নীলাকাশে ভেসে চলা ফালি ফালি মেঘের সারি, মাঝে মধ্যে এক পশলা বৃষ্টি, কখনো মেঘ রোদ্দুরের লুকোচুরি,বাতাসে শিউলির গন্ধ, মাঠে-ঘাটে কাশফুলের দোলা, গাছের পাতায়, ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশিরে নব রবিকিরণের হীরকদ্যুতি ঘোষণা করে প্রকৃতির র৷মঞ্চে নব শরতের উপস্থিতি৷ শরতের ছোঁয়ায় বাঙালীর মন হয় উদ্বেলিত, নব আনন্দে শিহরিত৷ বাঙলা ও বাঙালীর জীবনের সঙ্গে শরতের রয়েছে এক চিরায়ত অচ্ছেদ্য সম্পর্ক৷ এই শরতেই বাঙলার সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব শারদোৎসব পালিত হয়৷ দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির চরম পর্যায়ে হর্র্ষেৎফুল্ল বিস্ফোরণ ঘটে এই শারোদৎসবের দিনগুলিতে৷ আপামর বাঙালী মাতৃবন্দনার সাধ্যমত আয়োজন করতে নতুন উদ্যমে ও উন্মাদনায় মেতে ওঠে৷ বহু দিনের পরিশ্রমে গড়ে তোলা অপূর্ব শিল্প সুষমামণ্ডিত কারুকার্যখচিত বিশাল বিশাল আলোকমালা শোভিত মণ্ডপে চলে দেবী আরাধনার আয়োজন৷ দক্ষ মৃৎশিল্পীর সুনিপুন হস্তকর্মে নির্মিত মূর্ত্তিগুলিও অপূর্ব শৈল্পিক উৎকর্ষের নিদর্শন রূপে স্বীকৃত৷ এর সঙ্গে যুক্ত হয় শুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণে মনোমুগ্দকর ভক্তিপূর্ণ পরিবেশে নববস্ত্র পরিহিত মানুষের মহা মিলনমেলা৷ শারদোৎসবের দিনগুলিতে মানুষ দৈনন্দিন জীবনের গ্লানিকে দূরে সরিয়ে রেখে উৎসবের আনন্দে মেতে থাকে৷ বিদেশ-বিভূঁইয়ে যারা বিভিন্ন কারণে বসবাসে বাধ্য হন তারা এই সময় পরিবারে ফিরে এসে উৎসবে সামিল হয়ে মিলনের আনন্দকে বাড়িয়ে তোলে৷
ব৷ সংসৃকতিতে এই শারদোৎসবের গুরুত্ব অপরিমেয়৷ একদিকে সাহিত্য-শিল্পকলা, অন্যদিকে সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিসরে শারদোৎসবের অবদান অনস্বীকার্য৷ শারদোৎসবকে কেন্দ্র করে সাহিত্য সৃষ্টির এক বিশাল ক্ষেত্র উন্মোচিত হয় বিভিন্ন শারদীয়া সংখ্যা, স্মরণিকা ও নূতন নূতন কবিতা, গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি প্রকাশের মাধ্যমে৷ হাজারে হাজারে বিশাল মণ্ডপে বাঁশ, কাঠ, পাট ও নানাবিধ উপকরণে মৌলিক শিল্পকর্ম দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় নয়নাভিরাম দৃশ্যপটের সৃষ্টি করে৷ মণ্ডপে মণ্ডপে শোলার সূক্ষ্ম শিল্পকলার অপূর্ব সমাহার আমাদের অবাক করে দেয়৷ এর সঙ্গে রয়েছে আলোক শিল্প ও মৃত্তিকা শিল্পের অভিনব আঙ্গিক ও ভঙ্গিমার প্রদর্শনী৷ সব মিলিয়ে শিল্প-বৈচিত্র্যের এক বিপুল আয়োজন৷ আর এই ব্যাপক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে লক্ষ লক্ষ মানুষের রুজি-রোজগার৷ শারদোৎসব উপলক্ষ্যে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই নূতন নূতন জামাকাপড়, জুতা, প্রসাধনী দ্রব্য সাধ্যমত ক্রয় করে৷ তাই ওই সব বস্তুর বেচাকেনার ক্ষেত্রে এক বিশাল বাজার উন্মুক্ত হয় ও ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়৷ এই কারণে সামাজিক, শৈল্পিক, অর্থনৈতিক, কর্মসংস্থান---সমস্ত দিক দিয়েই বাঙালীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে এই শারদোৎসব৷
দেবী বন্দনার দিনগুলিতে মানুষের মনে ভক্তিরসের সঞ্চার হয় ও সকলেই সব ভেদ ভাবনা, অতীতের মন কষাকষি ভুলে আনন্দে বিভোর থাকে৷ যদিও এই ভক্তিভাবের সঙ্গে প্রকৃত আধ্যাত্মিকতার কোন যোগ নেই৷ কারণ আধ্যাত্মিকতা কয়েক দিনের বিষয় নয়, নিরন্তর অনুশীলনের দ্বারাই আধ্যাত্মিক চেতনায় প্রতিষ্ঠিত হতে হয়৷ দীর্ঘকাল ধরে বৃহতের ভাবনায় নিমজ্জিত থেকে নিয়মিত অভ্যাস ও অধ্যবসায়ের ফলেই মানুষের মন একাগ্র হতে পারে৷ নীতিবাদ ও সত্যের প্রতি একনিষ্ঠ থেকে সাধনা, সেবা ও ত্যাাগের মাধ্যমে একাগ্র মনকে পরমপুরুষের প্রতি পরিচালিত করাই প্রকৃত আধ্যাত্মিকতার লক্ষ্য৷ এর মধ্যে চাওয়া-পাওয়া বা বাহ্যিক উপাচারের কোনো স্থান নেই৷
শারদোৎসবের অ৷ হিসেবে মাতৃবন্দনার মধ্য দিয়ে মানুষ নারী শক্তির উদ্বোধন ও নারী জাতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনে প্রয়াসী হয়৷ যদিও বাস্তব ক্ষেত্রে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এর প্রতিফলন দেখা যায় না৷ প্রায় প্রতিদিনই সংবাদ মাধ্যম গুলিতে বিভিন্ন কারণে নারীদের ওপর অত্যাচার, লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের সংবাদ পরিবেশিত হয়৷ বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পণ বা যৌতুক বা শ্বশুরালয়ের নানাবিধ দাবীর ফলে বহু মহিলা লাঞ্ছনা, গঞ্জণা এমনকি মৃত্যু বা খুনেরও শিকার হন৷ পথে-ঘাটে অশালীন আচরণ ও নির্যাতনের সম্মুখীন হন৷ আর এর প্রতিবাদকালে অ্যাসিড হামলা বা ছুরি জাতীয় অস্ত্রের আঘাত নেমে আসে৷ আবার কখনো কখনো এই সব ঘটনার প্রতিবাদীদের মারাত্মক পরিণাম বা মৃত্যু পর্যন্ত হয়৷ এক শ্রেণীর নরাধম লোভ লালসা, কামনা-বাসনার তাড়নায় নারী সমাজের সঙ্গে পাশবিক আচরণ করে---তাদের জান্তব ব্যভিচারের হাত থেকে শিশু-বৃদ্ধা কারো নিস্তার নেই৷ হিংসার নিষ্ঠুরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে শিশুর শরীরে সুঁচ ফুটিয়ে বা চোখে অ্যাসিড ইনজেকশন করে হত্যা করতেও পিশাচেরা পিছপা হচ্ছে না৷ অবশ্য হিংসা প্রদর্শনে মহিলাগণও পিছিয়ে নেই৷ বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের জেরে তথাকথিত প্রেমিকের যোগসাজসে স্বামীকে হত্যা করার ঘটনাও ইতোমধ্যে সংবাদের শিরোণামে এসেছে৷ এইসব মানবদেহধারী পশুদের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে নচেৎ মানব সমাজকে দ্রুত পচনের হাত থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে৷ অন্যদিকে প্রতিটি মানুষকে আধ্যাত্মিক শিক্ষার মাধ্যমে প্রত্যেকের মানবিক সুপ্রবৃত্তিগুলির উন্মেষ ঘটাতে হবে৷ মনই হচ্ছে সু ও কু উভয়েরই ধারক ও পালক৷ সু-এর দিকে যদি মনকে প্রধাবিত করা না হয় তবে সে অশুভের দিকে চলে যাবে৷ তাই অনবরত শুভ চিন্তা ও ম৷ল ভাবনার প্রতি মনকে অবশ্যই টেনে আনতে হবে৷ সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের মাত্রার সাপেক্ষে শাস্তির জন্যে আইন-কানুন সঠিকভাবে প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতেই হবে৷
পরিশেষে আর একটি বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা প্রয়োজন৷ শারদোৎসবের আনন্দের সঙ্গে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের ক্রিয়াকলাপে সমাজের বুকে কিছু খারাপ দিকও নেমে আসে৷ বাজি ও বাজনার মাত্রাতিরিক্ত শব্দের তাণ্ডবে বহু মানুষের বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে---এমনকি প্রাণহানির আশঙ্কাও দেখা দেয়৷ এছাড়া প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রায় মাদকাসক্ত কিছু ব্যষ্টির কুরুচিকর অশালীন নৃত্য, অ৷ভঙ্গি বা আচরণ পরিলক্ষিত হয় যা সভ্য সমাজে কোনওভাবেই চলতে দেওয়া উচিত নয়৷ বিকৃত আনন্দের আতিশয্যে বিষাদের ছায়াকে আহ্বান কিছুতেই কাম্য নয়৷ এর বিরুদ্ধে প্রশাসন ও উৎসব উদ্যোক্তাদের সজাগ, সচেতন ও সতর্ক দৃষ্টি রেখে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে৷ এছাড়া শারদোৎসবের বর্ণময় উদ্যাপনে যে বিপুল অর্থব্যয় হয় তার ১৫-২০ শতাংশ যদি বিশাল বিশাল মণ্ডপের পেছনে অন্ধকারে রাজপথে বসবাস করা দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ব্যয়িত হয় তবে সমাজের এই অন্ধকারাচ্ছন্ন অংশ খুশী ও আনন্দের আলোকে উদ্ভাসিত হতে পারে৷ এই বিষয়েও বিভিন্ন পূজা উদ্যোক্তাগণের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন৷
শরতের আঙ্গিনায় মানুষের মিলনমেলায় প্রকৃত আধ্যাত্মিক চেতনায় দীপ্ত সত্য, শিব ও সুন্দরের পথে মানুষের শারদোৎসব উদ্যাপন সার্থক হয়ে উঠুক---প্রতিটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের এটিই আন্তরিক কামনা ও প্রার্থনা৷
- Log in to post comments