ভয়ের রাষ্ট্র ভারত ঃ একটি অন্তর্তদন্ত  

লেখক
মিহির কুমার দত্ত

প্রথম পর্ব ঃ

ভারত ক্রমশঃ ভয়ের রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে !  রাষ্ট্র দ্বারা একের পর এক দানবীয় আইন POTA- TADA-UAPA) তৈরী ও তার ব্যবহারে  বিশ্বের দরবারে  এটাই এখন  ভারতের পরিচয়৷  ভারতের সংবিধানে যে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে  সংবিধানের  ৪২তম সংশোধনের মাধ্যমে,  সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল,  সেই ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটিকে  উগ্র হিন্দুত্বের  চাদরে মুড়ে ফেলার  পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু  হয়েছে৷ এটা শুরু হয়েছে ২৬ বছর আগে  বাবরি মসজিদ ধবংস ও ২০০২ সালের  গুজরাট দাঙ্গা ও গণহত্যার মধ্য দিয়ে৷ এরপর বিভিন্ন রাজ্যে যেখানে উগ্র হিন্দুত্বের সুড়সুড়ি দিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করে অথবা রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় বসে তার ব্লু-প্রিণ্ট তৈরী ও সময় সুযোগ মত  সাম্প্রদায়িক জনতাকে উস্কে দিয়ে বিশেষ ক্ষমতা বলে অসহায়-নিঃস্ব-দলিত ও মুসলিম জনতাকে শিকার বানানোর মধ্য দিয়ে৷

যদিও উগ্র হিন্দুত্বের ব্যানারে রাজনৈতিক কাজকর্ম চালান বিজেপি ও আর এস এস সহ সংঘ পরিবারের সকল সদস্য সংঘটন ১৯৭৫ সালের কংগ্রেস আমলের জরুরী অবস্থা কিংবা ১৯৮৪ সালের শিখ গণহত্যা নিয়ে প্রচুর বাক্য ব্যয় করে থাকে৷ কিন্তু গুজরাত গণহত্যা কিংবা সাম্প্রতিক সময়ের ভাড়াটে খুনীদের দিয়ে বুদ্ধিজীবীদের-অধ্যাপকদের আইনজীবীদের সাংবাদিকদের ও মানবতাবাদী সমাজকর্মীদের উপর আঘাত নামিয়ে এনে অন্যায়ের বিরোধ করা প্রতিবাদী কণ্ঠকে চিরতরে থামিয়ে দেওয়ার ফ্যাসিবাদী কৌশল অবলম্বন করে৷ গণতন্ত্রকে হত্যা করে, উগ্র হিন্দুত্ববাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চাদরে ভারতবর্ষকে মুড়ে ফেলতে চাইছে৷

এভাবেই ফ্যাসিবাদী জমানার ভয়কে, নোতুন নোতুন দমন করার পদ্ধতি আবিষ্কার ও আইন প্রনয়ন করে, প্রচণ্ড ঘৃণা ও গোয়েবলসীয় মিথ্যার কাছে আজ ভারতে যতটুকু নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিঁকে আছে, যতটুকু গণতন্ত্র সাধারণভাবে উপলব্ধি করা যায়, তাকেও শেষ করার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে কেবলমাত্র ‘এক দেশ-এক ধর্ম’ নামক শ্লোগানের মধ্যে দিয়ে৷ যদিও ভারতবর্ষ বহুজাতিক, বহুমাত্রিক ও বহু ধর্মাবলম্বীদের বাসভূমি৷ এখানে বহু ভাষাভাষী মানুষের সহাবস্থান চোখে পড়ে৷ তাকে অস্বীকার করে কেবলমাত্র নিজস্ব একটা বিশেষ ডিজাইনকে সামনে রেখে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে কাজ করে চলা রাজনৈতিক দল বিজেপি ও আর এস এস আজ হাতিয়ার করছে ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল---২০১৬’-কে৷

১৯৫৫ সালে যখন এই আইন তৈরী হয় তখন বলা ছিল ভারতের বাইরের দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের ভারতের নাগরিকত্ব পেতে হলে এই দেশে কমপক্ষে ১২ বৎসর বসবাস করা বাধ্যতামূলক৷ সেই মত করেই এই দেশে বহু ‘জন্মসূত্রে বিদেশীরা’ এসে নাগরিকত্ব লাভ করেছেন৷ কিন্তু নোতুন ২০১৬-র নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে তা পরিবর্তন করে বলা হয়েছে---এখন থেকে বহিরাগত মানুষেরা এদেশে এসে মাত্র ছয় বৎসর থাকলেই ভারতের নাগরিকত্ব লাভের সুযোগ পাবে৷

বাইরে থেকে হালকা হালকা ভাবে মনে হতে পারে যে এই সংশোধনী বেশ মানবিক ও সময়োপযোগী৷ কিন্তু এর মধ্যকার অভিসন্ধীগুলি একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের পর আসল সত্য সামনে আসে৷ ছয় বৎসরেই নাগরিকত্ব লাভ তাদেরই, যারা বিদেশ থেকে এদেশে আশ্রয়প্রার্থী কিংবা সেই দেশ থেকে ধর্মীয় কারণে এদেশে এসে বসবাস করতে চায়৷ তবে সেটা প্রযোজ্য হবে   কেবলমাত্র অ-মুসলিমদের জন্যে৷ যেমন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান-শিখ-পাসী-জৈনদের ক্ষেত্রেই৷ এরা ছাড়া বাকী থাকা মুসলমানরা এদেশে এলেই তা হবে অণুপ্রবেশ৷ তার জন্যে আলাদা আইন রয়েছে৷

এই সংশোধনীর মধ্যে নাগরিকত্ব প্রদানের যে শর্ত রাখা হয়েছে তা হ’ল অ-মুসলিম নাগরিক, বিশেষত ‘হিন্দুস্তান ইণ্ডিয়া’র আশেপাশের দেশের ‘দেশগত-ধর্মগত-জাতিগত’ মানুষেরা, যারা নিজের দেশে বিপদে পড়ে ভারতে আশ্রয়ের খোঁজে আসবে, তারা৷

অনুসন্ধানে ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে যে, ইহুদীদের জন্যে যেমন ইসরায়েল প্রশাসন, ইজরায়েলকে ‘বিশ্বের ইহুদী’দের ‘নিজস্ব রাষ্ট্র’ হিসাবে গড়ে তুলেছে৷ ঠিক একই কায়দায় নোতুন ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬’-র মাধ্যমেও ‘বিশ্বের হিন্দুদের’ ‘নিজস্ব রাষ্ট্র’ ‘হিন্দু ভারত,’ ‘হিন্দুস্তান ইণ্ডিয়া’ গড়ে তোলার ভাবনা ধরা পড়েছে৷

এই ডিজাইন-এই সংবিধান থেকে ৪২ তম সংশোধনীর মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ শব্দটিকে এতটুকু স্পর্শ না করেও, কোনও রকম আঘাত না করেই, ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ গঠনের জন্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে সক্রিয় হয়েছেউগ্র হিন্দুত্ববাদী ও চরম ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির স্ব-ঘোষিত ধবজাধারী রাজনৈতিক দল বিজেপি ও আর এস এস-এর মত উগ্র মানসিকতা সংগঠনগুলো৷

সিড়ি ভাঙ্গা ডিজাইন

‘‘ভারত একটি হিন্দু রাষ্ট্র’ নামক একটি ‘’মাল্টিলেভেল’, ‘চিন্তা ও কর্মধারা’ ভারতের জনজীবনে দৈনন্দিন ও নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত করার জন্য কতগুলি বিশেষ ঘটনা ঘটে চলেছে৷ দলিত নিধন ও দলিত নিষ্পেশন, নিম্নবর্ণের মানুষের ওপর অত্যাচার, মুসলমানদের পরিকল্পিত হত্যা, যাদের বুদ্ধি ও চিন্তার কারণে দেশ এগোয় তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি ও প্রয়োজনে ‘গুম হত্যা’৷ একান্ত ভাবে কোনটাই করতে না পারলে মাওবাদী আখ্যা দিয়ে জনমণে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা ও সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক ধরিয়ে দেওয়া যাতে তারা শত অসুবিধা সত্ত্বে প্রতিবাদ না করে কিংবা তাদের হয়ে কাউকে প্রতিবাদে ও প্রতিরোধে অংশ নিতে সাহায্য না করে৷ কারণে হোক বা অকারণেই হোক প্রতিবাদ সংঘটিত হলে ও প্রতিরোধ গড়ে উঠলে একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে না৷ বাধা হীন ভাবে ‘জনতার সম্পদ’ লুঠ করা যাবে না৷ তাই জনতার হয়ে, জনতার জন্যে, প্রতিবাদ গড়ে তুললে জনতার হয়ে চোখে চোখ রেখে প্রশ্ণ করলে চিরাচরিত পদ্ধতি অবলম্বন করে মাওবাদী সাজিয়ে দেওয়া৷ আর মাওবাদ শব্দটার সঙ্গে আতঙ্কবাদের যোগসাজসের গল্প প্রচার করে সাধারণ মানুষের মনে একটা ভয় প্রবেশ করানোর অপচেষ্টা রাষ্ট্র বহুদিন ধরেই করে চলেছে৷ তারা বোঝানোর চেষ্টা করছে বিশ্ব ISIS কিংবা আলকায়দার কর্মসূচী যেমন আতঙ্ককে ভর করে বিশ্ববাসীর মনে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে৷ যেমনভাবে আতঙ্ককে আশ্রয় করেই ধর্মীয় আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা চালাচ্ছেISIS বা এরকম বহু সংঘটন৷ ঠিক তেমনি ভাবেই মাওবাদীরাও একটা আতঙ্কবাদী সংঘটন ছাড়া আর কিছু নয়৷

আসলে রাষ্ট্র ভুল বোঝাতে চাইছে দেশের মানুষকে৷ বহুদিন ধরেই ভারতবর্ষে বহু রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক কাজকর্ম পরিচালনা করছে৷ তাদের প্রত্যেকেরই একটা নিজস্বতা রয়েছে৷ প্রত্যেকেরই একটা রাজনৈতিক আদর্শ রয়েছে, চিন্তা রয়েছে৷ যেমনভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই জন্ম হওয়া কংগ্রেস গান্ধীজীকে তাদের আদর্শ মানে৷ একটা সময় সিপিআই, সিপিআইএম বা এরকম বহু বাম রাজনৈতিক দলের কাছে  মার্কস, লেনিন আদর্শ হিসাবে কাজ করত৷ যদিও আজ তেমন কোনও আদর্শ তাদের আর নেই৷ ঠিক তেমনভাবেই আজ যে মাওবাদী, মাওবাদী বলে চিল চিৎকার জুড়েছে প্রশাসন তাও ওই বাম রাজনীতি থেকে জন্ম নেওয়া৷ মার্কস, এঙ্গেলস্, লেনিন, স্তালিন ও মাও-সে-তুং-এর চিন্তাকে আশ্রয় করে দুনিয়ার মজদুর, কিষাণ দলিত সর্বহারা মানুষের জন্য কাজ করতে চেয়েই এই সংঘটন গড়ে উঠেছে৷ এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কাজকর্মের যুক্ত একটি সংঘটন৷ প্রচার হচ্ছে তাদের নীতি ভুল, চিন্তা ভুল বা তাদের কাজকর্ম রাষ্ট্রের পছন্দ নয়৷ সবই ঠিক৷ কিন্তু কোনও প্রমাণ ছাড়াই যে কোনও বড় প্রতিবাদ সংঘটিত হলে দেশের জনতা অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠলে বহু মানুষ সংঘটিতভাবে কোনও অন্যায়ের মোকাবিলা করতে চাইলেই সেই প্রতিবাদ, প্রতিরোধে সামিল সকল মানুষদেরই মাওবাদী সাজিয়ে দিয়ে কঠোরতম আইন UAPA-এর আওতায় তাদের বন্দী করে জেলখানার অন্ধকার কুঠুরীতে ঢুকিয়ে দিয়ে চরম অত্যাচার চালানোটাই রাষ্ট্রের পরিচালন ক্ষমতায় বসে থাকা প্রশাসকদের প্রধান ও একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ একটি রাজনৈতিক সংঘটনের সাথে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করা উচিত৷ কিন্তু তা হচ্ছে না৷ পরিবর্তে সেই সংঘটনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেওয়া তাদের কাজকর্মকে আতঙ্কবাদী কাজকর্ম হিসাবে দেখানো৷ জনতার মধ্যে সেই রাজনৈতিক আদর্শ প্রচার করার কর্মীদের আটক করে UAPA দেওয়াটা একপ্রকার ফ্যাসীবাদী চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র৷

(ক্রমশঃ)