শুভ ১৫ই আগষ্টের স্মরণীয় দিনে ঋষি অরবিন্দকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন

লেখক
প্রভাত খাঁ

অতীতের সেই স্বর্ণগর্ভা বাঙলার বুকে এমন  এক মহান ব্যষ্টিত্বের জন্ম হয়েছিল যিনি বিশ্বের বুকে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন৷ তঁদের জন্যে এই বাঙলাও নিজেকে ধন্য মনে করে৷ তেমনই এক মহাসাধক, মহাজ্ঞানী, মহান বিপ্লবী হলেন ঋষি অরবিন্দ ঘোষ৷ তিনি জন্মগ্রহণ করেন হুগলী জেলার উত্তরপাড়ায় ১৮৭২ সালের ১৫ই আগষ্ট৷ তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক রাজনৈতিক নেতা ও যোগী৷ তাঁর পিতার নাম ডাঃ কৃষ্ণমোহন ঘোষ৷ তাঁর পিতা চাইতেন তিনি উচ্চ সরকারী বিভাগে চাকুরী করে জীবন নির্বাহ করুন৷ সেই কারণে তিনি তাঁকে ইংল্যাণ্ডে আই.সি.এস. পাশ করার জন্যে পাঠিয়েছিলেন৷ আই.সি.এসের লিখিত পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হন, কিন্তু বিদেশী রাজশক্তির চাকুরীতে তাঁর কোন আকাঙ্ক্ষা ছিল না৷ তাই ঘোড়ায় চড়ার পরীক্ষায় তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে অনুত্তীর্ণ হন৷ তিনি এরপর দেশে ফিরে এসে মহারাষ্ট্রের বরোদার মহারাজার ইষ্টেটে চাকুরী গ্রহণ করেন৷ সেখানে ঠাকুর সাহেবের কাছে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হন৷ তাছাড়া যোগের প্রতি তাঁর দারুণ আকর্ষণ থাকায় তিনি মহাযোগী বিষ্ণু ভাস্কর লেলের নিকট যোগশিক্ষার পাঠ নেন৷

সেই সময় বাঙলায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার ওঠে তাতে যোগ দিতে বাঙলায় চলে আসেন৷ কলকাতাকে কেন্দ্র করে তিনি দেশমাতৃকার মুক্তি আন্দোলনের কর্মকাণ্ড শুরু করেন৷ তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর অগ্ণিগর্ভ লেখার মাধ্যমে দেশের তরুণ-তরুণীদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন৷ তাঁর নেতৃত্বে সারা বাঙলা জুড়ে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়ে যায়৷ ব্রিটিশ সরকার তখন তাঁকে ও তাঁর ভাই বারীন্দ্র ঘোষকে মাণিকতলায় বোমা মামলা জড়িয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করে৷ সেই বোমার মামলায় তাঁর পক্ষে ওকালতি করেন বিখ্যাত আইনজ্ঞ ও ঐতিহাসিক পুরুষ চিত্তরঞ্জন দাশ মহাশয়৷ এই ঐতিহাসিক মামলায় শ্রী অরবিন্দ নির্দোষ প্রমাণিত হন ও কারাগার থেকে মুক্তি পান৷ তার নির্দোষ প্রমাণে ইংরেজ সরকার মোটেই সন্তুষ্ট ছিল না৷ তাই তারা তাঁকে পুনরায় কারাগারে আটক করার ফন্দী আঁটে৷ সেই অরবিন্দ কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ভগিনী নিবেদিতার সহায়তায় ফরাসী উপনিবেশ  হুগলী জেলার চন্দ্রনগরে (চন্দননগরে) গোপনে চলে যান৷ এই চন্দ্রনগরে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে গোপনে কিছুদিন বাস করেন৷ স্মরণ রাখা দরকার যে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে প্রায় সবসময় সাধনায় মগ্ণ থাকতেন ও এখানেই তিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেন৷ চন্দ্রনগর থেকে শ্রীরবিন্দ চলে গেলেন পণ্ডীচেরীতে (বর্তমানে নাম পদুচেরী)৷

আধ্যাত্মিক সাধনার উদ্দেশ্যে তিনি এখানে একটি আশ্রম তৈরী করেন৷ এই আশ্রম নির্মাণে  তিনি একজন বিখ্যাত ফরাসী আধ্যাত্মিক সাধিকা মাদাম অল রিশার সাহচর্য পান৷ যিনি ‘শ্রী মা’ নামে বিখ্যাত হন৷ শ্রীরবিন্দ এখানে আধ্যাত্মিক সাধনায় ডুবে যান৷ তিনি এখানে তাঁর অনুগামীদের খুব কমই দর্শন দিতেন৷ কিন্তু এখানেও  তিনি লেখার কাজ চালিয়ে যেতেন৷ তাঁর লিখিত পুস্তকগুলির মধ্যে বিধ্যাত হ’ল‘Lights of Yoga’ ও‘The Life Divine’৷  ঋষি অরবিন্দের বিখ্যাত কবিতা হ’লThe mother’৷

তিনি ঘোষণা করেন যে তাঁর জন্মদিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে এক স্মরণীয় ঘটনার জন্যে৷ তা-ই হ’ল৷ তাঁর জন্মদিন ১৫ই আগষ্টে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ সালে৷ এই মহান যোগী ও বিপ্লবী ১৯৫০ সালের ৫ই নবেম্বর তাঁর নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন৷ তিনি উপলব্ধি করেন যে, মানব শরীরে আধ্যাত্মিক উপলব্ধি অত্যাবশ্যক৷ তাই মানুষকে সে দেশেই হোক না কেন তাকে যোগাভ্যাসের মধ্য দিয়ে সচ্চিদানন্দ সত্তার উপলব্ধি করতেই হবে৷ জীবনের এটাই হ’ল চরম লক্ষ্য৷ তিনি সমগ্র বিশ্বের কল্যাণে ভূমা আধ্যাত্মিক ভাব তরঙ্গের  অবতরণ হওয়ার কথা ঘোষণা করেন৷ যাঁকে তিনি বলতেন সুপ্রা মেণ্টাল পাওয়ার৷ তিনি বলতেন,মানুষের মনে যত জড়াত্মক ভাবনা চিন্তার প্রাবল্য ঘটবে ততই অকল্যাণ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে ও জগতের ক্ষতি হবে৷ পরবর্তীকালে যে বিশ্বকল্যাণে মহাসম্ভূতির আবির্ভাব হবে সেকথাও তিনি আকারে-ইঙ্গিতে প্রকাশ করে গেছে৷ কথায় আছে‘coming events cast the sadows first.’'

 

 কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মহান দার্শনিক ও দেশপ্রেমিককে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন  এই বলে ‘অরবিন্দ রবীন্দ্রের লহ নমস্কার৷’

ভারতবর্ষের ইতিহাসে ঊণবিংশ ও বিংশ শতাদ্বীতে যে নবজাগরণ দেখা গিয়েছিল ঋষি অরবিন্দ ছিলেন তার অন্যতম অগ্রদূত৷ তাই তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি এই বলে --- ‘‘হে মহান ঋষি তোমার আশীর্বাদ বর্ষণ কর এই বিশ্বের বুকে যাতে জগতের সার্বিক কল্যাণ সুচিত হয়, বিশ্বের সকল মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেই আনন্দলোকের প্রশান্তি লাভ করে ও আদর্শ সমাজ রচনা করতে পারে’’৷