তুমি এসেছিলে কাউকে না বলে

লেখক
আচার্য মন্ত্রেশ্বরানন্দ অবধূত

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী (শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার) ছেলেবেলাকার কিছু বিস্ময়কর ঘটনা এখানে নোতুন পৃথিবীর পাঠকদের উপহার দিচ্ছি৷ ..... বামুন পাড়ার (শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী পৈত্রিক বাসস্থান) নরেশ ঘোষ মহাশয় একজন শিক্ষিত সমাজসেবী ছিলেন৷ প্রভাতরঞ্জনের চেয়ে বয়সে তিনি বছর পাঁচেকের ছোট ছিলেন৷ যখনই বুবু (প্রভাতরঞ্জন) বামুনপাড়া আসতেন নরেশবাবু ছায়ার মত তাঁর সঙ্গী হতেন৷ তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রভাতরঞ্জন আধ্যাত্মিক শক্তিতে শক্তিমান ছিলেন৷ তাঁর অগাধ জ্ঞানসমুদ্রে ডুব দিয়ে তাঁকে জানার চেষ্টা করা বৃথা....বুদ্ধি দিয়ে তার পরিমাপ করা যায় না৷

অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে নরেশবাবু বললেন–‘‘বুবুদা বামুনপাড়া এলে ভাষাতত্ত্ব, ইতিহাস, ভূগোল, বাংলা, সাহিত্য, দর্শন, আধ্যাত্মিকতা প্রভৃতি নানান বিষয়ে আলোচনা করতেন৷ তিনি অনেক ভাষা অনর্গল বলে যেতেন৷ তাঁর অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি আমাদের মুগ্ধ করতো৷ বেদ–উপনিষদ থেকে বহু শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়ে দার্শনিক তত্ত্বের প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা দিতেন৷ শৈব–শাক্ত–বৈষ্ণব–সৌর-গাণপত্য দর্শন নিয়ে গূঢ়  আলোচনা আমাদের অন্তরের ভিতর তীব্র ভাবে নাড়া দিত৷ লোকে বলতো–বুবুদা নাকি হস্তরেখা বিশারদ ছিলেন৷ আমি মনে করি হস্তরেখা নয়, যেকোন মানুষের দিকে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়েই তিনি তার সম্বন্ধে সব বলে দিতে পারতেন৷ হয়তো তিনি সেইসব মানুষের মনের ভিতর ঢুকে যেতেন৷ একবার আমার বড় ভাই নারায়ণের মস্তিষ্ক্ বিকৃত হয়েছিল৷ আমার বাবা কোন ব্যবস্থা নেবার আগে বুবুদাকে তাঁর পরামর্শ চেয়ে চিঠি দিলেন৷ বুবুদা দাদাকে হাসপাতালে ভর্ত্তি করতে মানা করলেন৷ তিনি কিছু বনৌষধি সহ যোগাসন করতে ও খাদ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে বললেন৷ ধীরে ধীরে দাদা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন হাসপাতালের আর দরকার হ’ল না৷’’

প্রভাতরঞ্জন যখন বামুন পাড়া যেতেন তখন একদিন গোপীবাবু বীরভূম জেলার সাধক বামাখ্যাপার কথা বললেন৷ তিনি বললেন–‘‘জানেন একবার বামাখ্যাপা টিকিট ছাড়া ট্রেনে করে’ যাচ্ছিলেন৷ টিকিট না থাকায় টিকিট কালেক্টর তাঁকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয়৷ ড্রাইভার বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন ছাড়তে চাইলেও ট্রেন কিন্তু চললো না৷ একজন প্যাসেঞ্জার গার্ডকে বললেন–‘‘যাঁকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে তিনি একজন মহাযোগী৷ তিনি ট্রেনে না ওঠা পর্যন্ত ট্রেন চলবে না৷’’ তাঁরা বামাখ্যাপাকে ট্রেনে তুলে নিলেন৷ ট্রেনও চলতে শুরু করল৷’’

গল্প শুণে প্রভাতরঞ্জন বললেন–‘‘হ্যাঁ, এর জন্যে নিশ্চয়ই কিছু আধ্যাত্মিক শক্তির দরকার, তার অর্থ এই নয় যে এর জন্যে মহাযোগী হওয়া দরকার৷’’

গোপীবাবু সন্দেহের সঙ্গে ভুরুটা কুঁচকে বললেন–‘‘আপনি কি এটা করতে পারেন?’’

প্রভাতরঞ্জন তাঁর প্রশ্ণের কোন উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–‘‘তুমি কবে কলকাতা ফিরছ?’’

–‘‘আমি কালই কলকাতায় যাব৷’’

–‘‘ভালো, আমিও কাল যাচ্ছি৷ এক সঙ্গে যাওয়া যাবে৷’’

একই সঙ্গে কলকাতা যাবার জন্যে গোপীবাবু প্রভাতরঞ্জনের সঙ্গেই থেকে গেলেন৷ পরেরদিন প্রভাতরঞ্জনকে তৈরী হয়ে নেবার জন্যে তাড়া লাগিয়ে নিজেও তৈরী হয়ে নিলেন৷

প্রভাতরঞ্জন বললেন–‘‘আমার একটু দেরী হবে৷ অত তাড়াহুড়ো করার কোন দরকার নেই৷’’

–‘‘প্রভাতদা, কলকাতায় আমার জরুরী কাজ আছে৷ ট্রেনটা কোনমতেই ছাড়লে চলবে না৷’’

–‘‘তবে তুমি এগিয়ে যাও৷ আমি ঠিক সময় মত পৌঁছে যাব৷’’

গোপীবাবু ষ্টেশনে পৌঁছে টিকিট কেটে নিলেন৷ ততক্ষণে ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে৷ প্যাসেঞ্জাররা যাঁরা নাবার তারা নেবে গেছেন, যাঁরা যাবার তাঁর উঠে পড়েছেন৷ গোপী দূরে প্রভাতরঞ্জনকে দেখতে পেলেন৷ ট্রেন ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে৷ যে কোন মুহূর্ত্তে ছেড়ে দেবে, ড্রাইভার ইতোমধ্যে বাঁশিও বাজিয়ে দিয়েছে৷ অথচ প্রভাতরঞ্জনের কোন হেলদোল নেই৷

গোপীবাবু চিৎকার করে’ বলতে লাগলেন–‘‘প্রভাতদা, তাড়াতাড়ি পা চালান৷ গাড়ী অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে৷ এক্ষুনি ছেড়ে দেবে৷’’

প্রভাতরঞ্জন তাঁর কথায় কাণ দিলেন না৷ ততক্ষণে ট্রেন ছাড়ার জন্যে আবারও বাঁশি বেজে গেল৷ কিন্তু প্রভাতরঞ্জন ধীরে সুস্থে ষ্টেশনে প্রবেশ করলেন, ভাবটা এমন যে ট্রেনের সাধ্য নেই তাঁকে ছাড়া চলে৷ ষ্টেশনে এসেও প্রভাতরঞ্জন গয়ংগচ্ছভাবে টিকিট কাউন্টারে গিয়ে টিকিট কাটলেন৷ ড্রাইভার আবার ট্রেন ছাড়ার বাঁশি বাজালেন৷ কিন্তু ট্রেন বাবাজী নট নড়নচড়ন৷

প্রভাতরঞ্জন টিকিট কেটে পায়ে পায়ে এসে ট্রেনে উঠে গোপীর পাশে বসলেন৷ ট্রেন তখন চলতে শুরু করলো৷ গোপীবাবু বিস্ময়ে প্রভাতরঞ্জনের দিকে তাকালেন কিন্তু মুখ দিয়ে বাক্য নিঃসৃত হল না৷

সাধারণতঃ ট্রেনটি ব্যাণ্ডেল ষ্টেশনে এসে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে৷ গোপীবাবু তাই অন্যান্য প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে প্ল্যাটফর্মের দিকে চা খাবার জন্যে পা বাড়ালেন৷ প্রভাতরঞ্জন বললেন–‘‘আজ আর যেওনা কেননা ট্রেন আজ এখানে অল্প সময়ই দাঁড়াবে৷’’

–‘‘আপনি জানেন না, আমি তো এই ট্রেনে প্রায়ই যাই৷ এই ট্রেন এখানে প্রতিদিন অন্তত কুড়ি মিনিট দাঁড়ায়৷’’

গোপীবাবু সবেমাত্র চায়ের অর্ডার দিয়েছেন সেই মাত্র বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল৷ গোপীবাবু দৌড়ে কোনরকমে কামরায় উঠে পড়লেন৷ ট্রেনে চেপেই তিনি নিজের কৌতূহল চেপে না রেখে বললেন–‘‘কী করে আপনি জানলেন যে আজ ট্রেনটা কয়েকমিনিটও দাঁড়াবে না?’’

প্রভাতরঞ্জন মৃদু হেসে বললেন–‘‘ট্রেনটা যে শক্তিগড়ে অতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, সেইজন্যেই তো সময় বাঁচানোর জন্যে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিল৷’’

গোপীবাবু আর কথা বাড়ালেন না৷ তাঁর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো একটাই ভাবনা–শক্তিগড়ে গাড়ী অতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা আবার ব্যাণ্ডেলে গাড়ী না–দাঁড়ানো সবই কী তবে প্রভাতদার ঐশী শক্তির কাজ?