সর্বস্তরে শিক্ষার আলো--- এই হোক সাক্ষরতা দিবসের তাৎপর্য

লেখক
স্নেহময় দত্ত

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এমন কিছু  কিছু দিন রয়েছে যে দিনগুলিকে বিশেষ কিছু বিষয়কে কেন্দ্র করে উৎসর্গ করা হয়েছে৷ যেমন আন্তর্জাতিক নারী দিবস, শ্রমিক দিবস, বিশ্ব আবহাওয়া দিবস, বিশ্বস্বাস্থ্য দিবস, বিশ্ব পরিবেশ দিবস, রয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বিশ্ব পুস্তক শান্তি দিবস, কবিতা, নাট্য, সঙ্গীত, নৃত্য দিবস, বিশ্ব মানবতা দিবস, বিশ্ব শান্তি ইত্যাদি নানা দিবস৷ তেমনই একটি দিন ৮ই সেপ্ঢেম্বর দিনটি ---আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস৷

এই যে বিশেষ দিনগুলি, যেগুলিকে নির্দিষ্ট কোন দিবসরূপে উৎসর্গ করা হয়েছে তার উদ্দেশ্যে হল সেই সেই নির্দিষ্ট বিষয় গুরুত্বসহকারে অনুধাবন---সমস্যা থাকলে তার সমাধানের উপায় অবলম্বন৷ কিন্তু সাধারণতঃ দেখা যায়, এই বিশেষ দিনগুলি নিছকই অনুষ্ঠানমূলক হয়ে থাকে৷ বিশেষ রূপে নির্দিষ্ট ওইদিনে পদযাত্রা শোভাযাত্রা, সভা-সমাবেশ, নেতৃবৃন্দের বা সেলিব্রেটিদের ভাষণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে উদ্যাপন করা ছাড়া আর  অন্য কোন তাৎপর্য থাকে না৷

সাক্ষরতার সঙ্গে সম্পর্কিত শিক্ষা৷ এই একবিংশ শতাব্দিতে  বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নানা বিষয়ে এগিয়ে চলেছে, বিজ্ঞান ও  প্রযুক্তির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে,  আরও  উন্নতি বিধানের প্রয়াসে সতত সচেষ্ট রয়েছে৷ স্বাভাবিক ভাবে শিক্ষারও প্রসার ঘটেছে৷ তথাপি এ কথা অনস্বীকার্য যে শিক্ষার আলো সর্বস্তরে পৌঁছোয় নি৷ এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের এখন অনেক অনুন্নত দেশ আছে যে সমস্ত স্থানে শিক্ষার আলো এখনও অনেক দূরস্ত্৷ দারিদ্র্য যেসব দেশে চরমে, যেখানকার অধিকাংশ মানুষকে  বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়, তাদের কাছে শিক্ষার আলো অলীক কল্পনা৷  উন্নয়নশীল দেশ ভারত স্বাধীনতার পর বিভিন্নক্ষেত্রে  উন্নতির  উচ্চ শিখরে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে,  স্বাধীনতার ৭০ বছরে শিক্ষিতের হারও বেড়েছে, তবুও নিরক্ষর মানুষের বা অশিক্ষিতের সংখ্যা  এমনই পর্র্যয়ে  যা দেশের কাছে অভিশাপ স্বরূপ --- বিশ্বের দরবারে লজ্জাস্কর৷ ভারতের  একশ্রেণীর মানুষের অগাধ প্রাচুর্য, অপরদিকে আর এক শ্রেণীর দারিদ্র্য চরমে৷ ক্ষুধায় যাদের অন্ন জোটে না, মাথা গোঁজার যাদের ঠাঁই নেই, শিক্ষার কথা চিন্তা করার তাদের  আর অবকাশ কোথায়৷ অনাহারে  অবহলায় অনাদরে যেসব শিশুরা কোনক্রমে বেড়ে ওঠে, শিক্ষার আঙিনায় প্রবেশকালেই জীবনধারণের জন্যে শ্রম বেচে তাদের অর্থউপার্জনের  পথে যেতে হয়৷ ভারতের মত উন্নয়নশীল অনেক দেশের ও তৃতীয় বিশ্বের  অনুন্নত দেশসমূহের প্রায় সবর্ত্রই হাল হকিকৎ একই ধবণের৷

আন্তর্র্জতিক সাক্ষরতা দিবস দিনটি সমগ্র  বিশ্বজুড়েই কমবেশি পালিত হবে ৷ নিরক্ষরতা দূরীকরণ, শিক্ষার প্রসার নিয়ে নানান চর্র্চ হবে৷  সম্ভবত অনেক অঙ্গীকার থাকবে৷  আমাদের দেশে হয়তো বা শোণা যাবে ‘বেটি পড়াও’ শিক্ষায় ‘সবকা বিকাশ’ ইত্যাদি! কিন্তু প্রকৃত পক্ষে হচ্ছেটা কী?

আমাদের দেশে ‘নিরক্ষরতা  দূরীকরণ’ আবার ইদানিং ‘বেটি পড়াও’-এর জনমোহিনী প্রচার গ্রামে-গঞ্জে ব্যাপক ভাবে দেখা যায়৷  কিন্তু দারিদ্র্য সীমার নীচে বা আশ্রয়হীনভাবে থাকা নিরক্ষর এই মানুষদের কাছে এই প্রচার কতটা মূল্যবহ হয়েছে? তাদের নিরক্ষরতা দূর  করতে বা তাদের শিশুদের তা সে মেয়েই হোক বা ছেলেই হোক শিক্ষার আলোয় আনতে  সরকার কতটা প্রয়াসী?

রাজনীতির যারা কারবারী, (জনকল্যাণে যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁদের কথা বলছি না) যারা কায়েমী স্বার্থের ধারক ও বাহক, তারা কোন সময়ই  চায় না সর্বস্তরের মানুষেদের মধ্যে শিক্ষার বিকাশ হোক৷ প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল যে অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া বা  নিজ নাম সাক্ষর করতে  জানাটাই যে শিক্ষার বিকাশ বা চেতনার উন্মেষ তা কিন্তু নয়৷ কায়েমী স্বার্থ নিয়ে যারা রাজনীতি করে তারা জনসাধারণের  অজ্ঞতাকেই হাতিয়ার করে  চলতে চায়৷ বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এটা ব্যাপকভাবে দেখা যায়৷ মনমোহিনী কথার বাক্য জালে অজ্ঞ মানুষকে বোকা বানিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে থাকে--- পার হতে চায় নির্র্বচনী বৈতরণী৷ তাই তারা চায়না যে জনসাধারণের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার বিস্তার হোক৷  তেমনই চায়না শোষক শ্রেণীও৷ কারণ শিক্ষার বিকাশ ঘটলে শোষক শ্রেণীার বিরুদ্ধে মানুষ রুখে দাঁড়াবে৷ তাই এই একবিংশ শতাব্দিতেও অনুন্নত দেশসমুহে, এমন কী ভারতের  মত উন্নয়নশীল দেশেও শিক্ষার আলো সর্বস্তরে  পৌঁছায় নি৷

আবার ধর্মমতের যারা কারবারী,তারাও একধরণের কায়েমী স্বার্থের ধারক ও বাহক৷ তারাও চায় মানুষের মধ্যে অজ্ঞতা থাকুক৷ কারণ তা না হলে তাদের কারবার নষ্ট হয়ে যাবে৷ ধর্মমতের কারবারীরা, তা সে যে কোন সম্প্রদায়রই হোক না কেন, নানা অন্ধকার কুসংস্কার , বিধি নিষেধের বেড়াজাল দিয়ে মানুষকে আচ্ছন্ন করে তাদের কাছ থেকে অতি সহজ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে থাকে৷ ধর্মমতের সম্প্রদায়ের জিগির তুলে মানুষে মানুষে বিদ্বেষের সৃষ্টি করে থাকে৷ বিনষ্ট করে মানুষ জাতের সংহতি৷  শিক্ষার অভাবেই মানুষ ওইসব ধর্মমতের কারবারীদের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে৷ এ প্রসঙ্গে মনে রাখা উচিত যে ‘ধর্মমত’ আর ‘ধর্ম’ কিন্তু এক নয়৷ প্রকৃত ধর্ম বলতে  বৃহতের প্রতি সৃষ্টিকর্র্তর প্রতি আকর্ষণকে বোঝায় যা হল অধ্যাত্ম বিজ্ঞান৷  আর ধর্ম সকল মানুষেরই  এক--- সেখানে কোনরকম জাত-পাতের বিভেদ -বৈষম্যের প্রশ্ণের লেশমাত্র নেই, থাকতে পারে না৷ যাঁরা প্রকৃত অধ্যাত্মপিপাসু, সাধক, মহাযোগী, তারা সকলেই সেই অধ্যাত্মবিজ্ঞাােনর কথা---প্রকৃত ধর্মের কথাই বলে গেছেন৷ 

আজ সেখানে  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির  ব্যাপক উন্নতি  ঘটেছে , মানুষ  মহাকাশে পাড়ি জমাচ্ছে, অন্যগ্রহে যাবার  চিন্তা করছে, আজ যখন ব্যাপক ডিজিটালাইজেশনের যুগ, তখন  কেবলমাত্র শিক্ষার অভাবে অজ্ঞতায় মানুষকে কিছু কায়েমী স্বার্থের ধারক ধর্মমতের কারবারীদের শোষণের শিকার হতে হচ্ছে৷ এটা সম্ভবত ভারতেই প্রবল মাত্রায় বিদ্যমান৷ ধর্মের প্রকৃত অর্থ না জানা থাকায় তথা অধ্যাত্ম জ্ঞানের অভাবে ধর্মমতে অন্ধ বিশ্বাস ও ধর্মমতের ধবজাধারীদের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি তথা মান্যতার কারণে মানুষ যে ধর্মের নামে কতরকমভাবে অত্যাচারিত হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই৷ অর্থদন্ড তো যাচ্ছেই, ভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাতে গিয়ে ধর্মমতের ধবজাধারীদের কামনা-লালসার শিকার পর্যন্ত হতে হচ্ছে সরলমানা নারীদের৷ ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের নামে নৃশংস ভাবে অত্যাচার করা হচ্ছে শিশুদেরও৷

আর এক শ্রেণীর মধ্যে কত সহজে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো হয়ে থাকে কেবলমাত্র একটি শব্দের তিনবার প্রয়োগে , তা সে কাণের কাছে সরাসরি উচ্চারণে বা দূরভাষ যন্ত্রের  (টেলিফোনে) মাধ্যমে উচ্চারণেই হোক অথবা পত্রদ্বারা লিখিতভাবে বা হোয়াটস্যাপের মাধ্যমেই হোক ৷ কত বড় অমানবিক, সামজিক, অবিচার নারীদের  প্রতি৷ এই সম্প্রদায়ের ধারক বাহকেরা চায় না তাদের সম্প্রদায়ে বিশেষ করে  নারীদের মধ্যে শিক্ষার বিকাশ ঘটুক৷ শুধু নারী কেন তাদের পুরুষদের মধ্যেও প্রকৃত শিক্ষার আলো প্রবেশ করুক ওই সম্প্রদায়ের কায়েমী স্বার্থের ধবজাধারীরা চায় না৷ কারণ প্রকৃত শিক্ষার বিকাশ ঘটলে কায়েমী স্বার্থবাহীদের মানুষ ঠকানোর সব রকম জারিজুরি বিভেদ সৃষ্টির তত্ত্ব যে আর আর খাটবে না, তা তারা ভাল করেই জানে৷ বলা বাহুল্য এই অমানবিক তিন তালাক প্রথার চল ভারতেই৷ দ্বিজাতিতত্ব ও সাম্প্রদায়িকতার  ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানেও এই প্রথা বাতিল হয়েছে সেই ১৯৬১-৬২ সালেই  আয়ুব খানের আমলে৷ অধিকাংশ মুসলিম প্রধান দেশেই তিন তালাক প্রথা নেই৷ এমন কী ইরাক, ইরানের মত শিয়া সম্প্রদায় প্রধান দেশেও এই প্রথা বাতিল৷

আলেচনার প্রসঙ্গ যেহেতু মানুষের অজ্ঞতা  অশিক্ষা, তখন উল্লেখ করা যেতে পারে ‘প্রাউট’ দর্শনের প্রবক্তা দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের কয়েকটি কথা, যা খুবই প্রাসঙ্গিক৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘সামাজিক, আর্থিক, মানসিক, তথা আধ্যাত্মিক  প্রতিটি ক্ষেত্রেই  মানুষের  অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে কায়েমী স্বার্থবাদীদের দল রীতিমত শেকড় গেঁড়ে জেঁকে বসেছে৷  তারা বাকীদের প্রাণশক্তির সবটুকু নিঃশেষে শুষে নিতে চায়৷ তাই অজ্ঞ পাক জ্ঞানালোক, ছোট জাত উঠুক ওপরে,  বুভুক্ষু পেট ভরে খেতে পাক, কুসংস্কারাচ্ছেন্নের কুসংস্কার দূর হোক,  আর অধ্যাত্ম-জ্ঞান ও বিজ্ঞান ঠিকভাবে জেনে নিয়ে সবাই সে রাজ্যে এগিয়ে চলার সমান সুযোগ পা’ক---কায়েমী স্বার্থবাদীরা তা চাইতে পারে না৷

৮ই সেপ্ঢেম্বর দিনটি আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসরূপে প্রতিবছর পালিত হয়ে আসছে৷ সাক্ষরতা অভিযান ভারতসহ বিভিন্ন দেশে চলছে--- সাক্ষরও হচ্ছে৷ কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সর্বস্তরে শিক্ষার বিকাশ ঘটছে৷ শিক্ষার সম্পর্কে ‘প্রাউট’ দর্শন প্রবক্তা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের কথা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য৷ তাঁর কথায়, ‘‘যে বেশী শিখেছে, বেশী মনে রেখেছে ও সেগুলি বৈবাহারিক জীবনে প্রয়োগ করেছে তাকেই বলব শিক্ষিত আর তার গুণগুলোর নাম দেব শিক্ষা৷’’ সে অর্থে শিক্ষার বিকাশ যে ঘটেনি তা  বলাই বাহুল্য৷ কারণ তথাকথিত যারা শিক্ষিত  বৈবহারিক ক্ষেত্রে তার যথাযথ প্রয়োগ করে না৷  তা করলে কায়েমী স্বার্থবাদীদের কোনক্ষেত্রেই যে এই ভাবে বাড় বাড়ন্ত হতে পারত না তা বোধকরি নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে৷

সাক্ষরতা দিবস নিছক যেন আনুষ্ঠানিক না হয়৷ এই দিবসের প্রকৃত তাৎপর্য নিহিত রয়েছে সর্বস্তরে প্রকৃত শিক্ষার বিকাশের মধ্যে৷ গুরুত্ব দিতে হবে সর্বস্তরের সকল মানুষকে  প্রকৃত শিক্ষার আলোয় আনার বিষয়৷ প্রকৃত শিক্ষার আলো পেলে মানুষের মধ্যে উন্মেষ ঘটবে  চেতনার৷ প্রসঙ্গত শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের কথায় বলতে হয় ‘‘ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সামাজিক মানসিক আর্থিক  তথা  আধ্যাত্মিক প্রতিটি ভূমিতেই মানুষকে তার অধিকার  সচেতন করে দেওয়ার নামই জ্ঞানবিস্তার করা , আর  এই অধিকারের পূর্ণ প্রয়োগের নামই বিজ্ঞান সাধনা৷  যে অবহেলিত মানব যে কোনো কারণেই হোক জ্ঞান বিজ্ঞান  থেকে দূরে রয়েছে তাদের সেই সুযোগ ষোল আনা দিতে দিতে হবে৷’’

প্রকৃত শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত চেতনা সম্পন্ন মানুষই পারবে সর্বপ্রকার শোষণ-ভন্ডামীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে--- পারবে ধর্মমতের ধবজাধারীদের তথা কায়েমী স্বার্থের ধারক বাহকদের মুখোশ খুলে দিতে৷ মানুষের সমাজে প্রকৃত শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে, অজ্ঞতা দূর করতে, চেতনার উন্মেষ ঘটাতে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষকে৷ সর্বস্তরে  শিক্ষার আলো--- এই হোক সাক্ষরতা  দিবসের তাৎপর্য৷