সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশিত হ’ল৷ এই প্রসঙ্গে কয়েকটি জিনিস বিশেষ উল্লেখনীয়৷ প্রথম কথা, এবার পরীক্ষার ফলে দেখা গেছে মেধা তালিকায় কলকাতাকে অনেক পিছে ফেলে এগিয়ে গেছে গ্রামবাংলা তথা গ্রাম বাঙলার বিভিন্ন শহরগুলো৷ মাধ্যমিকে তো প্রথম দশ শীর্ষস্থান বিভিন্ন জেলার ছেলেমেয়েরাই পেয়েছে৷ কলকাতা বর্তমান সমাজের তথাকথিত এলিট শ্রেণীর বাসস্থান৷ টাকা পয়সা, বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী পদ, নানান সুযোগ সুবিধা, ছেলেমেয়েদের পড়াশুণার জন্যে খরচের বহর সবকিছুর দিক থেকে কলকাতার সঙ্গে অন্যান্য জেলার মানুষদের তুলনাই হয় না৷ তবুও জেলাগুলির জয়জয়কার ৷ এছাড়া পরীক্ষার ফলাফলে আরও যে সব চিত্র প্রকাশ্যে এসেছে, তাও উল্লেখ করার মত ও এ নিয়েও কিছু ভাবার আছে৷
যেমন, পশ্চিম মেদিনীপুরে সবং-এর শুশোভন সামন্ত৷ বাবা সন্দীপ সামন্তের --- বিঘে দেড়েক জমি৷ তাও অতিবৃষ্টি হলে চাষ ঠিকমত হয় না৷ অন্যের বাড়ীতে কাজ করে বা ১০০ দিনের কাজ করে পরিবারের রুজি রোজগার করতেন৷ এরপর মোট বইতে গিয়ে কোমরে আঘাত লেগে এখন সে কাজও বন্ধ ৷ অনেক চেষ্টা চরিত্র করে এখন টোটো কিনে চালাচ্ছেন৷ এইভাবে রুজিরোজগার করেন৷ এইভাবে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে ছেলেকে অতিকষ্টে পড়াচ্ছেন৷ ছেলে সুশোভন টিউশন ছাড়াই নিজের চেষ্টায় এবার মাধ্যমিকে প্রায় ৯৬ শতাংশ নম্বর পেয়েছে৷ অঙ্কে পেয়েছে ১০০, পদার্থ বিজ্ঞানে ৯৯, ভুগোলে ৯৯, ইতিহাসে ৯৪, বাংলা ৯৪, ইংরেজি ৯০৷ ছেলের দারুণ ইচ্ছে ডাক্তারি পড়বে বড় ডাক্তার হয়ে দেশসেবা করবে৷ এখন বাবা মায়ের চিন্তা, পরিবারের এই অবস্থায় কীভাবে ছেলেকে ডাক্তারী পড়াবেন!
বীরভূমের রাজনগর ব্লকের আদিবাসী গ্রাম লতাবুনির রমেশ টুডু৷ বাবা সনাতন টুডু দিনমজুর৷ এমনও দিন যায় রমেশের বাড়ী দুবেলা রান্না চড়ে না৷ মা সুন্দরী টুডুও কোলের ছেলেটাকে নিয়ে অন্যের বাড়ীতে গিয়ে কোদাল চালান৷ তাঁদের ছেলে রমেশ প্রতিদিন ৬কি.মি. দূরে মাধাইপুর পল্লীমন্ডল হাইসুকলে পড়ে এবার উচ্চমাধ্যমিকে প্রায় ৯০ শতাংশ নম্বর পেয়েছে৷ এখন চিন্তা, কী করে সে উচ্চশিক্ষা লাভ করবে!
রাইগঞ্জের (উঃ বঃ) নিকিতা পাল৷ বাবা আদা, পেঁয়াজ, রসুন বেচেন ও মা পান-বিড়ির গুমটি খুলে পান-বিড়ি বেচেন৷ তাদের মেয়ে নিকিতা মাধ্যমিকে ৯০ শতাংশ নম্বর পেয়েছে৷ সেও বিজ্ঞান পড়তে চায়৷ কিন্তু তার হতদরিদ্র বাবা মা কীভাবে মেয়ের উচ্চশিক্ষার খরচ জোগাবেন?
হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রার এই অবস্থা যাদের প্রতিদিনকার অন্নসংস্থান করাটাই সমস্যা, তাদের ছেয়েমেয়েরা কোনোরকমে বাড়ীতে থেকে---বাড়ীর খেয়ে হয়তো মাধ্যমিক---উচ্চমাধ্যমিকের চৌকাঠ পেরোল কিন্তু এরপর কীভাবে তাদের প্রতিভার বিকাশ হবে? কত যে প্রতিভা এইভাবে প্রতিবছর অঙ্কুরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার হিসেব নেই!
প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা মহান দার্শনিক পরম শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর ‘সমাজের ক্রমবিকাশ’ প্রবচনে বলেছেন, ‘‘কত মেধাবী ছেলে অর্র্থভাবে বিদ্যাচর্র্চ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে, কত বড় শিল্পী অবস্থার চাপে তার অসামান্য প্রতিভা অঙ্কুরেই দাবিয়ে মেরে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে এই সমাজ ব্যবস্থার দোষে ৷ এ অবস্থা থাকতে দেওয়া যেতে পারে না৷ এই ভেদবুদ্ধির বাবুই-বাসা ভেঙ্গে চুরমার করে দিতেই হবে৷ তবেই মানুষ জাতিকে সামগ্রিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে জয়ের পথে৷ ’’
বর্তমানে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় সমাজের মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণীর হাতে পুঞ্জীভূত হয়েছে সমাজের অধিকাংশ ধন-সম্পত্তি৷ আর সমাজের অধিকাংশ মানুষ চরম অভাবের মধ্যে শুকিয়ে মরছে৷ প্রাউট-প্রবক্তা এই অমানবিক অবস্থার পরিবর্তন এনে প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করতে চান৷ তিনি চান বিশ্বের সমস্ত সম্পদের সর্র্বধিক উপযোগ ও যুক্তি সঙ্গত বন্টন৷ শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি চান এমনি ব্যবস্থা যেখানে শিক্ষাব্যবস্থা প্রাথমিক থেকে সর্র্বেচ্চ স্তর পর্যন্ত থাকবে পুরোপুরি ফ্রি৷ ফ্রি মানে কেবল বেতন নয়, কোনো প্রকার ফি থাকবে না, এমনকি ছাত্র-ছাত্রাদের খাওয়া পরার জন্যেও ওদের যাতে কোনো চিন্তা করতে না হয়--- তার ব্যবস্থা করতে হবে৷ তখন সমাজের প্রতিটি ছেলেমেয়েই তাদের মধ্যেকার সুপ্ত সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে পারবে ও তাদের প্রতিভার যথার্থ বিকাশ ও উপযোগ ঘটিয়ে সমাজকে সমৃদ্ধ করবে৷
- Log in to post comments