিশ্চিত  করতে হবে৷

৩) সমস্ত  অর্থনৈতিক  সিদ্ধান্ত গ্রহণের  ক্ষমতা স্থানীয়  জনসাধরণের  হাতে রাখতে হবে৷

৪)স্থানীয় অর্থনীতিতে বহিরাগতদের কোন অধিকার থাকবে না৷ (বিস্তারিত জানতে প্রাউটের  অর্থনীতি পুস্তকটি দ্রষ্টব্য)

শিক্ষা ব্যবস্থার অবক্ষয় ও উত্তরণের  পথ ঃ

শিক্ষা হল জাতির মেরুদন্ড ৷  কিন্তু  দুঃখের সঙ্গে  বলতে হচ্ছে যে, আজকের পৃথিবীতে  বিশেষত ভারতবর্ষে আরও  বিশেষভাবে  বলতে গেলে পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে  অবহেলিত হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা৷  যেন তেন প্রকারে একটা ডিগ্রি বা সার্টি ফিকেট পাওয়াই  যেন আজকের শিক্ষাব্যবস্থার তথা ছাত্রসমাজের  লক্ষ্য হয়ে দাড়িয়েছে ৷ মানুষের নৈতিক  তথা আত্মিক  মূল্যবোধ সেখানে গৌণ৷ এমতাবস্থায় প্রাউটের  শিক্ষাব্যবস্থার  অন্তনির্হিত মূল লক্ষ্য হল---‘‘সা বিদ্যা যা বিমুক্তায়ে’৷ মানুষকে তার ত্রিস্তরীয় (শারীরিক ,মানসিক ও আধ্যাত্মিক) মুক্তির পথ দেখানো৷  পঁুথিগত জ্ঞান তো চাই-ই৷ সেই সঙ্গে মানুষ যাতে সার্বিক মুক্তির সোপানতলে পৌঁছাতে পারে  তারও  ব্যবস্থা চাই৷

শিক্ষাবিদ শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার প্রাউটের  শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক, সরকার  তথা শিক্ষার রূপরেখা সম্বন্ধে মৌলিক বক্তব্য রেখেছেন৷  প্রাউট প্রবক্তার  দৃষ্টিতে  শিক্ষক  হলেন সমাজগুরু৷ তাই  শুধুমাত্র শিক্ষাগত অভিজ্ঞান-পত্র থাকলেই  কাউকে শিক্ষকতা করা অধিকার  দেওয়া হবে এমন কোন কথা নেই৷ তার চারিত্রিক দৃঢ়তা, ধর্মনিষ্টা, সমাজসেবা, পরার্থপরতা,ব্যষ্টিত্ব ও নেতৃত্বের গুণাবলী থাকতেই হবে৷ শিক্ষার কমল বনে তিনি মদমত্ত মাতঙ্গের প্রবেশ  পছন্দ করেন না৷  আবার দায়িত্ব সম্বন্ধে বলতে গিয়ে শ্রী সরকার বলেছেন--- ‘‘দলীয় রাজনীতির হাতথেকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সযত্নে মুক্ত রাখা দরকার৷  শিক্ষা ব্যবস্থার আর্থিক দায়দায়িত্ব রাষ্ট্রের৷ কিন্তু পঠন পাঠন তথা পাঠ্য বিষয় নির্বাচনের একচ্ছত্র অধিকার  (প্রকৃত) শিক্ষাব্রতীদেরই থাকা উচিত,  রাষ্ট্র এই শিক্ষাব্রতীগণকে বা বিশ্ব বিদ্যালয়কে পরামর্শ  দিতে পারে --- হুকুম করতে  পারে না, কোনো প্রস্তাব বিচার বিবেচনার জন্যে পাঠাতে পারে,  গ্রহণ করতে চাপ দিতে পারে না’’৷  তাই শিক্ষাক্ষেত্রে কলেজ -ইয়ূনিবার্সিটির স্বশাসনের দাবীকে আমরা সমর্থন করি৷ তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক ভাবধারার  সঙ্গে  পাশ্চাত্ত্যের বিজ্ঞান ও কারীগরী শিক্ষার সমন্বয়আর বৈবহারিক  এই শিক্ষা ব্যবস্থার বাস্তবায়নই প্রাউটের শিক্ষা পদ্ধতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য৷

মানস-অর্থনৈতিক শোষন ও সাংসৃকতিক অবক্ষয় থেকে উত্তরণের পথ ঃ

পুঁজিবাদের মারাত্মক ও সর্বগ্রাসী শোষনের আধুনিকতম রূপ হল মানস-অর্থনৈতিক শোষন ৷ শোষন যেখানে জড় শক্তির বলে হয় তা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক শোষন৷ কিন্তু যেখানে  শোষন জড়শক্তির বদলে  বুদ্ধির দ্বারা চালাকির দ্বারা হচ্ছে সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানস-অথনৈতিক শোষন৷ অর্থনৈতিক শোষনের আগে মানুষের মধ্যে  হীনম্মন্যতা ও ভীতমম্মন্যতা বোধের সূচিকা প্রয়োগ করে দেওয়া হয়৷  মানসিক স্তরের শোষনের ওপর ভিত্তি করে  অন্যান্য স্তরে শোষন শুরু হয়৷

আজকের প্রচলিত ভোগবাদী সংস্কৃতির মূলকথা হল ‘‘আর্ট ফর আর্ট সেক’’৷ বলাবাহুল্য প্রাউট এই ধারনাকে পরিত্যাগ করেছে৷ প্রাউটের মতে সংস্কৃতির মূল থিম হওয়া উচিত--- ‘Art for service and blessedness ’’--- সাহিত্য-শিল্প হল সেবা ও কল্যাণের জন্যে৷ প্রাউটের মতে সাহিত্যিকরা  সমাজ শিক্ষক , তারা শুধু বর্তমানের  প্রথিভূ নয়,  তারা অতীতের চারণ ও ভবিষ্যতের বার্র্তবহ৷  ‘‘আর্ট ফর আর্ট সেক’’ কে সামনে রেখে  ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য  আজকের অনেক সাহিত্যিক ও শিল্পী জীবনের নোংরা দিকটা  খঁুজে বেড়ান৷  এই ধরণের সাহিত্য ও শিল্প সৃষ্টির  পিছনে লক্ষ্য থাকে মোটা রোজগার করা এর অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ গোটা সমাজের নৈতিক অধঃপতন দেখা দেয় ৷  মানুষের মনের কোনে যে পশু লুকিয়ে আছে তার প্ররোচনায় মানুষ হীনবৃত্তির দিকে বেশী ঝুকে পড়ে ৷ আর হীনবৃত্তিগুলিকে কেন্দ্র করে সাহিত্য, সিনেমা,নাটক ,সিরিয়াল বা শিল্প সৃষ্টি করলে স্বাভাবিক নিয়মেই দলে দলে মানুষ সেগুলো দেখার জন্যে হামলে পড়ে৷ ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় আজকের পুরুষশাসিত সমাজে নারী পুরুষের ভোগের পণ্য ছাড়া আর কিছুই নয়৷ সমাজের সার্বিক অবক্ষয়ের ফলে মানুষের বিবেকবোধ , ভালমন্দ বিচার করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ৷ যার ফলে   সমাজে নারী পাচার, নারীর ওপর পাশবিক অত্যাচার ও খুনের ঘটনা  প্রতিদিন  বেড়েই চলেছে ৷ পুঁজিপতি সৃষ্ট   অ-সংস্কৃতির জোয়ারে  ভোগীমন অবাধে ভেসে যাচ্ছে৷  সমাজ অ-সংস্কৃতির  কালব্যাধীতে আক্রান্ত হয়ে গেছে৷ সমাজের অনেকেই বর্তমানে ভোগবাদী অ-সংস্কৃতির গড্ডালিকাস্রোতে গা  ভাসিয়ে দিয়েছে৷ বৈশ্যদের সুচতুর পরিকল্পনায় পাশ্চাত্ত্যের ভোগবাদের প্রভাব  সমাজের সর্বস্তরে  এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে যে, এই ভোগসর্বস্ব  মনস্তত্ত্ব বুদ্ধিজীবী থেকে সাধারণ মানুষরা বুঝতেই পারছে না  যে তারা শোষিত হচ্ছে৷  তাদের মাতৃভাষা  আপন সংস্কৃতি  কেড়ে নিয়ে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে  ভোগবাদী অ-সংস্কৃতি৷  এটাকেই বলা হয় মানস-অর্থনৈতিক- সাংসৃকতিক শোষন৷ শাস্ত্রে বলা হয়েছে,

‘‘চিত্তনদী  উভয়ত প্রবাহিনী’’৷

মন  ওপরের দিকে উঠতে পারে, তস্করে মন নীচের দিকে তরতরিয়ে নেমে যায়৷  এখন মানুষের সামনে যদি কোনো পূর্র্ণঙ্গ  জীবনাদর্শ ও তার ওপর ভিত্তি করে কোনো  নীতিবাদ সমন্বিত  আধ্যাত্মিক জীবনচর্র্য না থাকে, নিজেকে আদর্শ মানুষ হিসেবে তৈরী করার কোনো প্রচেষ্টা না থাকে৷  এমতবস্থায়  মানুষের সামনে যদি থরে থরে  জাগতিক ভোগের উপকরন সাজানো থাকে,  তাহলে, তাদের হাতছানিতেই  মানব মন তরতরিয়ে নীচের দিকে  তথা স্থূল ভোগের দিকে নেবে যায়৷

শুধু কঠোর আইন প্রণয়নের মাধ্যমে খুন ,নারীর ওপর পাশবিক অত্যাচার ইত্যাদি ঘটনা  তথা অবক্ষয়কে রোধ করা  যাবে না৷  সমাজের সার্বিক অবক্ষয়ের জন্য দায়ী ভোগবাদ তথা জড়বাদ৷ সেজন্যে দরকার  ভোগসর্বস্ব জীবনচর্র্যর বদলে  ব্যষ্টি ও সমষ্টি জীবনে  প্রতিষ্ঠিত করতে হবে অধ্যাত্মমুখী জীবনচর্র্য৷ শৈশবস্থা থেকেই  ঘরে ও শিক্ষাঙ্গনে নীতিশিক্ষার সঙ্গে  বিজ্ঞানভিত্তিক  যোগসাধনার নিবিড় অনুশীলন মাধ্যমে প্রয়োজন আত্মোন্নতির প্রয়াস৷ শোষণমুক্ত

আদর্শ সমাজ গড়তে গেলে  সর্বাগ্রে প্রয়োজন পূর্র্ণঙ্গ জীবনাদর্শের অনুসরণ ও তার ওপর ভিত্তি করে সমাজের সর্বস্তরে  আদর্শ নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা৷ বলাবাহুল্য প্রাউটের আছে  এক পূর্র্ণঙ্গ জীবনাদর্শ ও তার ওপর ভিত্তি করে আধ্যাত্মিক জীবনচর্র্যর  নিবিড় অনুশীলনের মাধ্যমে  আদর্শ নেতৃত্ব গড়ে তোলার ব্যবস্থা৷  প্রাউটের ভাষায় এই আদর্শ মানুষকে বলা হয় ‘সদবিপ্র’৷ যারা শারীরিকভাবে পরিশ্রমী,  মানসিকতায় ঋদ্ধ ও  আধ্যাত্মিকতায় সমুন্নত যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামী৷ --- তারাই সমাজে  সদবিপ্র রূপে  পরিগণিত হবেন৷

বৈশ্যযুগে শোষনের চরম অবস্থায় গণ জাগরণ তথা বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী৷ প্রাউট প্রবক্তার মতে ---‘‘যারা এধরণের কঠোর আদর্শ নিষ্ট সদবিপ্র  তারাই হবে বিপ্লবের বার্র্তবহ৷  ধরিত্রীর প্রতিটি গৃহকোনে, মানব অস্তিত্বের  প্রতিটি শিরায়-উপশিরায় বিপ্লবের বাণী এরাই পৌছে দেবে৷  বিপ্লবের বিজয় কেতন থাকবে শুধু এদেরই হাতে৷  লাঞ্ছিত পৃথিবীর  ধূলিলুন্ঠিত মানবতা তাদের আগমনের প্রতীক্ষায়  অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে৷’’   তাই আগামী দিনে বিশ্বের সমস্ত শুভচিন্তক সংগ্রামী মানুষকে আদর্শ নোতুন পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে প্রাউটের এই শোষণমুক্তির সংগ্রামে সামিল হওয়ার  উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে কবিগুরুর ভাষায় বলব

‘‘ নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস

শান্তির ললিতবাণী শুণাইবে ব্যর্থ পরিহাস৷

বিদায় নেবার আগে তাই ডাক দিয়ে যাই

দানবের সাথে সংগ্রামের তরে

প্রস্তুত হতেছে যারা ঘরে ঘরে৷ ’’