আন্তর্জাতিক যোগদিবস ও আমরা

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

গত কয়েক বছর যাবৎ জুন মাসের ২১ তারিখ দিনটিকে ‘‘আন্তর্জাতিক যোগ দিবস’’রূপে পালন করা হচ্ছে ও সেই দিবসে সংবাদপত্র, দূরদর্শন তথা অন্যান্য স্যোশাল মিডিয়া যেমন-ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ইন্টারনেট ইত্যাদিতে যোগচর্র্চর সুফল সম্বন্ধে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়৷ গণমাধ্যম গুলিতে দেখা যায় মন্ত্রী সান্ত্রী, ষড়যন্ত্রী, কূটতন্ত্রী, লুটতন্ত্রী সকলেই যে যার মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালন, পেট ফোলানো কমানো, নাকটিপে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্ষেপন, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও বিশাল প্যান্ডেলে বহু মানুষজন একসাথে যোগব্যায়াম প্রদর্শন-প্রশিক্ষণ কর্মে ব্যস্ত৷ খুবই আনন্দের বিষয় যে, এইভাবে যোগদিবস পাালনের মাধ্যমে বৃহত্তর জনসমুদায়কে যোগাভ্যাসের প্রতি মনোযোগী ও স্বাস্থ্য সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ মোটামুটিভাবে সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা সকলেই জানি যে, যোগাসন ও প্রাণায়ামের দ্বারা আমাদের শারীরিক সুস্থতা, নীরোগ জীবন যাপন, মানসিক ক্লান্তি ও অবসাদ থেকে মুক্তি সম্ভব হয়৷ বস্তুত সুদীর্ঘ কয়েক হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষের মুনিঋষিগণ আধ্যাত্মিক সাধনার অঙ্গ হিসেবে যোগ ব্যায়াম, আসন, প্রাণায়াম, ধ্যানক্রিয়া, ইত্যাদি গুরুশিষ্য পরম্পরায় প্রশিক্ষণ দিয়ে এসেছেন ও ভারতবাসীগণ যোগাভ্যাসকে তাদের জীবনের অবশ্যই করণীয় কর্মরূপে গ্রহণ করেছেন৷ আধুনিকযুগে এই ভারতেরই প্রশিক্ষিত যোগাচার্যগণ দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন যোগাশ্রম বা যোগশিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করে সর্বসাধারণের জন্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন৷ যোগাসন-প্রাণায়ামের সুফলের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে বিভিন্ন দেশের মানুষ উপকৃতও হয়েছেন৷ এই যোগ চর্র্চই বর্তমানে আধুনিকতা প্রাপ্ত হয়ে ইয়োগা (Yoga) নামে নব কলেবরে আর্বিভূত হয়েছে৷ সাধারণতঃ বিত্তশালী ও তথাকথিত সেলিব্রিটিরূপে পরিচিত ব্যষ্টিগণ ইয়োগা বা যোগা শব্দটিকে এক বিশেষ-মাত্রিক স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে ব্যবহার করেন, যার সঙ্গে সাধারণ যোগাসন-প্রাণায়ামের কোন পার্থক্য নেই৷ তবে যোগচর্চা সম্বন্ধে সকল মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রাত্যহিক জীবনে অনুশীলনের প্রতি আগ্রহ নিঃসন্দেহে একটি শুভ লক্ষণ৷

এখন দেখা যাক, ‘যোগ’ ব্যাপারটা ঠিক কী! যোগ শব্দটির মধ্যে যুক্তকরণ বা সংযুক্তির অর্থাৎ মিলনের সংকেত নিহিত রয়েছে৷ যোগাভ্যাসের দ্বারা একদিকে যেমন মানবিক অস্তিত্বের ত্রি-স্তরীয় বিন্যাস অর্থাৎ শরীর, মন ও আত্মার মধ্যে সম্মিলিতভাবে        সুসামঞ্জস্য বিধান সম্ভব,অপরদিকে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানবীয় স্তরের অণু-আত্মাকে বৃহৎ পরমাত্মার প্রতি অগ্রসরণের আত্যন্তিকী এষণাকে জাগিয়ে তোলা ও পরবর্তী পর্যায়ে সমগ্র সৃষ্টিকে পরমপুরুষ তথা পরমাত্মার প্রতিভূ হিসেবে গ্রহণ ক’রে এক মহা মিলন ক্ষেত্রে পরিণত করা ও সর্বশেষে সেই পরমাত্মার মধ্যেই বিলীন হয়ে যাওয়া--- এটাই হচ্ছে যোগের প্রকৃত উদ্দেশ্য৷ এই শিক্ষা-ই ভারতের মহামানব ও মনীষীগণ মানুষকে দিয়ে এসেছেন আর এটিই হচ্ছে ভারতবর্ষের মহান সংসৃকতি ও সুপ্রাচীন ঐতিহ্য৷ তাই শুধুমাত্র শারীরিক বা মানসিক সুস্থতা বিধানই যোগের উদ্দেশ্য নয়--- বরং এর প্রয়োগ আরও ব্যাপক ও বহুমুখী৷

‘যোগ’ শব্দটির বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যাখ্যা করা হয়েছে৷ তাদের মধ্যে ভগবান সদাশিব প্রদত্ত সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞান সম্মত, যুক্তি সম্মত ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হচ্ছে---সংযোগো যোগ ইত্যুক্তো জীবাত্মা-পরমাত্মনঃ৷ যুজ্-ধাতুর সঙ্গে               ঘঞ্ -প্রত্যয় করে যোগ শব্দটি পাওয়া যায়, যার অর্থ হচ্ছে যুক্ত করা৷ যেমন + ২= ৪ Addition)

যুন্জ্-ধাতুর সঙ্গে ঘঞ্-প্রত্যয় করেও যোগ শব্দ নিষ্পন্ন হয় যার অর্থ হচ্ছে সংযুক্ত করা বা হওয়া Unification ) অর্থাৎ মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়া৷ যেমন চীনী জলে মিশে যাওয়া যেখানে চীনীকে আর খঁুজে পাওয়া যাবে না৷ তাই জীবাত্মা যখন আধ্যাত্মিক সাধনার দ্বারা পরমাত্মায় মিলে মিশে এক হয়ে যায় তখনই যোগ সাধনার সার্থক রূপ প্রাপ্ত হয়৷

যোগ সাধনা নিরন্তর অনুশীলনের মাধ্যমেই মানুষ দেবত্বে উপনীত হতে পারে ও এই যোগসাধনা ৮টি বিভিন্ন পর্যায়ে বিন্যস্ত, যেমন- যম,নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার , ধারণা, ধ্যান, ও সমাধি৷ তাই এই সাধনাকে অষ্টাঙ্গিক যোগসাধনা বলা হয়৷ সাধনার প্রতিটি পর্যায়ের মধ্যে সংগতি বিধান ও বিশেষ প্রক্রিয়ার দ্বারা শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি উপগ্রন্থির ক্রিয়াশীলতাকে উজ্জীবিত করে বৃত্তিগুলিকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়৷ সাধারণত কু-প্রবৃত্তিগুলির তাড়নায় মন বিক্ষিপ্ত হয়ে অধোমুখী ও বিভিন্ন রকম কু-ভাবনা, কু-কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে ৷ সেই কারণে মনকে সন্তুলিত রাখার জন্যে অষ্টাঙ্গিক যোগসাধনার পর্যায়গুলি খুবই সহায়ক হয়৷ মন সদাই চঞ্চল, কখনও একটি বিষয়ে নিবদ্ধ থাকে না, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ছুটে চলে৷ মানুষ লক্ষ লক্ষ জন্মের পর বিবর্তনের ধারা প্রবাহে মনুষ্যজন্ম লাভ করে৷ ফলে নিম্নস্তরীয় জীবনের অভিজ্ঞতা থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মন সহজেই নিম্নাভিমুখী হয়৷ তাই যম-নিয়ম আসন প্রাণায়ামের দ্বারা মনকে নিয়ন্ত্রিত রেখে উর্ধমুখী করার নিরন্তর প্রয়াস চালাতে হয়৷ নচেৎ যেকোনো সময়ের ক্ষণিক দুর্বলতা তাকে অধোমুখী করে ফেলে ৷ ফলশ্রুতিতে একজন            সৎ-ধার্মিক মানুষও কু-বৃত্তির দ্বারা পরিচালিত হয়ে দুষ্কর্ম করে বসে৷ বর্ত্তমান সমাজে ক্রমবর্ধমান হিংসা, দুর্নীতি, যৌনতা, পাপাচার, ব্যাভিচার ইত্যাদির মূল কারণ হল লোভ, লালসা, কামনা, বাসনা, ঈর্র্ষ ইত্যাদি কু-প্রবৃত্তিগুলির নাগপাশ৷ সুশৃঙ্খল জীবনযাপন ও দৃঢ় আধ্যাত্মিক ভিত্তি না থাকলে এই নাগপাশ ছিন্ন করার সামর্থ্য মানুষের নেই৷ কেউ হয়তো একলক্ষ টাকার লোভ সামলে নিতে পারবে, কিন্তু কোটি টাকায় তাকে বশীভূত করার ঘটনা ঘটতেই পারে৷ ঠিক একই কারণে সমাজ জীবনে দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার, ইত্যাদি চলতেই থাকবে৷ তাই মানুষকে নীতিবাদ ও সত্যনিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত হতে হলে আধ্যাত্মিকতার আশ্রয় নিতেই হবে ও সদ্গুরু নির্দেশিত পথে অবিচল থেকে বীরবিক্রমে এগিয়ে চলতে হবে৷

যোগ সাধনার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র শারীরিক বা মানসিক সুস্থতা বিধানই নয়, মানুষের সর্বাত্মক উন্নতির জন্যে সদর্থক পথ-প্রদর্শন৷ এরফলে এক দিকে মানুষের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্তরে আসে সন্তুলন, অপরদিকে অধ্যাত্ম স্তরে উন্নতির ফলে মন বৃহতের ভাবনায় ভাবিত হতে থাকে৷ মনের ধর্ম হল- সে যার ভাবনায় ভাবিত হয়, ক্রমশ তারই রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে৷ প্রতিনিয়ত বৃহতের ভাবনা মানুষের মনের বিস্তার ঘটায় ও শুভগুণাবলীর উন্মেষের মাধ্যমে তাকে ক্রমে পরমাত্মার দিকে এগিয়ে চলতে সাহায্য করে ও সমগ্র সৃষ্টিকে স্রষ্টার মূর্ত প্রকাশ ভেবে সে তাতেই একাত্ম হয়ে পড়ে৷ বলা হয়েছে--- যাদৃশী ভাবনার্যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী৷ বিশ্ব চরাচরের সমস্ত জীব-জড়,              চেতন-অচেতন সকলের মাঝে পরমাত্মার পবিত্র উপস্থিতি অবলোকন করে সে ধন্য হয়ে যায় ও ধূলির ধরণীতে স্বর্গের অনুভূতি প্রাপ্ত হয়৷

বিশ্বের প্রতিটি মানুষ যদি প্রকৃত অষ্টাঙ্গিক যোগসাধনার দ্বারা (শুধু মাত্র আসন প্রাণায়াম নয়) নিজেদের সর্বাত্মক উন্নতি বিধান করতে পারে, তবে অচিরেই সমাজ থেকে সমস্ত পাপাচার,অশুভকর্ম,অন্যায় দূরীভূত ও মানুষের সাথে মানুষের তথা মানুষের সাথে অন্যান্য জীবজড়সহ সকল সৃষ্টির এক নিবিড় যোগসূত্র রচিত হবে৷ আর এই মহামিলনের আগ্রহাতিশয্যেই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে সার্থক নব্যমানবতাবাদ৷ এক মাত্র তখনই আমরা যোগসাধনার মাধ্যমে আমাদের জীবনকে শুদ্ধ ও পবিত্র করে শুভপথে পরিচালনার দ্বারা পৃথিবীতে সত্য, ধর্ম , ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও সুন্দর শোষণমুক্ত নোতুন পৃথিবী রচনা করতে পারব৷ নিছক লোক দেখানো প্রচারের জন্যে যোগ দিবস উদ্যাপন না করে যোগ সাধনাকে দৈনন্দিন জীবন চর্র্যর ব্যবহারিক অঙ্গ হিসাবে গ্রহণ করে নিজের , সমাজের, ও সমগ্র বিশ্ব সৃষ্টির মঙ্গল বিধানে আন্তরিকভাবে প্রয়াসী হলেই যোগ দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্যে সাধিত হবে৷ প্রকৃত পক্ষে বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে এই সংকল্প সাধনে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সর্বাঙ্গ সুন্দর,হিংসা-দ্বেষ গ্লাণিমুক্ত শোষণহীন সমাজব্যবস্থা উপহার দিতে হলে এ ভিন্ন আর কোনো পথ নেই৷