ব্যষ্টি নিয়ন্ত্রিত ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত উৎপাদন ব্যবস্থাই অদ্যাবধি পৃথিবীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ও মূলতঃ বন্টন ব্যবস্থাকে পরিচালিত করছে৷ এদের যথাক্রমে ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রক সাম্যবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলা হয়৷
আজ এই দুটি উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থাই শোষণের হাতিয়ার হিসাবে চিহ্ণিত হচ্ছে৷
সারা পৃথিবীতে চলছে চরম অর্থনৈতিক শোষণ৷ বর্ত্তমানে ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই সর্বত্র স্বনামে ও বেনামে কাজ করে চলেছে৷ এই দুই ক্ষেত্রেই শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী নানাভাবে আর্থিক দিক থেকে শোষিত হচ্ছে৷
ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার হাত থেকে শ্রমিক ও কর্ষক শ্রেণীর মুক্তির ডাক যারা দেয় তারা কিন্তু ওই গায়ে গতরে খেটে খাওয়া মানুষের কেউ নয়৷ তারা সবাই উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের৷ তারাই মনভোলানো বিপ্লবের কথা বলে তাদের পথে নামায় শেষে তারাই মারাত্মক ভাবে শোষণ করে এসব হতভাগ্য মানুষদেরই৷ ‘বিশ্বের শ্রমিক’রা বা ‘বিশ্বের কর্ষক’রা এক হও, এই আহ্বানে বিশেষ পরিস্থিতিতে তারা পৃথিবীর কোথাও কোথাও রক্তাক্ত ঘটনা ঘটিয়ে সরকারে পরিবর্ত্তন আনে ঠিক কিন্তু পরিবর্ত্তিত অবস্থায় ও তারপর তারাই শাসনের নামে ভয়ঙ্কর শোষণ অত্যাচার চালিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়৷ এটাই আমরা দেখেছি রাশিয়ায় ও চীনে৷ নিপীড়িত শোষিতদের ঠকিয়ে তাদের রক্তে রাঙা রাষ্ট্রে চরম শোষণ চালিয়ে যায়৷ চরম রক্তক্ষয়ের পর যে পরিবর্ত্তন সেটা হ’ল প্রকৃতপক্ষে এক ভয়ঙ্কর অব্যবস্থা, শোষণ ও অত্যাচারের যুগ৷ জনগণের অসহনীয় অবস্থার পরিবর্তন ঘটে না৷ নেপোতে মারে দই আর বোকারা খেটেই মরে৷ শোষণে শোষণে নিষ্পেষিত হয়ে ওই অসহায় শ্রমিক ও কর্ষকরা যখন প্রতিবাদ জানায় তখন সৈন্য দিয়ে পুলিশ দিয়ে তাঁদের গুলি করে মারে ওই সব বহুরূপী নেতারা৷ চীনের তিয়েন আন মিয়েন স্কোয়ারে প্রায় দশ হাজার তরুণ–তরুণীকে চীনের কমিউনিষ্ট শাসক গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবী জানানোর জন্যে হত্যা করে৷ রাশিয়ার সরকার পোল্যাণ্ডে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ওপর ষ্টীমরোলার চালায় তারা ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্যে রুটির দাবী করেছিল বলে৷ আজ চীনের একদলীয় ব্যুরোক্রাটদের শাসন টলমল করছে আর রাশিয়া যেখানে সমাজবাদী কমিউনিষ্টদের এককালে স্বর্গরাজ্য ছিল সেখানে তো ইতোমধ্যেই পরিবর্ত্তন এসেছে৷ এই হতদরিদ্র পশ্চিম বাংলাতেও রাজনৈতিক পট পরিবর্ত্তন হয়েছে৷ এখানে কমিউনিষ্ট শাসন চলে গেছে৷ কিন্তু বৈশ্য শ্রেণীর যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছে দরিদ্রেরা৷ এদের মুক্তির বাণী কেউই দেখাতে পারছে না৷ সবাই সেই অক্টোপাশের শোষণে রক্তশূন্য হয়েই আছে৷ শুধু তাই নয় বৈশ্য শ্রেণীই নিজেদের স্বার্থে রাজনৈতিক পরিবর্ত্তন আনে নানা কারণে৷ পর্দার আড়ালে থেকে এরাই কলকাঠি নেড়ে চলেছে৷ দূর থেকে যেন পুতুল নাচ দেখানো হচ্ছে৷ আদতে ভয়ঙ্কর শোষণ চলছে সারা দুনিয়া জুড়ে৷
জনগণের হাতে অদ্যাবধি এমন কোন দিশা নেই যার দ্বারা তারা তাদের ওপর যে অর্থনৈতিক শোষণ চলছে তাকে সামাল দেবে৷ এর হাত থেকে বাঁচাতে মহান দার্শনিক শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার মানুষের সমাজকে ‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’ দিয়েছেন যাকে এক কথায় বলা হয় ‘প্রাউট’৷
এই আর্থিক তথা সামজিক দর্শনে যে পথ নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে, তাকে বলা হচ্ছে যে, উৎপাদন ও বন্টনের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ভোগ্য পণ্যের ক্ষেত্রে সমবায়–ই হ’ল এক মাত্র পথ৷ গায়ে গতরে খাটা কর্ষক ও শ্রমিক শ্রেণী যদি মিলিত ভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভোগ্য বস্তু উৎপাদন ও বন্টনের ব্যবস্থা সমবায়ের মাধ্যমে করে তা হলে তার পুরোপুরি সুফলটি তারাই ভোগ করতে পারে৷ এই সমবায়ে কেউ নিছক উৎপাদনের ফ্যাক্টর হবে না৷ এরাই হবে মালিক৷ একেই বলা হয় গণ–র্থনীতি৷ জনগণই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সরাসরি নিয়ন্ত্রিত করার সুযোগ পাবে৷ সমবেত কর্ষক ও শ্রমিক শ্রেণীই জমি, শ্রম, মূলধন ও সাংঘটনিক শক্তির যোগান দিয়ে উৎপাদন করবে ও তার সামগ্রিক উপযোগিতা ও ভোগ করবে৷ মাঝে কোন মধ্যসত্ত্বভোগকারী থাকবে না৷
দুর্ভাগ্যের বিষয় বৈশ্য শ্রেণী ধনতান্ত্রিক ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শ্রমদানকারীদের আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র করে মার খাওয়ায় ও জনগণকে শোষণ করে নানাভাবে৷ কারণ তাদের শোষণের মৌচাকটিকে একমাত্র সমবায় প্রথাই দারুণ আঘাত হানতে পারে৷ তাই আজকের সমস্যা সংকুল পৃথিবী থেকে শোষণ দূর করতে হলে মানুষের সমাজকে সমবায় আন্দোলনকেই হাতিয়ার করে এগোতে হবে৷ এটা হাতে কলমে কাজ করতে হবে ৷নিছক তাত্ত্বিক আলোচনায় ক্ষুধা বা সমস্যা মিটবে না৷ সন্তুলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আনতে হবে একটা আমূল পরিবর্ত্তন৷ পরিশেষে বলি মহান দার্শনিক শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেন যে প্রাউট খুবই বাস্তবধর্মী৷ তাই মানুষের সমাজ অর্থনৈতিক শোষণের হাত থেকে তখনই মুক্তি পাবে যখন মানুষ সমবায় আন্দোলনকে বাস্তবায়িত করবে উৎপাদন ও বন্টনের ক্ষেত্রে৷ আর তখনই দিনের আলোয় শোষকরূপী পেঁচারা পালিয়ে যাবে৷
- Log in to post comments