উপকারী ঘোমটার নীচে সাম্রাজ্যবাদী খ্যামটা

লেখক
একর্ষি

খবরে প্রকাশ লালচীন এখন আন্তর্জাতিক বড় ঠিকাদার৷ বড় ভাই রাশিয়ার সাম্যবাদী গণেশ উল্টানোয় সাম্যবাদের বাজারের দায় বর্তেছে চীনের হাতে৷ তবে নাকি এখন বড় দায়....আশপাশের দেশ গুলোর দারিদ্র্য মোচন ৷ মহান ব্রত বটে৷ কিন্তু ব্রতটার নাম কী ? ‘ঋণদান ব্রত ’! এই ব্রত-তত্ত্বটার উদগাতা হলেন আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সংঘটক জন অ্যাডামস, আমেরিকার দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি৷ অ্যাডামস্ এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে উত্তরকালে আমেরিকা দীর্ঘকাল ওই তত্ত্ব অনুসরণ করেছে৷ ব্রিটেনও এটার সফল কারিগর৷ কিন্তু ব্রিটিশ সূর্য এখন অস্তমিত ৷ আবার সোভিয়েত রাশিয়ার পালা বদলের পর বিশ্বে আমেরিকার একছত্র দাদাগিরি থাকলেও ভিতরে ভিতরে তার ক্ষমতার বিশ্বায়ন টলমল ৷ চমকে ওঠারই কথা! অ্যাডামস-এর সেই ঋণ-তত্ত্বের ব্যাটন টা এখন চীনের হাতে৷

অ্যাডামস্ সাহেব বলতেন ---‘কোন ভূখণ্ড বা দেশকে পদানত করতে তলোয়ারের বিকল্প হিসেবে ঋণ-অস্ত্রও ব্যবহার করা যায়৷’ হাতে না মেরে ভাতে মারার ব্যবস্থা আরকি!৷ ফল তো সূদূর প্রসারী৷ কেউ কিছু জানতেও পারল না, বুঝতেও পারল না৷ ঋণ গ্রহীতা দেশ চিরকালের মত ঋণের ফাঁসে আটকে থাকবে৷ শোষণটা চিরকাল চলতে থাকবে৷ মিত্রবেশী শোষক আড়ালে থেকে থাকবে ধরা ছোঁয়ার বাইরে৷ চীনের সঙ্গে বহির্বিশ্বের বহির্বাণিজ্যের কয়েকটি প্রাচীন পথ ছিল৷ প্রাচীনকালে ওই পথে প্রধান সপ্তানী দ্রব্য ছিল সিল্ক৷ এজন্যে এই পথের আন্তর্জাতিক পরিচিতি সিল্ক-রুট নামে৷ এই সিল্ক-রুটেরই নয়া সংস্করণ -ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ৷ যাই ই হোক চীন এখন ওই সিল্করুটের আশিটা দেশকে ঋণের জালে কব্জা করতে তৎপর৷ টোপটা খুবই মুখরোচক---‘আমরা কেবল ঋণ দিচ্ছি না, উন্নয়নেও সহায়তা করছি৷ ঋণের চিটে-গুড়ে সহায়তা কেমন মজেছে তা দেখতে কয়েকটা তথ্যের দিকে নজর দেয়া যাক৷

 

১) চীনের প্রিয় বন্ধুদেশ পাকিস্তান৷ চীনের কাছে পাকিস্তানের ঋণ প্রায় ৫২ বিলিয়ন ডলার৷ ব্রিটেনের ‘দ্য সান’ পত্রিকায় প্রকাশ --- পাকিস্তান ‘ব্যবসায় সহায়ক পরিবেশ’ এর বিশ্বর্যাংকিংএ ১৯০ টি দেশের মধ্যে ১৪৭তম স্থানে৷ তার পক্ষে ওই ঋণ পরিশোধ করা কিছুতেই সম্ভব নয়৷ ঋণভারে নূ্যব্জ পাকিস্তান দাস খত স্বরূপ গদর বন্দরের মাধ্যমে সড়কযোগে ভারতমহাসাগরে সংযোগ দান করেছে৷

২) প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে দক্ষিণের হাম্বান টোটায় একটা অগভীর সমুদ্র বন্দর নির্র্মণ করেছে৷ সুদের হার ৬.৩ শতাংশ৷ কিন্তু কিস্তি দিতে ব্যর্থ হওয়ার ঋণের দায়ে শ্রীলঙ্কা চীনের কাছে ওই বন্দরটাকে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দিতে বাধ্য হয়েছে৷

৩) দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপ ভারতের পুরানো বন্ধু৷ কিন্তু চায়না ঋণে হিমায়িত হওয়ার মালদ্বীপ বন্ধু দেশ ভারতকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য করেছে৷

৪) আফ্রিকার ক্ষুদ্র দেশ জিবুতি৷ ঋণের কিস্তি শোধ করতে না পারায় জিবুতি চীনকে দেশে চীনা সামরিক ঘাঁটি তৈরী করতে দিতে বাধ্য হয়েছে৷

৫) উন্নয়নের নামে ঋণের টোপ গিলিয়ে অষ্ট্রেলিয়ার নাকের ডগায় ভানুতুয়ার বিমানবাহী জাহাজ নোঙরের ব্যবস্থা করা কেবল সময়ের অপেক্ষা৷ বিশেষজ্ঞদের মতে ঋণ ও বিনিয়োগের সুরক্ষা দিতে সামরিক উপস্থিতিও প্রয়োজন৷ ভানুতুয়ার এয়ার ক্রাফট্ ল্যান্ডিং ষ্টেশন স্থাপন তারই নমুনা৷

৬) গত আগষ্ট মাসে চীন সফরে গিয়ে বেজিংয়ে নোতুন ধরনের কলোনি তৈরীর প্রসঙ্গ তোলেন মালেশিয়ার প্রধান মন্ত্রী মহামির মহম্মদ৷ প্রতিবাদ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি৷ তাঁর দেশের জন্য চীনের প্রস্তাবিত ২ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পরিকাঠামো প্রকল্পটিও তিনি বাতিল করেছেন৷

৭) উন্নয়নের নামে ঋণের ফাঁদে আটকে পড়ছে আরব দুনিয়ার দেশগুলো৷ প্যালেস্তাইন, সিরিয়া, ইয়েমেন, জর্ডন, লেবাননাদি দেশগুলো চায়না-ঋণের সম্ভাব্য গ্রহীতা৷

৮) প্রশান্তমহাসাগরীয় ভানুয়াতু ছাড়াও পাপুয়া, নিউগিনি , ফিজি , সামোয়া প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোকে প্রচুর ঋণ দিয়েছে চীন৷

তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে৷ ওইসব ঋণ দান ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় নজর কারার মত---

১) ঋণশোধ করার সামর্থ নেই অথচ সামর্থের অতিরিক্ত ঋণ দেয়া হচ্ছে৷

২) জিডিপির সঙ্গে ঋণ গ্রহীতা দেশের ঋণ-ভারসাম্য প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে৷

৩)ঋণগ্রস্ত অনেক দেশ শেষ অবধি চীনকে ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা দিতে বাধ্য হচ্ছে৷ এইভাবে ঋণ ও উন্নয়নের নামে চীন সিল্করুটের অন্তত ৮০ টি দেশকে করায়ত্ত করতে চাইছে৷

৪) ওয়ান-বেল্ট-ওয়ান রোড এ চীনের সরিকদের বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমেই বাড়ছে৷ এর পরিণতিতে সিল্করুটে যুক্ত দেশগুলো ক্রমেই চীনের তৈরী মালের বাজারে পরিণত হচ্ছে--- যা ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শোষণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়৷

৫) অনেক দেশ ঋণ চুক্তির শর্ত হিসাবে বড় বিনিয়োগগুলোতে ১০ বছরের কর ছাড় দিচ্ছে৷ ফল-স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে চীনের বিনিয়োগের অসম প্রতিযোগিতা যার ফলে স্থানীয় উদ্যোগ ধবংস হওয়ার মুখে৷

৬) অনেক ক্ষেত্রেই ঋণ সম্পর্কে জনগণ অন্ধকারে থাকছে৷ কোন শ্বেতপত্র প্রকাশ হচ্ছে না৷ কোথাও বা তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো এগোচ্ছে জনবিচ্ছিন্ন সামরিক প্রক্রিয়ায়৷ এতে সময় লাগছে বেশী , ঋণের অঙ্ক যাচ্ছে বেড়ে৷

৭) বিশাল অঙ্কের ঋণভিত্তিক নাইরোবি-মোম্বাসা-রেললাইন ও আদ্দিস-আবাবা- জিবুতি রেললাইন তৈরী হয় মূলত দুই পাশের বিপুল খনিজ সম্পদের কথা মাথায় রেখে৷ এটা ঔপনিবেশিক লুটের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়৷

৮) বাস্তবে ঋণের শর্ত হিসেবে---* সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে হবে ঋণগ্রস্ত দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেই৷ *দেশকে কুনীতিক সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আপস করতে হবে৷ *অনেক প্রকল্পের মালিকানা ইজারা দিতে হবে চীনকে ৷ আর এরফলে চীন দেশে দেশে বিশাল জলপথ ও স্থলপথের মালিক হয়ে উঠবে --- যা অ-ইউরোপীয় মহাদেশগুলোতে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা করেছিল৷ বেল্ট রোড -ঋণ প্রকল্প সম্পর্কে চীনা সাফাই --- ‘ এই প্রকল্পটি কোনো বিলাসবহুল ক্লাব বা ব্লক তৈরীর বিষয় নয়৷ এই প্রকল্পের গুরুত্ব অনেক বেশী৷ বেল্ট এ্যান্ড রোড প্রকল্প থেকে শুধু চীন নয়, উভয় পক্ষই লাভবান হবে৷’--- এই লাভটা কেমন? বিশেষজ্ঞদের অভিমত-‘ওই ঋণ প্রকল্পের হাত ধরে বিদেশী কাঁচামাল যেমন সহজে চীনের হাতে আসবে, তেমনি বিদেশের মাটিতে চীনের প্রভাব বাড়বে৷ ’ মতামতে যেটা সোজাসাপটা বলা হল না সেটা হল--- ঋণের দায়ে ন্যুইয়ে পড়া দেশগুলো হবে চীনের কাছে কাঁচামালের যোগানদার আর চীনের তৈরী মালের অবাধ বাজার৷ ব্রিটিশও একই কায়দায় ভারতে ঔপনিবেশিক শোষণ চালাত৷ অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসে এ এক ভয়াবহ পর্যাবৃত্তি৷

খুব একটা প্রচলিত কথা--- ঋণ করে ঘি খাওয়ার পরিণাম ভয়াবহ৷ জনবিস্ফোরণে ভারাক্রান্ত চীনের জমিক্ষুধা বা অন্যদেশের জমির ওপর আগ্রসনী ভূমিকা নোতুন কিছু নয়৷ ওই আগ্রাসনের বর্তমান পদক্ষেপটা অভিনব৷ এটা অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদী শোষণেরই পালিশ করা রূপ মাত্র৷ ঋণগ্রস্ত দেশগুলোর অবস্থা শিকারী অজগরের সামনে পড়া হরিণ শাবকের মতে৷ ঋণের উন্নয়নী-মায়ায় চীনের গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসার পথ বন্ধ৷ ভারতের বাজারও চীন তৈরী সস্তা মালে ছেয়ে গিয়েছে৷ আবার ভারত তো এখন চীনের ইলেক্ট্রনিক্স দ্রব্যের ভাল বাজার৷ ফলে ভারতের বহু শিল্পের গঙ্গাযাত্রা ঘটেছে৷ সর্বাধুনিক অর্থনৈতিক ভাবনায়--- বিশ্বের প্রতিটি কোণে প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর কল্যাণে সর্বতোভাবে বিদেশী দ্রব্য বর্জন করা দরকার৷ একান্ত আবশ্যক হলে সাময়িকভাবে বাধ্য হয়ে নিলেও বিশেষ দ্রব্যের বিকল্প দ্রব্য দেশেই তৈরী করতে হবে, পরনির্ভরশীলতা কাটাতে হবে৷

২য় কথা---দেশ থেকে কাঁচামালটা বেরিয়ে গেলে শিল্প স্থাপনের সুযোগটাও গেল, কর্মসংস্থানের পথটাও বন্ধ হল৷

আবার বিদেশী দ্রব্য কেনার ফলে দেশের টাকা বেরিয়ে গেল৷ অর্থের চলমানতাও থমকে গেল৷ তার মানে হল দেশের অর্থনীতি ফোঁপরা হয়ে গেল৷ ব্রিটিশ এই ভাবেই বাঙলায় তথা ভারতে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ---অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করেছিল ৷ চীন সেই পথেই হাঁটছে৷ সহায়তা-উন্নয়নের নামে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করতে চলছে চীন৷ তাহলে কী চীনের সাম্যবাদী ঝোলা থেকে সাম্রাজ্যবাদী বেড়ালটা বেরিয়ে পড়ল!