সুসন্তুলিত উন্নয়ন

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

মানুষের অস্তিত্ব ত্রিস্তরীয়---শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক৷ মানুষের উন্নতি মানে এই ত্রিস্তরীয় সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নতি৷ এই সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নতি যদি না থাকে তাহলে উন্নতির পরিবর্তে অবনতি হবে৷ বর্তমানে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির হাত ধরে বা আধুনিকতার ছাপ মেরে যে বিপুল উন্নতির বড়াই আমরা করি এই তথাকথিত উন্নতি যে অনেক জটিল প্রশ্ণের সম্মুখে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, তা আজ কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না৷ তার কারণ একটাই৷

বাড়ী, গাড়ী, রাস্তা-ঘাট, পোষাক-পরিচ্ছদ, নানান্ সুস্বাদু খাওয়া-দাওয়া এসবের জাঁকজমকের পাশাপাশি দুর্নীতি, যৌন কেলেঙ্কারী, মানবিকতার অভাব, শোষণ, খুন-জখম এসবও যে মহামারীর মত ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে তা আমরা নিশ্চয়ই প্রত্যক্ষ করছি৷ এই জন্যেই বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ, আমরা উন্নতির সোপান বেয়ে ওপরের দিকে উঠছি না, অধঃপতনের ঢালু পথ বেযে ক্রমশঃ গড়িয়ে নীচের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছি---এই নিয়ে প্রশ্ণ উঠছে৷

একদিকে সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ কোটি কোটি টাকা বিলাস-ব্যসনে অহরহই উড়িয়ে চলেছে, অন্যদিকে এখনও ফুটপাতের বস্তিতে-গ্রামাঞ্চলে নিরন্ন মানুষের হাহাকার, কোনরকমে দিনের পর দিন ইঁদুর খেয়ে জীবনধারণ (সদ্য উত্তরপ্রদেশের খবর)---এসব কী প্রগতির পরিচয়? একদিকে দেশের পুঁজিপতি, মন্ত্রী আর আমলাদের আর বিভিন্ন অফিসের উচ্চ পদাধিধারীদের বিপুল আয়বৃদ্ধি ঘটছে, আর অন্যদিকে দেশের কোটি কোটি বেকারের ও ছোট-খাট কাজকারবার করে’ যারা কোনও রকমে জীবিকা নির্বাহ করছে তাদের অভাবও বেড়ে চলেছে৷

বৃদ্ধ মা-বাবার ওপর অত্যাচার-অবিচারের করুণ কাহিনীও প্রায়ই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে৷ পণপ্রথাকে কেন্দ্র করে বধূর ওপর অত্যাচার, বধূহত্যা বা বধূকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা---এই ধরণের ঘটনাও আকছার ঘটছে৷ যৌন নির্যাতনের খবর তো কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার ভিত্কে কাঁপিয়ে দিয়েছে, ‘মী-টু’ আন্দোলনের আস্ফালনও নিস্ফল হয়ে চলেছে৷ দিল্লির নির্ভয়ার মৃত্যুর পর থেকে কত যে মোমবাতির মিছিল হ’ল, এ নিয়ে কত সেমিনার, কত প্রতিবাদ মিছিল হ’ল---কিন্তু এসব কমছে কই? ক্রমশঃই তো বাড়ছে৷ স্কুল-শিক্ষকরাও পর্যন্ত বাচ্চা বাচ্চা শিশুর ওপর যৌন নির্যাতন করছে৷ এ তো দেখা যাচ্ছে ক্যানসারের মত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে৷

একে আধুনিকতা বলবেন? এবার কলকাতায় দুর্গোৎসবে দেখা গেল আধুনিকতার নামে অভিজাত পরিবারের জিন্স পরা মেয়েদের অনেককে দল বেঁধে প্রকাশ্যে সিগারেট খেতে খেতে স্টাইল করে গল্প করতে করতে চলেছে৷ অথচ একজন ছেলেকেও প্রকাশ্যে এইভাবে সিগারেট খাওয়াটা এদিন কিন্তু চোখে পড়ল না৷ তবে কি ওই মেয়েরা ইচ্ছে করেই সবাইকে দেখাতে দেখাতে সিগারেট ধরিয়ে সদর্পে ঘোষণা করতে চাইছে, ‘‘আমরা সেকেলে নই, আমরা আধুনিক যুগের মেয়ে৷ আমরা সমাজের শাসন মানি না৷ আমরা যা ভাল বুঝবো তাই করব৷’’ বাঙলার কৃষ্টি-সংস্কৃতি তাদের কাছে সেকেলে, মার্কিন কালচারটাই আধুনিক৷ জ্ঞান-বিজ্ঞান-যুক্তি কী বলে? ধূমপান কি মানব শরীরের পক্ষে হিতকর? বিশেষ করে মেয়েদের পক্ষে তো অত্যন্ত অহিতকর৷ কারণ তারা ভাবী জননী, তারা ‘মায়ের জাত’, ভাবী সন্তানের পক্ষেও এটা খারাপ৷ আধুনিকতা কী বলছে? বিজ্ঞানও মানবে না?

আসল সমস্যাটা কোথায়? সব সমস্যারই মূলীভূত কারণ হ’ল---যা আগেই বলেছি, আমরা আমাদের ত্রিস্তরীয় অস্তিত্বের কথা ভুলে গেছি৷ আমরা কেবল দেহ নই, আমাদের একটা জটিল মন আছে, আর মনের পেছনে আত্মা আছে৷

আমরা বিজ্ঞান বলতে কেবল জড়বস্তু সম্পর্কিত বিজ্ঞানটাকেই সব কিছু বুঝি৷ এটাই ভুল৷ বিজ্ঞান হচ্ছে বিশেষ জ্ঞান---ব্যাপক জ্ঞান, তা বস্তু সম্পর্কিত জ্ঞানই হোক বা মন বা আত্মা সম্পর্কিত জ্ঞানই হোক৷ প্রাচীন ভারতে অধ্যাত্ম বিজ্ঞানকে মূল বিজ্ঞান হিসেবে ধরা হ’ত৷ সে যুগেও আর্যভট্ট, বরাহমিহির, চরক, শুশ্রূত এঁরাও জন্মগ্রহণ করেছিলেন৷ তাঁদের বস্তুবিজ্ঞান সম্পর্কিত অবদান আজকের বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করে৷ আর্যভট্টই প্রথম বলেছিলেন পৃথিবী গোলাকার ও সূর্যের চারদিকে ঘোরে৷ যাইহোক সে প্রশ্ণ এখন থাক্৷

আজকের আলোচ্য বিষয় হ’ল শরীর, মন ও আত্মা৷ আমাদের শরীরকে চালায় মন৷ আমরা আমাদের শরীর সম্পর্কে খুব বেশী সচেতন৷ শরীরের সুখ অর্থাৎ ইন্দ্রিয় সুখটাকেই আমরা সাধারণত সুখের পরাকাষ্ঠা ভাবি৷ আর এই সুখের পেছনেই ছুটে চলার সহায়ক হিসেবে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করি৷ ফলে অনিয়ন্ত্রিত ইন্দ্রিয়সুখ আমাদের সর্বনাশ ডেকে আনে৷ এইভাবে মানুষ দৈহিক, মানসিক, নৈতিক ও আত্মিক --- সব দিক থেকেই নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছে৷

কীভাবে মনের বিকাশ ঘটানো যায়, কীভাবে মনের মধ্যে শুভবুদ্ধির জাগরণ ঘটে, মানবিকতাবোধের বিকাশ ঘটে, নৈতিক মানের উন্নয়ন হয়---তা জানা কেবল জড়বিজ্ঞানকেন্দ্রিক আধুনিক জ্ঞানের মাধ্যমে সম্ভব নয়৷ মনের ঊধর্বতম স্তরে আছে ‘সত্য-শিব-সুন্দর’-ময় সূক্ষ্মতম আত্মার অবস্থান৷ এ সমস্ত অধ্যাত্ম বিজ্ঞানের অন্তর্গত৷ নীতিবিজ্ঞান (যম-নিয়ম) এর প্রারম্ভিক স্তর৷ তাই উপযুক্ত নীতিশিক্ষা ও অধ্যাত্ম শিক্ষাকে উপেক্ষা করে যে আধূনিকতা তা মানুষের প্রকৃত কল্যাণ করতে পারে না৷

এখানে একথাও বলে রাখা প্রয়োজন বর্তমানের তথাকথিত বিজ্ঞান বা ভৌতবিজ্ঞানকে অস্বীকার করার কথা বলা হচ্ছে না, বরং ভৌত বিজ্ঞানের সঙ্গে নৈতিক ও আধ্যাত্ম-বিজ্ঞানের সমন্বয় সাধনের কথাই বলা হয়েছে৷ বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন এই কথাই বলেছিলেন---‘Science without religion is lame and religion without science is blind.’ ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান খোঁড়া ও বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ---দুইয়ের সামঞ্জস্য দরকার৷

জীবনের সর্বক্ষেত্রে ---সমাজের সর্বক্ষেত্রে এই কথাটি খাটে৷ ---এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক প্রাউট প্রবক্তা এই কথাটাই বলেছেন৷---এই সমস্ত দিকগুলির সুসন্তুলিত(balanced) উন্নয়নের মধ্যে দিয়েই সমাজের সার্বিক উন্নতি সম্ভব৷ অন্যথা, সব কিছু শেষ পর্যন্ত ভস্মে ঘি ঢালার সামিল হবে৷