যোগ- মানুষের বৈয়ষ্টিক ও সামূহিক জীবনের কল্যাণের চাবিকাঠি

লেখক
আচার্য পরাবিদ্যানন্দ অবধূত

সারা পৃথিবীতে ‘যোগ’ এখন একটি বিশেষ জনপ্রিয় নাম৷ যদিও ‘যোগ’ শব্দটা হয়ে গেছে ‘যোগা’৷ এর উৎপত্তিস্থল প্রাচীন ভারতের মুনি-ঋষি তথা যোগীদের আশ্রম৷ কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে ‘যোগ’ থেকে জাত ‘যোগা’ শব্দটির দ্বারা আমরা যা বুঝি কেবলমাত্র বিশেষ রকমের শারীরিক কসরৎ অর্থাৎ exercise  অর্থাৎ মহর্ষি পতঞ্জলির অষ্টাঙ্গিক যোগ সাধনার কেবলমাত্র ‘আসন’৷ না, এই আসন মানে যোগ নয়৷ আবার যদি আসনটিও দেহের জন্য ঠিকভাবে দৈনিক করতে হয় তাহলেও তা ঠিক শিক্ষকের কাছ থেকে শিখতে হয়---যাঁর শরীর বিদ্যা ও চিকিৎসা বিদ্যা সম্বন্ধে জ্ঞান আছে৷ যদি তা না করা হয় তবে লাভের থেকে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশী থাকবে৷ উদাহরণ স্বরূপ---শীর্ষাসন৷ শীর্ষাসন সবাইকে করানো যায় না৷ যদি ধরুন কারুর হার্টের সমস্যা বা দাঁতের বা চোখের অথবা দেহের ঊধর্বাংশের কোন না কোন বড় সমস্যা আছে আর আপনি শীর্ষাসন করলেন, তার জন্য আপনার বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে৷ সর্বাঙ্গাসন যাঁরা হাই প্রেসারে ভুগছেন তাঁদের করা চলবে না৷ যদি করেন তবে মৃত্যুকে আমন্ত্রণ করবেন৷ আবার কোন কোন মানুষ আসনের সঙ্গে প্রাণায়ামও অভ্যাস করেন৷ কিন্তু দুঃখের বিষয়, যে কোন প্রাণায়াম করতে গেলে আপনাকে অবশ্যই সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করতে হবে, নচেৎ ক্ষতির সম্ভাবনা যা আপনার জানা নেই৷ প্রাণায়ামের আরো অনেক নিয়ম-কানুন আছে, এসব না জেনে প্রাণায়াম করা বিপজ্জনক৷

তাই এ সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদের আসন, প্রাণায়াম বা যোগসাধনা সম্পর্কে, এর অতীত ইতিহাস ও বৈজ্ঞানিক দিকটাও জানতে হবে৷ যোগ বলতে যোগ সাধনা৷ সাধনার আদি প্রবর্তক সদাশিব৷ তিনি তন্ত্র সাধনারও আদিগুরু৷ আসলে তন্ত্রসাধনারই একটি সূক্ষ্ম-তর দিক হচ্ছে যোগসাধনা৷ বিভিন্ন প্রকারের যোগসাধনা আছে---যেমন হঠযোগ, রাজযোগ, অষ্টাঙ্গিক যোগ, রাজাধিরাজ যোগ ইত্যাদি৷ এসবের আদি প্রবর্র্তক কিন্তু সদাশিব৷ আজ থেকে ৭০০০ বছর পূর্বে সদাশিবের দেওয়া মূল তন্ত্র বা যোগ সাধনা যার অধিকাংশটাই হারিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু রয়ে গিয়েছিল সহজিয়া সাধনা, রাজাধিরাজ যোগ সাধনা, অষ্টাঙ্গিক যোগ ও অন্যান্য কিছুতে অল্প পরিমাণে৷ আনন্দমার্গের সমগ্র সাধনা পদ্ধতিতে পূর্বোক্ত সাধনাগুলির বিশুদ্ধ ও বৈবহারিক রূপ যদি ৩০ শতাংশ বা ৪০ শতাংশ হয়, তাহলে এর বাকী প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ আনন্দমার্গের প্রবক্তা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী প্রদত্ত৷ তিনি যেমন অষ্টাঙ্গিক যোগের দার্শনিক ও বৈবহারিক দিককে নানাভাবে উন্নত করেছেন, তেমনি রাজাধিরাজ যোগকে আজকের যুগের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী ও আগামী কয়েক হাজার বছর পরেও উন্নততর মানুষের মানসিক-আধ্যাত্মিক প্রয়োগ বুঝে বা তাঁর সর্বজ্ঞ দৃষ্টিতে অবলোকন করে, সযত্নে নতুন করে তৈরী করেছেন ও সমৃদ্ধ করেছেন৷

তন্ত্র হচ্ছে--The practical spiritual cult. (বোধি জ্ঞানের বিজ্ঞান) যা কিনা আজ থেকে ৭ হাজার বছর পূর্বে সদাশিব দিয়েছিলেন৷ যা পরবর্তীকালে যোগ-তন্ত্র সাধনা হিসাবে পরিচিতি লাভ করে৷ ২৩০০ বছর আগে মহর্ষি পতঞ্জলি হারিয়ে যাওয়া এই বিজ্ঞানকে আবার  systematic  ঢং য়ে আনলেন ও অষ্টাঙ্গিক যোগ সাধনার সূত্র দিলেন। মহর্ষি পতঞ্জলি  জন্মেছিলেন বর্ধমান জেলার পাতুন গ্রামে৷

এখন থেকে ২০০০ বছর আগে আার এক যোগী পুরুষ অষ্টবক্রমুনি বীরভূমের বক্রেশ্বরে রাজকুমার অলর্ককে ‘রাজাধিরাজ যোগ’ নামে উচ্চস্তরের যোগ সাধনা শিখিয়েছিলেন৷

অনেক দিন পেরিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে অনেক কিছু, অনেক কিছুতে বেনোজল ঢুকেছে৷ তাই বর্তমান কালের উপযোগী করে ও আগামী ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বোধি জ্ঞান জাগানোর দিকে লক্ষ্য রেখে আনন্দমার্গের প্রবক্তা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী যোগসাধনার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন৷

বর্তমানে ভৌত বিজ্ঞানের প্রভূত পরিমাণে উন্নতির ফলে আমাদের জীবন হয়ে উঠেছে গতিময়৷ আমরা অতি অল্প প্রয়াসে অনেক বেশী পেতে চাই৷ বর্তমানের মানুষের বুদ্ধি এতই বেড়েছে যে একবুদ্ধি বা শতবুদ্ধি নয়, হয়েছে সহস্র বুদ্ধির অধিকারী৷

‘তাইতো সহস্র বুদ্ধির বাদানুবাদে

আমাদের জীবন হয়নি আবাদ,

সমাজ ও আমাদের জীবনকে করেছে বরবাদ৷’

প্রতিটি মানুষের মধ্যে একটি বিশেষ অন্তর্নিহিত এষণা আছে৷ সেই দিক দিয়ে মানুষে-পশুতে, মানুষে-উদ্ভিদে পার্থক্য হয়ে যায়৷ এই যে আধ্যাত্মিক এষণা সেটাই হচ্ছে মানুষের ধর্ম৷ তাহলে মানুষের ধর্ম কী? মানুষ চায় নিজেকে বিস্তার করতে (Expansion), তার সঙ্গে সে চায় ঈশ্বরের (ভূমা) সঙ্গে মিলেমিশে এক হতে৷ সে চায় শান্তি, নিরবচ্ছিন্ন শান্তি, পরমা শান্তি৷৷ এগুলি হচ্ছে মানুষের বৈশিষ্ট্য৷

সংস্কৃতে দু’টি মূল ধাতু থেকে যোগ শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে৷ একটি ‘যুজ্’, অপরটি ‘যুঞ্জ্’৷ ২+ ২= ৪, ৩+৩ = ৬, এগুলি হল যোগ  = Addition, ‘যুজ্’ ধাতু সঞ্জাত৷ আর ‘যুঞ্জ্’ ধাতু থেকে যে যোগ নিষ্পন্ন হয়েছে তার অর্থ কিন্তু Addition নয় Unification৷ উদাহরণ স্বরূপ---চিনি আর জলের মিশ্রণে চিনি বা জলের কোন পৃথক অস্তিত্ব থাকে না৷ মিলে মিশে এক হয়ে যায়৷ কিন্তু চিনি ও লবন মেশালে দুইয়ের পৃথক অস্তিত্ব থাকছে৷ এটা Addition৷ আধ্যাত্মিক স্তরে যে যোগ তা যুঞ্জ্---ধাতু সঞ্জাত৷ অণুমন অর্থাৎ Unit Mind অর্থাৎ আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ মন যখন পরমপুরুষ বা ঈশ্বরের মনের  Cosmic Mind এর সঙ্গে এক হয়ে যায় – তখন আর অণুমন  অর্থাৎ unit mind এর আর কোনো পৃথক কোনো অস্তিত্ব থাকছে না। একেই প্রকৃত পক্ষে যোগ বলা হয়।  

 

প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে দু’টো আমি আছে৷ একটি হচ্ছে তার যে নাম---সেটি হচ্ছে তার ছোট আমি অর্থাৎ Unit Mind, আর বড় আমি হচ্ছে ঈশ্বরের অর্থাৎ পরমপুরুষের মন  অর্থাৎ Cosmic Mind৷ ‘‘পৃথিবীতে নানা রকমের অস্তিত্ব আর তাদের কত রকমের নাম৷ সেই নামগুলি হচ্ছে ছোট আমি আর এই মহাবিশ্বের যিনি নিয়ন্ত্রক তিনি বড় আমি৷ CosmicMind  এক ও অবিভাজ্য৷ জীবমনের সঙ্গে পরমপুরুষের যে সংযোগ---এটাই যোগের সারকথা৷ এখানে ভক্তির মুখ্য ভূমিকা৷ এটি আধ্যাত্মিক স্তরের যোগ৷ এর জন্যে শরীরের ও মনের বিকাশও দরকার৷ তাই এসবও যোগের অঙ্গ৷ তাই যোগ জীবনের সার্বিক বিকাশের পথ৷ মানুষের জীবনে প্রত্যেকটি স্তরেই যোগের আবশ্যকতা আছে৷

পৃথিবীতে আজ উন্মাদ রোগগ্রস্তদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে৷ এতে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে---আমাদের এই পৃথিবীতে মানসিক সমস্যার সমাধানের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই৷ এছাড়া স্থূল শরীর ও আধ্যাত্মিক জীবনও আছে৷ আধ্যাত্মিক প্রগতির শেষ বিন্দু হচ্ছে পরমপুরুষ অর্থাৎ ঈশ্বর৷ যদি কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক স্তরে যোগ থাকে আর জাগতিক ও মানসিক স্তরে যোগ না থাকে---তাহলে কী হয়? মানুষের অস্তিত্বের ভারসাম্য অর্থাৎ সাম্যাবস্থা নষ্ট হয়ে যায়৷ এই কারণেই জীবনের সর্বস্তরেই যোগের অনুশীলন প্রয়োজন আছে৷ মানুষের মধ্যে রয়েছে কত শত বৃত্তি৷ সেই কারণে মানুষের মন স্থির না থেকে স্থান থেকে স্থানান্তরে ছুটে চলেছে৷ আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান অনুযায়ী মানুষের মূল বৃত্তি হচ্ছে পঞ্চাশটি৷ আর সেইগুলি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিকভাবে দশ দিকে---অর্থাৎ ছ’টি প্রদিশ---পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর,দক্ষিণ, ঊধর্ব ও অধঃ৷ আর চারটি অনুদিশ---অর্থাৎ ঈশান, নৈঋৃত, অগ্ণি, বায়ু অর্থাৎ কুড়িটি গতিধারায় প্রধাবিত হচ্ছে৷ তাই আমাদের শরীরের বৃত্তি সংখ্যা ৫০× ২× ১০= ১০০০। মানুষের শরীরের সহস্রার চক্র কতৃক এই ১০০০ বৃত্তির নিয়ন্ত্রিত হয়, জাকে আমরা Medical science এ Penial gland বলি। এই নিয়ন্ত্রন কেন্দ্র অচেতন স্তরে অবস্থিত। তাই এই চক্র এস সহস্র অভিব্যক্তির সঙ্গে সম্বন্ধিত৷ এখন মানুষ যদি এই সব প্রবৃত্তিকে প্রত্যাহার করে নিয়ে সামবায়িকভাবে সেগুলিকে পরমপুরুষ বা ঈশ্বরের দিকে চালিত করার চেষ্টা করে তখন একে বলা হয় যোগ সাধনা৷ তবে ভক্তির সহায়তা ছাড়া পরমপুরুষের সঙ্গে মিলন সম্ভব নয়৷

প্রাচীনকালে যোগীগণ বিভিন্ন ভাবে যোগের ব্যাখ্যা করেছেন৷ মহর্ষি পতঞ্জলি বলেছেন---‘যোগশ্চিত্তবৃত্তি নিরোধঃ’ অর্থাৎ চঞ্চল মনের বৃত্তিগুলোকে বা বৃত্তির অভিব্যক্তিগুলোকে যদি নিরুদ্ধ বা স্তব্ধ করে দেওয়া হয় তা হ’ল যোগ৷ আমরা কিন্তু এই ধরণের ব্যাখ্যাকে বা অভিমতকে যোগের যথার্থ ব্যাখ্যা বলে মনে করি না, কারণ অজ্ঞান বা মুর্চ্ছা অবস্থায় মন কাজ বন্ধ করে দেয় অর্থাৎ নিরুদ্ধ হয়ে যায়৷ তাকে যোগ বলা যাবে না৷ আর একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে ‘সর্বচিন্তা পরিত্যাগ নিশ্চিন্তে যোগ উচ্যতে’ অর্থাৎ মনেব যাবতীয় চিন্তা ভাবনা বা চিন্তা তরঙ্গকে মন থেকে সরিয়ে নিয়ে একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়াও ঠিক আধ্যাত্মিক যোগ নয়, কেননা মন থেকে চিন্তা দূরীভূত হলেই আধ্যাত্মিক যোগ হয় না৷ যেমন দুঃখের সময় কোন মানুষ ওষুধ খেয়ে কিছুক্ষণের জন্যে শুয়ে পড়লেন, যেমন ধরুন এক ঘণ্টা৷ এই এক ঘণ্টা সময় তিনি মোটামুটিভাবে শান্তিতে কাটাবেন৷ এই সাময়িক চিন্তাহীনতার অবস্থাটা তো আর আধ্যাত্মিক যোগ নয়৷ তাই এই ব্যাখ্যাটাও গ্রহণযোগ্য নয়৷

এই প্রসঙ্গে তন্ত্রের ব্যাখ্যা কী? ‘সংযোগ যোগো’ ইত্যুক্ত জীবাত্মা-পরমাত্মনঃ’---অর্থাৎ জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার যে সংযোগ তাই যোগ পদবাচ্য৷ আগেই বলা হয়েছে যোগের অর্থ Additionîy Unitylëû Unification৷ জীবমন যখন ঈশ্বরের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায় তা-ই হ’ল যোগ৷ তখন মানুষ তার জীবনের চরম লক্ষ্যে উপনীত হয়৷ তাই যোগ হচ্ছে প্রগতির পথ৷ প্রতিটি মানুষের ক্রমোন্নতির মাধ্যমে এগিয়ে চলার পথ৷ যোগের পথ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা হ’ল অধোগতির পথ---পশুত্বের পথ৷ আর যোগের পথে এগিয়ে চলা হ’ল দিব্য জীবনের পথ---জীবনের পরিপূর্ণ আনন্দ লাভের পথ৷ তাই যোগই হচ্ছে ধর্ম৷