সম্প্রতি রামনবমী উপলক্ষ্যে ও পরে হনুমান জয়ন্তী উপলক্ষ্যে এ রাজ্যে বিজেপি ও তার শাখা সংঘটনগুলির তরফ থেকে সারা রাজ্যে ত্রিশূল, তলোয়ার, কুড়ুল, কুঠার নিয়ে প্রকাশ্যে মিছিল হ’ল৷ এই বাঙলায় রামনবমী উপলক্ষ্যে এই ধরণের মিছিল আগে হয়নি৷ হনুমান জয়ন্তীতেও এই ধরণের অস্ত্র নিয়ে লাফালাফি আগে হয়নি৷ এ রাজ্যে হনুমান পূজো তো আগে হতই না৷ এবছর বিহার, উত্তরপ্রদেশের মতো কলকাতারও রাস্তার মাঝে বিজেপি সমর্থকরা বিশাল বিশাল হনুমান মূর্ত্তিও বসিয়েছে৷ কলকাতার বিধাননগর ষ্টেশনের পাশেও দেখলাম এই ধরণের বিশাল ২৪ ফুট হনুমান মূর্ত্তিও বসানো হয়েছে৷
বাঙলায় এমন ঘটা করে হনুমান পূজো আগে কখনও হয়নি, আর ত্রিশূল, তলোয়ার সহযোগে রাম, হনুমানকে কেন্দ্র করে মিছিল কোনদিনও হত না৷ আসলে এর সঙ্গে ধর্মীয় আবেগের কোনও সম্পর্ক নেই৷ এটা স্রেফ রাজনৈতিক কারণে৷ উত্তরপ্রদেশ সহ কয়েকটি রাজ্যে ক্ষমতায় এসে বিজেপি এখন পশ্চিমবাঙলার গদি দখল করার উৎসাহে এই নতুন ধরণের কর্মসূচী নিয়েছে৷
এই কারণে বিজেপি তার হিন্দুত্ববাদকে হাতিয়ার করে এ রাজ্যে তার প্রভাব বিস্তার করার কৌশল ফেঁদেছে৷ বিজেপির হিন্দুত্ববাদকে পুষ্ট করা মানেই জনমনে মুসলিম বিরোধী সেণ্টিমেণ্টকে বাড়িয়ে তোলা৷ মূলতঃ মুসলিম বিরোধী সেণ্টিমেণ্টকে হাতিয়ার করে বিজেপি সর্বত্র জনগণের থেকে বোট (ভোট) আদায় করেছে৷ প্রকাশ্যে উন্নয়নের শ্লোগান দিলেও অপ্রকাশ্যে সংখ্যালঘু বিরোধী সেণ্টিমেণ্টটাই এদের প্রধান অস্ত্র৷
বস্তুতঃ বিজেপির এই নীতি বাঙালীর গৌরবমূলক সংস্কৃতির বিরোধী৷ বাঙালী ঐক্যকে, বাঙালী জাতীয় সত্তাকে নষ্ট করার এ এক সুগভীর ষড়যন্ত্র৷ এই ষড়যন্ত্র কর্পোরেট মহলের, পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদীদেরই এক ষড়যন্ত্র৷ বাঙালীর জাতিসত্তাতে হিন্দু মুসলমান ঐক্য অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত৷ ওপার বাঙলায় ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারীর বিখ্যাত ভাষা আন্দোলন ছিল এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদ আন্দোলন৷ এই আন্দোলনই পরবর্তীকালে পাকিস্তানের কবল থেকে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল৷ এই আন্দোলনই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রসংঘে স্থান করে দিয়েছে ও এই আন্দোলনের তারিখটিকেই রাষ্ট্রসংঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে বাংলা ভাষাকে মহিমান্বিত করেছে৷
বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বড়লাট লর্ড কার্জন বাঙালী জাতিকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্যে ‘বঙ্গভঙ্গ’ আইন পাশ করেছিল৷ অবিভক্ত বাঙলার মুসলীম প্রধান পূর্বাংশকে হিন্দুপ্রধান পশ্চিমাংস থেকে পৃথক করার চেষ্টা করেছিল৷ তারই প্রতিবাদে সারা বাঙলা জুড়ে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যাকে বাঙলার ‘অগ্ণিযুগ’ বলা হয়৷ শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করেছিল, কিন্তু সুকৌশলে বাঙলার কৃষিতে উর্বর উত্তরাংশকে অসমের সঙ্গে ও খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ পূর্বাংশকে বিহারের সঙ্গে যুক্ত করে বাঙলাকে হীনবল করার নূতন কৌশল নিয়েছিল৷
ব্রিটিশের ষড়যন্ত্রে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্যেই তার কৌশলী ‘ডিভাইড অ্যাণ্ড রুল’ পলিসি অনুসারে তাদের আনুকুল্যে মুসলীম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল৷ এই কারণেই কবি নজরুল সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন৷
‘‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?
কাণ্ডারী, বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার৷’’
১৯৪৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় এই অস্ত্র দিয়েই তারা কংগ্রসের তৎকালীন নেতৃত্বের বোকামির সুযোগ নিয়ে বা ক্ষমতার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের বশ করে অখণ্ড ভারতকে খণ্ডিত করেছিল, তার চরম কুফল আজও আমাদের ভুগতে হচ্ছে৷ এদেশের বিপুল সম্পদ যার পুরোটাই উন্নয়নের কাজে লাগানো যেত, তার বৃহদংশ এখন ব্যয় করতে হচ্ছে সীমান্তপারের ভারত বিরোধী শক্তিকে মোকাবিলা করতে৷ বাঙালী জাতির মধ্যে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের সেণ্টিমেণ্টেকে উৎসাহ দিয়ে কি পশ্চিমবঙ্গে, কি উত্তর পূর্বাঞ্চলে সর্বত্র পর্দার আড়াল থেকে ষড়যন্ত্রকারী সাম্রাজ্যবাদী শোষক গোষ্ঠী বাঙালী ঐক্যকে নানাভাবে দুর্বল করে বাঙালী জাতির চরম ক্ষতি সাধন করেছে ও আজও করছে৷ সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী শোষকগোষ্ঠীর এজেণ্ট বিজেপি বর্তমানে অসমে ক্ষমতায় থেকে এই একই বিচ্ছিন্নতাবাদী অস্ত্র প্রয়োগ করে সেখানকার বাঙালীদের ওপর চরম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে৷ বাঙালীর জাতীয় সত্তাকে রক্ষা করতে গেলে বিজেপির এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সমস্ত বাঙালীদের সচেতন হতে হবে৷ সস্তা সাম্প্রদায়িক সেণ্টিমেণ্টকে মদত দিয়ে বড়জোর একটা সাম্প্রদায়িক দলের শক্তিবৃদ্ধি করা যায়৷ কিন্তু তাতে বাঙালী জাতির সর্বনাশ ডেকে আনা হবে৷
কোন অঞ্চলের অর্থনৈতিক, সাংসৃকতিক, সামাজিক সমস্ত প্রকার উন্নয়নের সর্বপ্রধান শর্ত হ’ল ওই এলাকার মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস৷ ঐক্য, সম্প্রীতি ও শ্রীবৃদ্ধি --- এর মূলে কুঠারাঘাত করে কোনও এলাকার প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়৷ তাই সংকীর্ণ সেণ্টিমেণ্টে না মজে বৃহত্তর উন্নয়নের আদর্শকে সামনে রেখে আমাদের এগোতে হবে৷ এর কোনও বিকল্প নেই৷
- Log in to post comments