কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন---‘জগত্ জুড়িয়া এক জাতি / সে জাতির নাম মানুষ জাতি৷’ বাঙলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও বলে গেছেন---‘একই বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান৷’
এছাড়া, যাঁরা শিবের ভক্ত যাঁরা বিশ্বাস করেন যে শিব মূলত অন্যান্য সাধারণ স্তরের কল্পিত বা পৌরারিক দেবদেবীর মত নন---তিনি ছিলেন পৃথিবীতে তারকব্রহ্মেরই প্রথম আবির্ভাব---সত্তা হিসেবে পরমপুরুষেরই মানবীয় রূপ৷ তাঁর কাছে আর্য-অনার্য নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষই তাঁর সন্তান---সবার তিনি বাবা৷ সবার তিনি প্রিয়৷ শিব কোন জাত-পাত মানতেন না৷ আবার যাঁরা বৈষ্ণব বা কৃষ্ণভক্ত তাঁরা জানেন যে, শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন তারকব্রহ্ম, পরমপুরুষের ভূমিকায় তিনি এক ও অদ্বিতীয়৷ সুতরাং পরমেশ্বর বা পরম স্রষ্টা হিসেবে যিনি জগদীশ্বর বা বিশ্বপিতা৷ তিনি এক অদ্বিতীয় ও তাঁর কোনও বিকল্প নেই, হতেই পারে না৷ আবার যাঁরা আল্লাহ বা খোদাকে স্রষ্টা রূপে মানেন তাঁরাও এই সিদ্ধান্ত পোষণ করেন যে আল্লাহ বা খোদা এক ও অভিন্ন৷ তাই তাঁর কাছে মানুষে মানুষে পার্থক্য থাকতে পারে না৷ যাঁরা নিরীশ্বরবাদী বা নাস্তিক তাঁরাও প্রকৃতিকে স্বীকার করেন৷ তা সেই প্রকৃতিও আমাদের পালয়িত্রী৷ সত্যটা হ’ল এই যে প্রকৃতির কোনও আলাদা বা দ্বৈত রূপ নেই৷ এমতাবস্থায় আমাদের স্রষ্টা (পরমেশ্বর) হলেন এক, প্রকৃতি মাতাও এক, আর মানুষ বা মানব প্রজাতি হিসাবেও এক৷ তাই সত্য৷ তাহলে মানুষে মানুষে জাতভেদ, জাতিভেদ, গোষ্ঠীভেদ, বর্ণভেদ, সম্প্রদায়ভেদ---এসব বিবাদ হাজির হ’ল কোত্থেকে৷ জবাব অতি স্পষ্ট যে, একশ্রেণীর কায়েমী স্বার্থবাদীরা মানুষে মানুষে বিভেদ রচনা করে, বিবাদ লাগিয়ে, তারা তাদের স্বার্থ লুটে নেবার জন্যে যুগ যুগ ধরে এই জাতিভেদের কারিগরি চালিয়ে গেছেন৷ অনেকে অবশ্য বলতে চাইবেন যে, ধর্ম অনুসারেও তো হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রীষ্টান৷ তাও সম্পূর্ণ ভুল ও পুরোপুরিভাবেই যুক্তিহীন৷ আর সেটি হচ্ছে মানুষেরই অজ্ঞতার কারণে৷ কেননা, আমরা তো সকলেই জানি যে, পৃথিবীর বুকে প্রথম এসেছিল মানুষ আর তার পরে এসেছে হিন্দুত্ববাদ বা হিন্দুমত৷ তাহলে যে পরে এল সে কোন্ যুক্তিতে আগে আবির্ভূত হওয়া মানুষের ধর্ম (ধর্ম মানে তো সত্তাগত বৈশিষ্ট্য) বলে গ্রাহ্য হতে পারে? বৌদ্ধমত, জৈনমত, খ্রীস্টমত বা ইসলামের আবির্ভাব কাল আরও পরে পরে৷ সুতরাং এদেরও কোনটিরই মানুষের ধর্ম বলে বিবেচিত হওয়ার যোগ্যতারই কোন প্রশ্ণ আসতে পারে না৷ দ্বিতীয়ত, হিন্দুমত থেকে শুরু করে সব ধর্মমতগুলি কোন না কোন মানুষের বা মানবগোষ্ঠীর নিজস্ব মতামত, তাই এগুলো মানুষের ধর্ম বলে বিবেচিত হবে না৷ এগুলোকে যারাই ধর্ম বলতে চান বা চেয়েছেন তাঁরা হয়ত না বুঝেই বিশদভাবে যুক্তিতর্ক না মেনেই আবেগের বশে অহমিকার বশে, অজ্ঞতার জন্যে কোনও কোনও ক্ষেত্রে আপন অভিলাশ চরিতার্থ করতেই এসব বুজরুকী মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দিয়ে শোষণের পথ প্রশস্ত করেছিলেন৷ এগুলোকে ইংরেজী ভাষায় রেলিজন ও আরবি ভাষায় বলা হয়ে থাকে মজ্হব৷ এরা মানুষে মানুষের বিভাজন ঘটায় ও মানবতাকেই অপদস্ত করে৷ তাই সংস্কৃত ভাষায় ধর্ম শব্দের প্রকৃত ইংরেজী প্রতিশব্দ ধর্মই (ডি-এইচ-অ্যা-আর-এম-এ) হবে, যার আরবি ইমান৷ সংস্কৃত ধর্ম শব্দের মানে হয় যা ধারণ করে আছি বা যা আমাকে ধারণ করে রয়েছে (ধৃ - ধাতু থেকে ধর্ম)৷ সুতরাং ধর্মের মূল মানে বাঙলায় হতে পারে স্বভাব (ইংরেজী নেচার অর্থে বা মনুষত্ব বা মানবত্ব৷)
ইংরেজরা ভারতের শাসনভার হাতে নিতে না নিতেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভারতে বাংলা ভাষী জনগোষ্ঠীটাই বুদ্ধিতে, বিবেচনায়, শক্তিতে অপেক্ষাকৃত অগ্রগণ্য৷ সুতরাং এদের চাপে ও তাঁবে রাখতে হবে আর সেটা করতে হলেও তাদের জাতীয় ঐক্যের মূলে আঘাত করেই ঐক্যবোধ সংহতি ও জাতীয়তাবোধকে বিনষ্ট করে দিতে হবে৷ যেই ভাবনা সেই কাজ৷ উপযুক্ত ক্ষেত্রও তারা পেয়ে গেলেন৷ চাষযোগ্য উর্বর মাটি আগে থেকে তৈরী ছিল, এদেশে ব্রাহ্মণ্যবাদের দৌরাত্ম্যে আর অপরদিকে আরব-ইরাণের মৌলবাদী ও তাদেরই এদেশীয় সাকরেদদের নেতৃত্বে, অবশেষে এই হিন্দু মুসলীম দ্বিজাতিতত্ত্বের তুরূপের তাস খেলেই তারা ভারত বিভাজন করে আজও রিমোর্ট কন্ট্রোলের সাহায্যে এই উপমহাদেশটা জুড়ে তাদের গোষ্ঠীগত অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বজায় রেখেছে৷ আহমদ শেরিফ নামে জনৈক প্রখ্যাত লেখক এক জায়গায় বলেছেন যে ইংরেজ আমলে হিন্দু বাঙালীরা ইংরেজী শিখে হিন্দুও হয়েছেন৷ আর মুসলিম বাঙালীরা হয়েছেন মুসলিম৷ কিন্তু বাঙালী কেউ রইলেন না৷ এরই অনিবার্য পরিণতিতে দেশ বিভাগ৷
এ যাবৎ পটভূমিকা করা হ’ল, বর্তমান সময়ের ত্রিপুরা রাজ্যের শাসক দল সহ অন্যান্য ক্ষমতাভোগী ও ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের দুরভিসন্ধিমূলক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তটা তুলে ধরতে৷ তারাও ব্রিটিশদেরই, ব্রিটিশেরই কায়দায় ‘ভাগ কর আর শাসন কর’ (Devide and rule) নীতি প্রয়োগ করেই তবে ত্রিপুরা রাজ্যবাসীকে জাতি আর উপজাতি দুই পৃথক শিবিরে বিভক্ত করে ফেলেছেন৷ অথচ আশ্চর্য বিষয়টা হ’ল যে সুবিধাভোগী ও সুযোগসন্ধানী রাজ্যের সেই উপজাতি নেতা-নেতৃরাও কিছু স্বার্থের কাছে আপন জনগোষ্ঠীর মর্যাদা লুটিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করছেন না৷ তাঁরা ভাবতে চান না যে উপজতি কথাটাতে তাদেরকে মানুষের মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না৷ কারণ ‘উপ’ কথাটির মানেই এখানে ছোট বা নিকৃষ্ট অর্থে প্রযুক্ত করা হয়৷ যেমন নদীর ক্ষেত্রে, উপনদী, নগরের ক্ষেত্রে উপনগরী৷ মানুষ তো সবাই মানুষ তাহলে তাদেরই কেন মানুষটিকে আলাদা রেখে মানুষের চেয়ে নিকৃষ্ট বলা হচ্ছে? আমরা কি জানি না যে, যে এপ্-ম্যান থেকে মানুষ এসেচে তারও আগের সেই ‘এপ’ অর্থাত্ বানব প্রজাতির জীবেরা রয়েছে৷ প্রশ্ণ তুলতে পারেন যে রাজ্যের সকল পাহাড়ী জনজাতিদের কেউ তো এ ব্যাপারে রা কাটছেন না৷ মুখ ফুটে কেউ প্রতিবাদ করছেন না। এরও কারণ একটাই অর্থাত্ আমরা সকলেই কর্তাভজা বা দাদা দিদির গোলাম বা ক্রীতদাস আর দাসী-বাঁদী, জি-হুজুর করে গদগদ হয়ে গলায় গামছা ঝুলিয়ে দু-হাত জড় করে দাদাদিদিদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি৷ বসতে বলা হলেও বা সামনে বসবার আসন থাকা সত্ত্বেও সেদিকে না দেখার ভান করে মাটিতে বসে বড়দের অর্থাত্ মুরুবিবদের সম্মান দেখাতেই যুগ যুগ ধরে আমরা বংশানুক্রমে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সমতলবাসী বা বাংলাভাষীরাই এরকম করছে, তখন দুর্গম পাহাড়ের নিরীহ পেটভুখা মানুষগুলি তো আরও অসহায় দুর্বল মনের মানুষ৷ তাদের চোখ খুলেছে, এমন লোকের তো নিতান্তই অভাব৷ এছাড়া এদের গোষ্ঠীগত সমষ্টির বৈশিষ্টই হচ্ছে মোড়লকে, মাতববরকে ওদের যথেষ্ট সম্মান দেখিয়ে চলতে হয়৷ তাই রাজনীতির ব্যবসায়ীরা এলাকার মোড়লকে খুশী করে, অচাই বা চউধুরী বা সর্দারকে খুশী করে এলাকা দখলের রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে৷ একই কায়দায় আজকাল শিক্ষিত উপজাতি নেতা-নেত্রীরাও একই ফাঁদ পেতে রাজ্যের উপজাতিদের নিয়ে রাজনীতির ক্রীড়াঙ্গণ মাতিয়ে রেখেছেন৷ এভাবেই দশকের পর দশক সামন্তরাজ্যের শাসনকাল পেরিয়ে বর্তমানের গণতন্ত্রের দিকে উপজাতি মহল্লার, বলতে গেলে কোনও উন্নতিই হয়ে ওঠেনি৷ এখনও যারা রাজ্যে উপজাতি ভিত্তিক বিভিন্ন সমস্যা বা রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব করছেন, তারাও কিন্তু একই পথের পথিক৷ অর্থাত্ হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীরই খাঁচায় বদ্ধ থেকে পুর্জিবাদের আধার মুখে নিয়ে ‘বাকুম, বাকুম’ করছেন এই যা৷ কখন যে কার ‘বাকুম বাকুম’ ডাক বন্ধ হয়ে যাবে, যখন অদৃশ্য হাতের ছবি এসে গলায় লাগবে সেকথা কেউ বলতে পারেন না৷
অপরদিকে, বাঙালী জনগোষ্ঠীরও একই অবস্থা---উনিশ আর বিশ, অবস্থা এমনই যে, জাতি আর উপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে কারা বেশী বঞ্চিত, শোষিত বা বঞ্চনার বেশী শিকার হয়ে চলেছে, এটা যাচাই করাটা খুব সহজ ব্যাপার নয়৷ অনেক সময় ওপর থেকে দেখে তুলনা করা দুরূহ ব্যাপার উপজাতিরা শিক্ষার দিক থেকে রাজ্যের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর থেকে এখনও অনেক পিছিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না৷ শুধু শহর এলাকা বা পৌর---রাস্তার সমুখস্থ এলাকার দৃশ্য দেখিয়ে উন্নয়নের বর্ণনা করা ভুল৷ সেই ভুলভাঙ্গাবে কারা?
এখানে একটি মজার ব্যাপার তুলে ধরছি রাজ্যে যারা বেশী সচেতন, শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিতেও নাকি বেশী অগ্রসর বলে দাবীদার, সেই বাঙালী ভাগচাষীদের নিয়ে এ রাজ্যে পত্র-পত্রিকা সাময়িকী, বিভিন্ন সরকারী- বেসরকারী কাগজের পৃষ্ঠায় প্রায়শঃই একটি কথা ছাপা হয়ে থাকে, হয়তো অনেকেরই চোখে পড়ে আমারই মত৷ বলা হয়---‘উপজাতি অনুপজাতি’৷ আচ্ছা, উপজাতি না হয় বুঝলুম৷ কিন্তু অনুপজাতি’ বলতে এ রাজ্যে কাদের বোঝায়? এই প্রজাতির জীবেরা এ রাজ্যে এলই বা কোন্ গ্রহ বা উপগ্রহ বা কোথাকার জল বা সাগর থেকে? আর একটা প্রশ্ণ, যদি এ রাজ্যের উপজাতি-অনুপজাতির কথাই বলা হ’ল, সেক্ষেত্রে এ রাজ্যে ‘জাতি’ বলতে কি কেউ আছে বা নেই? আমি খুবই অপমান বোধ করছি বলেই প্রশ্ণটা এনেছি৷ আমাকে কোন্ পর্যায়ে ফেলতে বলবেন---আমি উপজাতি? আমি কী অনুপজাতি? আমি কি জাতি? কই, রাজ্যের কোন্ বাংলাভাষী আমার আগে কিন্তু এই প্রশ্ণ তোলেন নি, তাই অনুরোধ জানাচ্ছি, দয়া করে যদি প্রশ্ণটার মীমাংসা করে দেন৷
এতক্ষণ অনেক কথাই বলা হ’ল, রাজ্যের কাণ্ডারী আজ রাজনৈতিক বাস্তুকারদের কীর্তি-কলাপ ও চিন্তাধারা নিয়ে৷ কিন্তু, আলোচ্য লেখাটির মাধ্যমে যে বার্তাটি আমি রাজ্যের বাসিন্দা পাঠক সমাজের হৃদয়-দরবারে পেশ করতে মনস্থ করেছি, তা অতি সংক্ষেপেই এখানে তুলে ধরতে চাইছি৷ বলতে গেলে, বিগত ত্রয়োদশ শতকে যেদিন থেকে বার্মা থেকে এ রাজ্যের মাটিতে মঙ্গোলিয় গোষ্ঠীভুক্তরা পদার্পণ করেছিলেন, তখন থেকেই এখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে উভয় গোষ্ঠীর মানুষজনেরই আন্তরিক, আদান-প্রদান ঘটে গিয়েছিল৷ এর পেছনেও যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান ছিল, অস্বীকার করার তো উপায় নেই৷ ভারতীয় আদর্শই হ’ল, বুক পেতে দিয়ে সবাইকে আপন করে নেওয়া৷ বহিরাগতকে বা আগন্তুককে ভারতবাসী কোনদিনই ফিরিয়ে দিতে চায়নি৷ আর প্রাচীন ভারতবর্ষেরই আদিতে যে অষ্ট্রিক-নিগ্রো-মঙ্গোলীয় ও পরবর্তীকালে অষ্ট্রীক-আর্য-দ্রাবিঢ়-মঙ্গোলিয় রক্ত-সংমিশ্রণে যে বাঙালী নামধেয় জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছিল, বাঙালীরাও কিন্তু স্বভাবগতভাবেই জনবৎসল, সহানুভূতিপূর্ণ ও উদার স্বভাবের৷ ভারতবর্ষের ইতিহাস, বাঙলার ইতিহাস ও বাঙালীর ইতিহাস, এই সাক্ষ্যই বহন করে চলেছে৷ তাই আমরা দেখতে পাই যে, এই বঙ্গদেশ বা বাঙলার বুকে মূল অষ্ট্রিক গোষ্ঠী উদ্ভুত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পরবর্তীকালে ধাপে ধাপে আফ্রিকা বা ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে আগত নিগ্রো, এশিয়া মাইনর থেকে আগত আর্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আগত মঙ্গোলীয়রা, এশিয়া থেকে তুর্কীরা, বহির্ভারত থেকে পাঠান, মোগল, ফরাসী, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ ও ইংরেজ ইয়ূরোপীয়রা প্রমুখ সকলেই ধেয়ে এসেছে বাঙলার ওপর, তাদের অনেকেই লুঠতরাজ করে বাঙলাকে নিঃস্ব করে দিয়ে ফিরে গেছেন, আবার অনেকেই বাঙলার মাটি আর মানুষের প্রেমে পড়েই এখানে ঘর বেঁধেছে৷ তদ্রুপ, মুচাংফা-র পরবর্তী বংশধরেরাও এই মাটিকে ভালবেসে আপন করে নিয়েছেন৷ তাদেরও পরে আরও যারা এল, তারাও এখানকার বাসিন্দা হয়ে গেছে৷ ধীরে ধীরে রক্তের সম্পর্ক হয়েছে, আত্মারও মিলন ঘটেছে৷ এইভাবেই গড়ে উঠেছিল পাহাড়বাসী আর সমতলবাসীদের মিলিত প্রয়াসে, আরণ্যক সভ্যতার বা যাযাবর বৃত্তির লোকেদের সঙ্গে নদীমাতৃক সভ্যতার মানুষের আত্মীয়তার বন্ধন৷ এভাবেই গড়ে উঠেছিল ত্রিপুরার এক মিশ্র সংস্কৃতি৷ পারস্পরিক আদান-প্রদানের ও অন্তরের সম্পর্কের ঠাস বুনোনিতেই গড়ে ওঠে এখানকার সংস্কৃতি,সামাজিক ও অর্থনৈতিক কৃষি নির্ভর বুনিয়াদ৷ কিন্তু পরবর্তীকালে হিন্দী সাম্রাজ্যবাদেরই ক্রীড়ানকদের যোগসাজসে ত্রিপুরায় ইজম ভিত্তিক নোংরা রাজনীতির আগুনে সেই বুনিয়াদ পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে গেছে৷ তাই আজ রাজ্যে পাহাড়ে-সমতলে প্রেমের জায়গায় দেখা দিয়েছে বৈরীতা ও বিদ্বেষ, পারস্পরিক নির্ভরতাকে গ্রাস করেছে পারস্পরিক অবিশ্বাস আর সন্দেহ৷ অবশ্য এরই পরিণতিতে সকলেই পুড়ে মরছে৷ লাভবান হচ্ছে কেবল ঘৃণ্য সুবিধাবাদী রাজনীতিকরা৷
তাই, এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির একটাই উপায়, সেটি হ’ল বর্তমানের পুৃজিবাদী অর্থনীতির বদলে প্রতিষ্ঠা চাই প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের আর সুবিধাবাদী রাজনীতির পরিবর্তে চাই আদর্শভিত্তিক, নীতিবাদী ও দর্শন ভিত্তিক জনকল্যাণকামী রাজনীতি৷ এই সত্যটিকে আজ সবাইকে অনুধাবন করতে হবেই৷ তাতেই আসবে সংকট থেকে মুক্তি৷
- Log in to post comments