ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যাকান্ডের নাম---স্বচ্ছ বদমাস অভিযান

লেখক
মিহির কুমার দত্ত

যোগী  আদিত্যনাথের রাজ্য উত্তরপ্রদেশে  ‘ক্রিমিনাল’ তকমা লাগিয়ে  সাধারণ  মানুষকে ভুয়ো সংঘর্ষে মেরে ফেলার ক্ষমতা পেয়েছে পুলিশ৷ মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে  বসেই এই কাজে  সাড়া ফেলেছেন যোগী আদিত্যনাথ৷ মানুষ মারার কৌশল আবিষ্কার করার পর   তার একটা  সুন্দর নামও দেওয়া হয়েছে৷  ‘স্বচ্ছ বদমাস অভিযান’৷

গত এক বছরে  উত্তরপ্রদেশের  মিরাট, সামলি, মুজফ্ফরনগর, সাহারানপুর, গাজিয়াবাদ, নয়ডা ও বাঘপত জেলায় মোট এনকাউন্টার ঘটেছে ১৫০০ টি৷ এখন পর্যন্ত মারা গেছে ৫০-এর বেশি, আহত হয়েছে ৫০০-এর বেশি৷  পুলিশ প্রতিক্ষেত্রেই এই কারণ ও বয়ান লিখেছে৷ ‘ক্রিমিনাল উইল বি জেইলড  অর কিলড ইন এনকাউন্টারস্’ এমনই এক বিবৃতি মুখ্যমন্ত্রী  গত ২২ নবেম্বর  ২০১৭ তারিখে দিয়েছেন ও তাতে উৎসাহিত হয় উর্দিধারী পুলিশ প্রবল আনন্দে মারতে শুরু করেছে৷

২৭ বছর বয়সী জয়হিন্দ যখন তার বাবার সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিল  তখন  ৬ জন লোক  এসে তাকে  তুলে নিয়ে যায়৷  কয়েক ঘন্টা পরে জানতে পারা যায় জয়হিন্দ এনকাউন্টারে মারা গেছে৷ তার ময়নাতদন্তে জানা যায় তার সারা দেহে  ১৬-১৮টি আগ্ণেয়াস্ত্রের ক্ষতসহ  মোট ২২ টি  আঘাত রয়েছে৷

 সন্ত্রাসবাদী অজুহাতে  পুলিশের  গুলি চালানোতে বছর ত্রিশের যুবক  সুনীল যাদবের  পায়ে ও ৩৫ বছরের জিতেন্দ্র যাদবের গলায় গুলি লাগে৷ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে  থাকা জিতেন্দ্রর ঘটনায়  স্থানীয় মানুষেরা প্রতিবাদ  ও প্রতিরোধ  গড়ে তোলায় চাপে  পড়ে বাধ্য  হয়ে একজন  সাব ইন্সপেক্টর ও তিন কনস্টেবলকে  ‘অ্যাটেম্পট টু মার্র্ডর ’ কেসে দোষী সাব্যস্ত করে সাসপেন্ড করে গাজিয়াবাদ পুলিশ৷

স্থানীয় মানুষ বলতে শুরু করেছে, যে পুলিশদের  সাসপেন্ড করা হয়েছে তা আসলে  আই ওয়াশ ছাড়া  আর কিছুই  নয়৷ কারণ সুনীল ও জীতেন্দ্র যাদব বেশ কিছুদিন ধরেই বিজেপির  আশ্রয়ে  লালিত পালিত  হচ্ছে৷ পুলিশ ভুল করে তাদের গুলি করায় ও মানুষের সমবেত  প্রতিবাদের  জন্যই  মোট ৪ জন  পুলিশের শাস্তি ঘোষণা করা হয়েছে৷  সবচেয়ে আশ্বর্যের বিষয় হলো, বিজেপির  শাসনকালে  এমন এনকাউন্টারের ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও বর্তমান  বিরোধী রাজনৈতিক  শক্তি  কোনওরকম  প্রতিবাদ  করছে না৷ তার কারণ কি? এর উত্তর  খুব সোজা৷ যারাই উত্তরপ্রদেশ, বিহার , ঝাড়খন্ড  রাজ্য  সম্পর্কে  খোঁজ  খবর রাখেন  তারা সবাই  জানেন যে,  সেখানে রাজ-নৈতিক  নেতাদের থেকেও  ক্ষমতাবান হচ্ছে বাহুবলিরা  অর্থাৎ  মস্তান-ডন-গুন্ডারা৷ এরা  এতোদিন  নিজেদের  মতো করে সমান্তরাল শাসন  চালিয়ে এসেছে৷ তারা কোনও রকম রাজনৈতিক নেতৃত্ব  দ্বারা তাদের কাজের সামান্যতম বিরোধিতা কিংবা  তাদের স্বার্থের  পরিপন্থি  কোনও  কাজ হলেই সঙ্গে সঙ্গে সেই নেতা বা কর্মী  বা সাধারণ  মানুষ বা প্রশাসনিক অধিকর্তার  জীবন লীলা সাঙ্গ করে দিয়েছে৷

আগের সব  সরকার  ও তার রাজনৈতিক  দল কখনোই  তাদের  ঘাটাতে সাহস করেনি৷ বরঞ্চ সেই বাহুবলিদের  সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন সময়ে  তাঁরা  প্রতিবাদের  ভাষাকে  চিরদিনের  জন্যে স্তব্ধ  করে দিয়েছে ৷ ভোটকে প্রভাবিত করার জন্য  বাহুবলিদের  দারস্থ হয়েছে৷ তাতে তাদের রাজনৈতিক লাভও হয়েছে৷

যোগী আদিত্যনাথ  শাসন ক্ষমতায় বসার  পর হঠাৎ করেই বহুকাল  ধরে চলে আসা  এই ব্যবস্থা পরিবর্তন করে৷ নিজের রাজনৈতিক  ক্ষমতাকে  বহুগুলে  বৃদ্ধি করার জন্যে এই ‘‘স্বচ্ছ বদমাস অভিযান’’ শুরু করেন৷

এই অভিযানের  আসল উদ্দেশ্য হলো সমস্ত বাহুবলি কিংবা বদমাস হয় বিজেপির  কাছে নিজেদের  সমর্পণ  করো আর তা না হলে  পুলিশের গুলি  খেয়ে  মরো৷ আগামী দিনে প্রমাণ হবে যারা আহত হয়ে হাসপাতালে  চিকিৎসাধীন তারা সুস্থ হয়ে ফিরে  এসে  আবার বদমায়েসি শুরু করে নাকি যোগীর নেতৃত্বে বিজেপি নামক রাজনৈতিক দলের সক্রিয়  সদস্য হিসাবে বাকী জীবনটা ভালোভাবে কাটানোর চেষ্টা করে৷

নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের  মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন  একই কায়দায়  ‘সন্ত্রাসবাদী’ ছাপ্পা মেরে ইশরাত জাহান  ও সোহরাবুদ্দিন শেখকেও হত্যা  করা হয়েছিল৷ গুজরাটে ২০০৪ সালে  আহমেদাবাদে  সুপরিকল্পিতভাবে ইশরাত জাহান ও তার তিন সঙ্গীকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছিল ও গান্ধীনগরে ঠান্ডা মাথায় ছক কষে, সন্ত্রাসবাদী যোগ এই অভিযোগে  সোহরাবুদ্দিন শেখকে হত্যা করেছিল৷ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তথ্য অনুযায়ী  এরকম ঘটনার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে উত্তর প্রদেশ৷

সাধারণ মানুষকে ‘ক্রিমিনাল’ সাজিয়ে হত্যার ঘটনায় গুরু নরেন্দ্র মোদীর সুযোগ্য চেলা যোগী আদিত্যনাথ৷  আর আজ তার স্বপ্ণের প্রকল্পের বাস্তব রূপ দিচ্ছে পুলিশ৷ যোগী আদিত্যনাথ সন্ন্যাসী হলেও তার বিরুদ্ধে ১৯৯৯ সালে সমাজবাদী পার্টির নেতা তালাত আজিজের সভায় হামলার অভিযোগ আছে৷ তার নির্দেশেই ওই হামলার  ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়৷ আদিত্যনাথ ২০০২ সালে  হিন্দু যুব বাহিনী তৈরী করেন৷  এই বাহিনী নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷ এই বাহিনী গোরক্ষা কার্যক্রম শুরু করে৷  এছাড়া লাভ জিহাদ নিয়ে কড়া  অবস্থান নেয় এই বাহিনী৷  এইজন্যে তাকে জেলও খাটতে হয়েছিল৷

সূত্র---ইন্ডিয়া টিভি নিউজ৷

যদিও এখনও তার বিরুদ্ধে দু-দুটো মামলা চলছে৷

এছাড়াও আসামের লক্ষ্মী ওরাও নামের এক আদিবাসী মহিলা যোগী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে  তাঁর নগ্ণ ছবি সোস্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করার অভিযোগে ভারতীয়  দন্ডবিধির  একাধিক  ধারায় ও তথ্য প্রযুক্তি আইনের  বিভিন্ন ধারায়  সাব ডিভিশনাল  জুডিশিয়াল  মেজিস্ট্রেটের  কাছে মামলা  দায়ের করেছেন৷ প্রায় দশ বছর  আগে  ওই নগ্ণ ছবি পোষ্ট করা হয়৷  সেই পোষ্টে বলা যে,  এই হিন্দু  মহিলাকে  নগ্ণ করে দেয় কংগ্রেস কর্মীরা  কারণ ওই মহিলা নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপির সমর্থনে স্লোগান  দিচ্ছিলেন৷ কিন্তু  লক্ষ্মী ওরাও জানান ২৪ নবেম্বর  ২০০৭ সালে  তোলা হয় সেই ছবিটি৷ সে সময় তিনি কোন রাজনৈতিক  দলের  হয়ে নয়, গুয়াহাটিতে  অল আদিবাসী স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অফ আসাম-এর  হয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন৷ সেই সময়  ছবিটি  তোলা হয়৷ তিনি কোনভাবেই  বিজেপির  জন্যে স্লোগান  দিচ্ছিলেন না৷ সূত্র ঃ নিউজ ১৮ বাংলা, দোল চট্যোপাধ্যায়, ২২ জুন৷

আজদেশের  সাধারণ মানুষ জানতে চায় আদিত্যনাথের রাজ্যে ‘ক্রিমিনাল’ কারা? ঘটনার বিচার থেকে জানতে পারা  যায় --- হিংসার রাজনীতিতে যাকে  বলি দিলে  বিজেপির  লাভ হবে  সে-ই  ‘ক্রিমিনাল’৷ যাঁরা আদিত্যনাথ ও বিজেপির  সমালোচক  তাঁরাই  ‘ক্রিমিনাল’৷ যাঁরা  গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা নিয়ে চলেন তাঁরাই  ক্রিমিনাল ৷ যাঁরা অন্ধতা-কুসংস্কারাচ্ছন্নতা  থেকে দূরে  থাকা চেষ্টা করেন তাঁরাই ক্রিমিনাল ৷ যাঁরা সাম্প্রদায়িক হানাহানির  বিরোধিতা করেন  তাঁরা সকলেই  ‘ক্রিমিনাল’৷ সাধারণ  সংখ্যালঘু  মুসলমান  ও গরিব  হিন্দু  তথা দলিত অংশের মানুষ মাত্রেই  বিজেপি ও আদিত্যনাথের  কাছে ‘ক্রিমিনাল’৷

এরকম অবস্থায় দেশ জুড়ে  শিকারি  বিজেপির  অসহিষ্ণু  ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির  শিকার  হওয়া মানুষের  সংখ্যা ক্রমশ  বাড়ছে৷ সমগ্র বিশ্বের ফ্যাসিস্ট শাসকদের  চেনা  কণ্ঠস্বর এখন বিজেপি  ও সংঘ পরিবারের নেতাদের  গলাতে প্রতিধবনিত  হচ্ছে৷  এর থেকেই মানুষের  মনে এক অনাকাঙ্খিত ভয় ক্রমশ দানা  বাঁধছে৷  আবার কি ফিরে আসবে  সেই হিটলার  ও মুসোলিনির  শাসনকাল?  আবার এক বিশ্বযুদ্ধের  ভয়াল ভয়ঙ্কর  সময়ের  মধ্যে দিয়ে অমানবিক  শাসনের  যাতাকলে পিষ্ট  হতে হতে  শেষ হবে এ জীবন?