প্রসঙ্গ ঃ শিক্ষাঙ্গনে কু-রঙ্গ

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

প্রতি বৎসর সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখটি শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত দিন---‘শিক্ষক দিবস’ রূপে মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়৷ প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য অনুযায়ী ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক পবিত্রতার পরাকাষ্ঠা হিসেবে স্বীকৃত৷ প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যায়তন গড়ে ওঠার পূর্বে ছাত্রগণ গুরুগৃহে অবস্থান করে বিদ্যাভ্যাস করতেন৷ বিদ্যাচর্চার সঙ্গে সঙ্গে গুরুসেবা ও অন্যান্য গৃহকর্মও ছাত্রদের করতে হতো, আর এই কাজ তারা আনন্দের সঙ্গেই করতো৷ এমনকি রাজ পরিবারের সন্তানেরাও অন্যান্য ছাত্রদের সাথে একই ভাবে শিক্ষালাভ করতো---আর এটা তাদের কাছে লজ্জা বা অসম্মানের ব্যাপার ছিল না৷ গুরু ও গুরুপত্নী সকল শিষ্যের প্রতি একই রকম স্নেহপরায়ন ও যত্নশীল ছিলেন৷ শিষ্যের কাছে গুরুর স্থান ছিল সবার উপরে, অনেকটা ঈশ্বর তুল্য৷ গুরু-শিষ্যের এই পরম্পরা ভারতবর্ষে যুগ যুগ ধরে’ প্রবহমান ধারার মত চলে এসেছে৷ ২৫-৩০ বছর আগে পর্যন্তও এই সম্পর্কে কোনওরকম ফাটল বা কালিমা দেখা দেয়নি৷ শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ ছাত্র-ছাত্রাদের সন্তানবৎ স্নেহ করতেন৷ প্রয়োজনে ছাত্র-ছাত্রার সংশোধনের জন্যে শাস্তিবিধান করলেও তা ছিল তাদের মঙ্গলকামনায় ও মমতামাখা৷ ছাত্রছাত্রারাও শিক্ষক-শিক্ষিকাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতো ও এই ধরণের শাস্তি মাথা পেতে গ্রহণ করতো৷ এমনকি অভিভাবক-অভিভাবিকারাও এই শাস্তিবিধান ব্যাপারটিকে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতেন৷

পরবর্তীকালে বিভিন্ন কারণে এই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে একটু একটু করে অবনতির লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে যা কয়েক বছরের মধ্যে অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে৷ প্রাথমিক পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রারা বহুবিধ অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে যার কেন্দ্রে থাকছে হয় কোনও শিক্ষক-শিক্ষিকা নয়তো  বিদ্যালয়েরই কোনো অধস্তন কর্মচারী৷  বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, কর্মচারী ও শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে শিশু-ছাত্রছাত্রা ও তাদের অভিভাবক-অভিভাবিকাদের সম্পর্কে ক্রমাবনতি পরিদৃশ্যমান হয়েই চলেছে৷ বহুবিধ ঘটনার পরিণামে সংঘটিত আন্দোলন ও আইন আদালতের হস্তক্ষেপও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে৷ ফলতঃ শিশুশিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকগণ ভীতিপ্রদ,আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন৷ আবার উল্টো দিকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র ভিন্নতর৷ রাজনীতির অনুপ্রবেশের কারণে ছাত্র ইয়ূনিয়নের দাপাদাপি ও মারমুখী আচরণের শিকার হচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ৷ পদে পদে ছাত্রছাত্রাদের হাতে তাঁদের লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা সংবাদের শিরোণামে উঠে আসছে৷ ছাত্র সংসদের নির্বাচনকে ঘিরে ছাত্রছাত্রাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে মারদাঙ্গা, অশান্তি, রক্তারক্তির ঘটনা বিদ্যায়তনগুলিতে এক অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে৷ এছাড়া শিক্ষক-শিক্ষিকারাও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রিত সংঘটনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় রাজনীতির বাধ্যবাধকতার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন৷

অতি সম্প্রতি কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজের ঘটনা সংবাদে প্রকাশিত হচ্ছে নিয়মিত৷ কলেজের অধ্যক্ষার সঙ্গে অন্যান্য শিক্ষিকাদের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে বেশ কিছুদিন থেকেই৷ অধ্যক্ষার সমর্থক সেই কলেজের ছাত্র সংসদের সদস্যদের সঙ্গে অন্যান্য শিক্ষিকাদের সম্পর্কও স্বাভাবিকভাবেই মধুর নয় ও শিক্ষিকাদের অনেকেই ছাত্রাদের অন্যায় আচরণের শিকার হয়েছেন৷ তাই ৫ই সেপ্টেম্বর ‘শিক্ষক দিবসে’ ছাত্রাদের উপহার নিতে শিক্ষিকাগণ অস্বীকার করেন৷ প্রতিক্রিয়া হিসেবে ৭ই সেপ্টেম্বর শুক্রবার ছাত্র সংসদের সদস্যারা কলেজ ভবনের ফটক আটকান ও শিক্ষিকাদের ঢুকতে বাধা দেন৷ ফলে শিক্ষিকারা কলেজ চত্বরের মাঠে বসেই ইচ্ছুক ছাত্রীদের ক্লাস নেন৷ এর প্রতিবাদে পরের দিন শিক্ষিকারা শ্রেণীকক্ষে ক্লাস নিলেও স্টাফ রুমে না গিয়ে বারান্দায় অবস্থানে বসে পড়েন৷ এই দিনগুলোতে অধ্যক্ষা মহোদয়া অসুস্থতার কারণে কলেজে আসেননি৷ সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী এই সমস্যার এখনও কোনও সমাধান হয়নি৷

ঐতিহ্যবাহী প্রেসিডেন্সী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও মাঝে মধ্যেই অশান্তি পরিলক্ষিত হয়৷ প্রেসিডেন্সী ছাত্রদের জন্যে হিন্দু হোস্টেল নির্মিত হয় ও সেখানেই ছাত্ররা বসবাস করতেন৷ কিন্তু প্রায় তিন বছর আগে সেই হিন্দু হোস্টেল খালি করে মেরামতির কাজ শুরু হয়৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তিন বছরেও মেরামতি  সম্পূর্ণ না হওয়ায় ছাত্রদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়৷ তাদের অস্থায়ী হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা হলেও সেই হোস্টেলের অবস্থাও ভাল নয়৷ এমতাবস্থায় ছাত্ররা হিন্দু হোস্টেল ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে আন্দোলন শুরু করে৷ কয়েক মাস অপেক্ষার পরেও হিন্দু হোস্টেল সংস্কার সম্পন্ন না হওয়ার দরুণ ছাত্ররা বিছানাপত্র নিয়ে এসে প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বসবাস আরম্ভ করে ও অস্থায়ী হোস্টেলে ফিরে যেতে অস্বীকার করে৷ ইতোমধ্যে গত ১১ই সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সমাবর্তন সমারোহের দিন ধার্য করেন৷ সেই দিন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে সান্মানিক ড়ি লিট ও বিজ্ঞানী সি. এন. আর রাওকে সান্মানিক ডি. এস. সি. উপাধি ও উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রাদের ডিগ্রি প্রদানের কথা ছিল৷ কিন্তু আন্দোলনরত পড়ুয়ারা ১০ই সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্সীর প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয় ও শ্লোগান দিতে থাকে৷ বেলা ১০টা নাগাদ উপাচার্য, অন্যান্য পদাধিকারী ও শিক্ষিক-শিক্ষিারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে, তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি৷ ফলে অশান্তির আশঙ্কায় ১১ই সেপ্টেম্বরের সমাবর্তন অনুষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে নন্দন প্রেক্ষাগৃহে স্থানান্তরিত করা হয় ও সেখানে শুধুমাত্র সান্মানিক ডিগ্রি প্রদান সহ অন্যান্য অনুষ্ঠান সাদামাঠাভাবে সম্পন্ন হয়৷ দেশ-বিদেশের শিক্ষাব্রতী মহলে এই ঘটনার বিরূপ প্রভাব লক্ষিত হয়৷ এছাড়া কিছুদিন আগেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির প্রবেশিকা পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে অশান্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যার জের হাইকোর্ট পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল৷

গত কয়েকদিন ধরে নদীয়ার বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন ডিন-এর পক্ষপাতিত্ব ও অনৈতিক কাজকর্মের প্রতিবাদে ছাত্র আন্দোলন চলছে৷ সংবাদে প্রকাশ, অভিযুক্ত শিক্ষকদের প্ররোচনায় গত বুধবার ১২ই সেপ্টেম্বর রাতে বিসিকেভি ক্যাম্পাসে বহিরাগত দুষ্কৃতীরা হামলা চালায়৷ এই ঘটনাক্রমে উপাচার্যের ভূমিকাতেও ছাত্রছাত্রারা অসন্তুষ্ট৷ শুধু তাই নয়, তিনি ছাত্রছাত্রাদের অবিলম্বে হোস্টেল ছাড়ার নির্দেশ দেন ও বিভিন্ন ভাবে চাপ সৃষ্টি করেন৷ এর ফলে ছাত্রছাত্রারা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবী করেন৷

শুধু এই রাজ্যেই নয়, দিল্লীর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ও বিভিন্ন সময়ে বহুবিধ অশান্তির জন্যে সংবাদ শিরোণামে এসেছে৷ কখনো ছাত্রদের দেশদ্রোহিতার অপবাদ, কখনো দলিত ছাত্র নির্যাতন ও অন্যান্য কারণে বিভিন্ন ছাত্রগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ, অশান্তির আগুন জ্বলেছে এই ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ সম্প্রতি জে.এন.ইয়ূতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিবেশ অশান্ত হয়ে ওঠে৷ অবশ্য নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর দেখা যায় বামজোটের প্রার্থীরা বিপুল ব্যবধানে এ, বি, ভি, পি প্রার্থীদের হারিয়ে দিয়েছেন৷ এই আক্রোশে ফলপ্রকাশের দিন রাতের বেলায় জয়ী বাম ছাত্রনেতাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়৷ কেন্দ্রের সরকার এ.বি.ভি.পি-র সহায় থাকায় পুলিশ প্রশাসনও এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ করেনি৷

উপরিলিখিত ঘটনাগুলি দেশের হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অজস্র অশান্তির  ঘটনার কয়েকটি উদাহরণ মাত্র, যার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রয়েছে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অন্যায্য ও অনৈতিক ভূমিকা৷ প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের শক্তিবৃদ্ধির জন্যে যুবশক্তিকে নিজেদের করায়ত্ত রাখতে চায়---আর এর উপযুক্ত স্থান ও লক্ষ্য হ’ল হাজার হাজার শিক্ষায়তনের লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রা৷ নেতৃবৃন্দ তাদের দলীয় ও ব্যষ্টিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্যে কখনো ছাত্র- শিক্ষক, কখনও ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ ও সংঘাত বাধায়৷ পরিণামে শিক্ষায়তনগুলিতে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয় ও তার ফল ভোগ করতে হয় সাধারণ ছাত্র-ছাত্রাদের৷ অবশ্যই শিক্ষাঙ্গনের অশান্তি কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়---ভোট সর্বস্ব রাজনীিত্রতর সার্বিক আগ্রাসনের নির্যাস মাত্র৷ নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যে রাজনীতির কারবারিরা সমস্ত রকম অনৈতিক কাজকর্মে প্রশ্রয় ও উৎসাহ প্রদান করে---আর তার ঢেউ লাগে সমগ্র সমাজ দেহে, যার মধ্যে রয়েছে শিক্ষাঙ্গণও৷ তাই শিক্ষায়তনগুলিকে রাজনীতির কু-প্রভাব থেকে মুক্ত করতে না পারলে ছাত্রছাত্রাদের প্রকৃত উন্নতি বিধান ও সুশিক্ষা সম্ভব নয়৷ এছাড়া শিক্ষক ও ছাত্র উভয় সম্প্রদায়কেই নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে৷ ছাত্র-শিক্ষকের মূল সমস্যাগুলিকে অনুধাবন করে সহমর্মিতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা ও সমাধানের চেষ্টা করতে হবে৷ এর সঙ্গে প্রয়োজন শৈশব থেকেই আধ্যাত্মিকতার আদর্শে মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধসমৃদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা যা প্রতিটি মানুষের মধ্যে সত্য, ন্যায় ও নীতিবাদের মত শুভগুণাবলীর উন্মেষ ঘটাবে ও সত্যিকারের মানুষ হতে অনুপ্রেরণা যোগাবে৷ তখনই আবার শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের মের্লন্ধন নোতুন করে রচিত হয়ে গুরু-শিষ্য পরম্পরার ঐতিহ্য সুরক্ষিত হবে৷