যুদ্ধ ও শান্তি - প্রতিরক্ষার আড়ালে বহুজাতিক মুনাফা

লেখক
মিহির কুমার দত্ত

ভারতবর্ষ কি আজ খুব বিপদে? তার চারিদিকে কি শত্রুরা আক্রমন শাণাবে বলে সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম নিয়ে হাজির? তাহলে আমরা প্রত্যেক ভারতবাসী চরম নিরাপত্তার সঙ্কটের মধ্যে রয়েছি! ভাবার বিষয় বটে৷

আমরা ভারতবাসী হিসেবে আমাদের চারিদিকে যে সকল প্রতিবেশী দেশ যেমন বাংলাদেশ -নেপাল-ভূটান-চীন-শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানকে পাই৷ ভারতের কাছে এই মুহুর্তে বিশেষ প্রতিবেশীর জায়গা হিসেবে চীন ও পাকিস্তান সবার আগে৷ কারণ এই বিশেষ প্রতিবেশী দেশ আবার আমাদের বিশেষ চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে সময় সময়৷ চিন্তাটা আক্রমনের , চিন্তাটা দেশের সার্বভৌমত্বের, চিন্তাটা অধিকার হরণের মতো বিষয়ের সঙ্গে জড়িত৷

যাইহোক, স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতে প্রতিরক্ষাখাতে বছর বছর বাজেট বরাদ্দ বেড়েই চলেছে ও তা অস্বাভাবিকভাবে৷ আগের কংগ্রেস সরকার ঠিক যে পথে  এতদিন হেঁটেছে ঠিক সেই পথেই আজকের বিজেপি সরকার হাঁটছে এবং ২০১৭ সালে আমেরিকা রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশের কাছ থেকে যে বিপুল অর্থের যুদ্ধ সামগ্রী আমদানি করেছে তাতে ভারত বিশ্বে যুদ্ধাস্ত্র আমদানিতে সর্বোচ্চ দেশ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে৷ তাছাড়া দেশের সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দের নিরিখে, আমেরিকা-চীন-সৌদি আরব ও রাশিয়ার পরে পঞ্চম স্থানে রয়েছে ভারত৷ ‘সিপ্রীর’ এক রিপোর্টে জানা যাচ্ছে যে, গত ২০১৭ সালে সামরিক খাতে ভারতের খরচ হয়েছে ৪ লক্ষ ২৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা৷ এই খরচ আসলে দেশের বহু পুরাতন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পাল্টে একেবারে আধুনিক করতে৷ জানা যাচেছ যে এই খরচ ভবিষ্যতে আরো বাড়বে৷ যে প্রতিরক্ষার জন্যে  এতো খরচ, আসলে তার অর্থ-দেশ বা রাষ্ট্রের রক্ষা ব্যবস্থা৷ কিন্তু দেশ বা রাষ্ট্র তো আর কেবলমাত্র একটা ভূখন্ড নয়৷ আসলে সেই ভূখণ্ডের মানুষও৷

কোথায় সেই সাধারণ মানুষের সুরক্ষা?

প্রতিরক্ষার বিপুল পরিমান খরচের ব্যাপারে প্রশ্ণ উঠলেই রাষ্ট্রের কাছ থেকে উত্তর আসে--- ভারতবর্ষের মতো এতো বড়ো দেশে শুধু মাত্র সীমান্তের জন্যই খরচ হয় বিশাল টাকা৷ তার সাথে আছে ‘দুষ্টু’ প্রতিবেশী চীন ও পাকিস্তান৷ তারা যে কোনও মুহুর্তে ভারত আক্রমন করে দখল করে নেবে দেশটা৷ তাদের হাত থেকে দেশ বাঁচাতে চাই অস্ত্রশস্ত্র৷ যদিও দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীর উপত্যকায় সীমান্ত সংঘর্ষ ও সন্ত্রাস লেগেই আছে৷ অরুণাচল প্রদেশের দিকে হাতের পাঞ্জা প্রসারিত হয়েই আছে চীনের দিক থেকে৷ সুতরাং একটা যুদ্ধ যুদ্ধ গন্ধ ও ভাব রয়েছে বহুদিন ধরেই৷ এমতাবস্থায় ২০১৪ সালে নরেন্দ্রমোদী যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন তখন তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে শান্তি ও সৌহার্দ্যের পরিবেশ তৈরী করবেন৷ কিন্তু আজকের বাস্তব চিত্রটা একেবারে অন্যরকম৷ প্রতিদিন কোনও না কোনও কারণে চীনকে ও পাকিস্তানকে শত্রু হিসাবে চিহ্ণিত করে বক্তব্য রাখা হচ্ছে৷ অথচ মাঝে মাঝেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদী চীন যাচ্ছেন৷ বিদেশমন্ত্রী চীন যাচ্ছেন৷ চীন সফরে গিয়ে তারা বৈঠক করছেন৷ নানান বিষয়ে চুক্তি করছেন৷ দেশে ফিরে এসে একটা যুদ্ধাতঙ্কের আবহ তৈরী করছেন৷

প্রতিদিন এতো এতো যে চুক্তি হচ্ছে তার বিষয়ে কিন্তু সাধারণ মানুষকে অবগত করানো হয় না কেবলমাত্র দেশ বিপদে, দেশ আক্রান্ত এই খবর ছড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক জাতীয়তাবাদের উন্মাদনা তৈরী করা হয়৷

সারাদেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমছে দিন দিন৷ লক্ষ লক্ষ কলকারখানা বন্ধ হয়ে পরে আছে৷ প্রতিমাসেই খবরের কাগজে খবর ছাপা হয় অমুক কারখানায় লক আউট, তমুক কোম্পানিতে মালিক পক্ষ তালা ঝুলিয়ে দিল৷ নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরী হওয়ার পরিবর্তে চলছে লাগাতার কর্মসংকোচন৷ দিন দিন বাড়ছে আত্মহত্যার সংখ্যা৷ কাজের সন্ধান না পেয়ে বেকার যুবক যুবতীরা অন্ধকার জগতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে৷

যে চাষি আমাদের মুখে অন্নের জোগান দেন সেই চাষি আজ বিশাল সংখ্যায় চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে দিশাহারা হয়ে আত্মহত্যার মধ্যে মুক্তি খুঁজছেন৷ লক্ষ লক্ষ চাষি আত্মহত্যা করেছেন বিগত বছর গুলিতে৷ বাস্তবে সেই চাষিদের হত্যা করা হয়েছে, যে হত্যার নাম আত্মহত্যা৷ এ হত্যার কোনও প্রমাণ থাকে না৷ তাই কারো কোনও শাস্তি হয় না৷ উল্টে চাষিকেই আত্মহত্যার জন্য দোষী সাজানো হয় ৷ আশ্চর্য দেশ আমাদের ভারতবর্ষ৷ এই আশ্চর্যদেশ ভারতবর্ষে মহিলাদেরকে সাহিত্য, শিল্পে মায়ের আসনে বসানো হয় কিন্তু বাস্তবে প্রতিদিন দেশের কোণে কোণে নির্যাতন নেমে আসে--- তাদের নির্বিচারে খুন করা হয়৷

ভোগের দৃষ্টিতে দেখে তাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করে তাদের ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হয়৷ আজ তাদের নেই কোনও সুরক্ষা৷ তবে কি দেশের জনসাধারণকে রক্ষা করাটা সরকারের প্রতিরক্ষার মধ্যে পড়ে না?

তবে এ বিচার করতে গেলে একটু অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে এর বিচার করতে হবে৷ তথ্য বলছে- দেশের মানুষ স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনদিন এতোটুকু শান্তিতে -সুখে, আরামে, নিরাপদে জীবন অতিবাহিত করতে পারেনি৷ যারা পেরেছেন বলে দাবী করেন তারা শতাংশের হিসেবে সামান্য ও তারাই ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যার ৯৯ শতাংশ মানুষের মিলিত সম্পদের সমান সম্পদ ভোগ দখল করছে৷ তারা মাত্র ১ শতাংশ৷

স্বাধীনতার পরে এতগুলি বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও দেশের মধ্যে বহু মানুষ দিনের মধ্যে একবার খেতে পারে৷ আবার এমন বহুমানুষ আছে যারা যেদিন খেতে পান সেদিন তাঁদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন৷ খাবার জোটানোটা তাদের কাছে অনেক বড়ো ব্যাপার৷ না খেতে খেতে একসময় মরে যাওয়াটাই তাদের কাছে স্বাভাবিক একটা ব্যাপার৷

একনাগাড়ে বিভিন্নভাবে শোষণের শিকার হতে হতে শোষিত মানুষদের হাতে অর্থ বলতে আর কিছু নেই৷ দৈনন্দিন জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার সামর্থও তাদের নেই৷ সেই জায়গায় ভারতীয় শিল্পদ্যোগীদের তৈরী করা শিল্পদ্রব্য তারা কিনবে কেমন করে? এ অবস্থা যে শুধু দরিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষদের তা নয়৷ এখন নিম্নমধ্যবিত্তদের অবস্থাও খুব করুণ৷ সরকারী হিসেবে কখনই এদের ধরা হয় না৷ এদের শুধু ভোটের বাদ্যি বাজলেই স্মরণ করা হয়৷ তখন এদের দেবতার আসনে বসানো হয়৷ প্রয়োজন ফুরালে তাদের জায়গা হয় আস্তাকুড়ে৷ ফলে বর্তমান ভারতীয় শিল্পপতি ও পুঁজির মালিকেরা তাঁদের উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রির জায়গা পাচ্ছে না৷ বলা ভালো বাজার পাচ্ছে না৷ তাই তাদের ব্যবসার ক্ষতি না করে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য এক নোতুন চাহিদা তৈরী করতে হবে৷ সে চাহিদা এমন চাহিদা, যার জন্য জনগণের চাহিদার কিংবা জনগণের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না৷ এ সমস্যার হাত থেকে বের হওয়ার একমাত্র রাস্তা হলো--- যদি সরকার নিজেই শিল্পপতিদের উৎপাদিত দ্রব্য কিনে নেয় তাহলে আর কোনও সমস্যা থাকে না৷ সেখানেও শিল্পপতিদের অন্যান্য ক্ষেত্রে যে ধরণের ঝুঁকি নিতে হয় তাও নিতে হবে না৷ কারণ এমন দ্রব্য হবে যার ক্রেতা হবে সরকার৷ আবার যেহেতু অর্ডার দিয়ে বানানো হচ্ছে তাই প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও তৈরীর খরচও প্রাথমিকভাবে ঐ সরকারের রাজকোষ থেকেই চলে আসবে৷ সুতরাং শিল্প হলো আবার শিল্পদ্রব্য বিক্রির কোনো ঝামেলা থাকলো না৷ শিল্পপতিদের আর কোনও চিন্তা থাকলো না৷ এই চিন্তাহীন শিল্পোদ্যোগের নাম অস্ত্র ব্যবসা৷ সবাই জানে এই অস্ত্র হচ্ছে প্রতিরক্ষার প্রধান হাতিয়ার৷ অস্ত্রছাড়া প্রতিরক্ষা সম্ভব নয় কোনওভাবেই৷ সুতরাং প্রতিরক্ষার প্রশ্ণ যতোদিন থাকবে, ততদিন তার সাথে অস্ত্রের বিষয়টিও সমানে উচ্চারিত হবে৷ আর এই কারণেই বর্তমান ভারতীয় শিল্পোদ্যোগীরা অস্ত্র প্রস্তুত করা ব্যবসা শুরু করতে চলেছে৷ ভারতীয় সেনাবাহিনী তার নিজের প্রয়োজনে প্রতিবছর কয়েকশো কোটি টাকার যুদ্ধ সামগ্রী কেনে বিদেশের অস্ত্র প্রস্তুত কারীদের কাছ থেকে৷ এবার যদি দেশীয় শিল্পপতিরা এমন উদ্যোগ গ্রহণ করে তাহলে বিদেশ থেকে অস্ত্র কেনা কমিয়ে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন মতো কিংবা সুবিধা মতো যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরী করিয়ে নেওয়া যাবে৷ আর এই কারণে বিজেপি ক্ষমতায় এসে গোটা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উৎপাদনকে দেশীয় পুঁজিপতি ও শিল্পপতিদের হাতে তুলে দিয়েছে৷

খবরে প্রকাশ যে এবার দেশের বৃহৎ শিল্পদ্যোগী সংস্থা যেমন টাটা-বিড়লা-আম্বানি-মাহিন্দ্রা ও অশোক লেল্যান্ড-এর মতো কোম্পানিও আধুনিক অস্ত্র প্রস্তুত করবে৷ সঙ্গে প্রতিরক্ষার অন্যান্য সরঞ্জাম ও তারা তৈরী করবে৷ এরই রেশ ধরে কয়েকবছর আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদী স্লোগান তুলেছিলেন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের৷ যার মূল মানে ছিল দেশীয় কোম্পানিগুলো বিদেশী অস্ত্র প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর সাথে মিলিতভাবে অর্থাৎ যৌথ উদ্যোগে অস্ত্র উৎপাদন করবে৷ এই লক্ষ্যে বিদেশী সকল অস্ত্র প্রস্তুতকারী সংস্থার উন্নত প্রযুক্তি ও সর্বাধুনিক ডিজাইনের সুবিধা যাতে দেশের সংস্থাগুলি পেতে পারে তার নিশ্চয়তা সরকার ঐ প্রকল্পের মাধ্যমে শুরু করেছিল৷

আমরা আজ যদি বিচার করতে চাই তাহলে আমাদের সামনে আসবে এক কঠিন সত্যি৷ তাহলো ভারত রাষ্ট্র তার আশ্রয়ে থাকা শিল্পপতি ও পুঁজিপতিদের সাহায্যে ও মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী যে অস্ত্রের ব্যবসার বিশাল মার্কেট আছে তার কিছুটা দখল নিতে চাইছে৷ অর্থাৎ ভারত এখন নিজেই অস্ত্রের ব্যবসা শুরু করেছে৷ যদিও সব দিক বেশ রেখে ঢেকেই তা করতে চাইছে৷ তবুও সেই প্রবাদ মনে পরে যাচ্ছে৷ ‘শাক-দিয়ে কি মাছ ঢাকা যায়? মাছ যে নড়ে চড়ে৷’ সুতরাং সব কিছু পরিস্কার ভাবে সামনে আসছে৷

এক রাষ্ট্র যখন অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো চুক্তি সই করে তখন সেই চুক্তি আসলে হয় এক দেশের শিল্পপতির সঙ্গে অন্যদেশের শিল্পপতির৷ কেউ কেনে কেউ বেচে দেয়৷ তাতে আমদানি ও রপ্তানির ব্যবসার মাধ্যমে রাষ্ট্রের লাভ হয় ট্যাক্স৷

কিন্তু অস্ত্র ব্যবসা সম্পূর্ণ আলাদা৷ এখানে সবচেয়ে বড়ো ক্রেতা হলো রাষ্ট্র৷ আবার এক দেশ থেকে অন্যদেশে অস্ত্র পাঠানোর কোনো আইনি স্বীকৃতি না থাকার কারনে কেউ এক দেশ থেকে অন্যদেশে আমদানী ও রপ্তানি ব্যবসার মাধ্যমে অস্ত্রকে সহজে পাঠাতে পারে না৷ (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে) সুতরাং প্রয়োজন হয় রাষ্ট্র সাহায্যের৷ তাই অস্ত্র ব্যবসা মূলত রাষ্ট্র নিজেই করে৷ এর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে আছে৷

সেই কারণে আমেরিকা, রাশিয়া, ইজরায়েল , ফ্রান্স ও জার্র্মনি প্রভৃতি বহুদেশের সঙ্গে ভারতের চুক্তি ইতিমধ্যেই সই হয়ে গিয়েছে৷ এই সমস্ত দেশের অস্ত্র প্রস্তুতকারী সংস্থা ও ভারতের বৃহৎ পুঁজিমালিকের অস্ত্র প্রস্তুতকারী সংস্থার উৎপাদিত অস্ত্র যেমন সরকার কিনে নেবে তেমনি উদ্বৃত্ত অস্ত্র কোম্পানিগুলি বিক্রি করবে তৃতীয় বিশ্বের অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশ গুলির কাছে৷ আর এভাবেই সেই অস্ত্র ব্যবসার মাধ্যমেও অস্ত্র ব্যবসায়ী ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সাহায্যে ভারত সেই সব দেশের উপর দাদাগিরি হাসিল করবে৷

সেই অর্থে প্রতিরক্ষার প্রশ্ণে অস্ত্র ব্যবসা তো একটা ব্যবসাই৷ এরমধ্যে কোনও দেশরক্ষা নেই৷

এতোদিন যেমন আমরা দেখেছি যে আমেরিকা  তার আর্থিক ক্ষমতার জোরে, সামরিক ক্ষমতার জোরে অন্যান্য আপাত দুর্বল দেশগুলির উপর কর্ত্তৃত্ব বজায় রাখার জন্যে ক্রমাগত চাপ ও হুমকি দিয়ে গেছে৷ এবার ভারতও ধীরে ধীরে এই নোতুন ব্যবসার মাধ্যমে তার থেকে দুর্বল দেশের উপর একইরকম কর্তৃত্ব ফলাবে৷

আর এই লক্ষ্যের দিকে এগোতে গিয়েই বিগত বছর গুলোতে ভারত তথাকথিত সম্পর্কের ভিত তৈরী করতে চেয়েছে মূলত আমেরিকা-রাশিয়া-ফ্রান্স ও ইজরায়েলের সাথে৷ এখানেই রয়েছে আসল রহস্য৷ একেবারে কাছে থাকা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত সুদৃঢ় না করে তা করা হচ্ছে বহুবহু দূরের সামরিক শক্তিতে দৈত্য সদৃশ ঐসব দেশগুলির সাথে৷ সবথেকে বড়ো কথা হলো, যে সমস্ত দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা হচ্ছে তারা প্রত্যেকেই তাদের আশেপাশের প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে যুদ্ধ যুদ্ধ পরিবেশ তৈরী করে কিংবা অন্য যে কোনও উপায়ে তাদের উপর একধরণের চাপ তৈরী করে কিংবা সরাসরি অন্য দেশের এলাকার মধ্যে সামরিক অভ্যুথান ঘটিয়ে প্রচারের আলোয় আছে ও এ সমস্ত ঘটনার পিছনে আসল উদ্দেশ্যে হলো ক্ষমতার প্রসার ঘটানো৷ নিজ নিজ শিবির গড়ে তোলা৷ সর্র্বেপরি এভাবেই নিজ দেশে উৎপাদিত অস্ত্র অন্যদেশে বিক্রি করে ফায়দা তোল৷ তার জন্য যা যা করা প্রয়োজন তা করা৷

একটি কথা এখানে জেনে রাখা ভালো যে, এই অস্ত্র ব্যবসার মাধ্যমেই যে আগামী দিনে ভারত তার থেকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশ গুলির উপর দাদাগিরি বা কর্তৃত্ব জাহির করবে তা সবটা ঠিক নয়৷

এর আগেও প্রতিবেশী দেশ যেমন নেপাল-ভুটান বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা-মালদ্বীপ এর মতো দেশগুলোর উপর একচেটিয়া দাদাগিরি ভারত দেখিয়েছে ও এখনও দেখাচ্ছে৷ কিন্তু তা মূলতঃ অর্থনৈতিক সাহায্য, আকাশ পথ ব্যবহারেরে সুবিধা দান কিংবা ভারত মহাসাগরের উপর একছত্র আধিপত্যা কায়েম রাখার মতো বিষয়কে কেন্দ্র করে৷ এভাবেই ধীরে ধীরে প্রতিরক্ষার প্রশ্ণকে সামনে রেখে মহা সামরিক শক্তিধর দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করে ও তাদের সাথে এক শিবির বা সামরিক জোট তৈরীর মাধ্যমে আসলে ভারত এক সূদুর প্রসারী উদ্দেশ্যে সাধিত করতে চাইছে৷ ভারতের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদী লুন্ঠন করার পরিকল্পনাকে আরো শক্তিশালী করে ও এ ব্যাপারে আগে থেকেই যারা ময়দানে রয়েছে তাদের সাথে সখ্যতার মধ্যে দিয়ে নিজের অবস্থান পাকা করা৷ তার সাথে সাথে বিশ্বের এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের  মধ্যে যে বৈরীভাব রয়েছে, তাকে কাজে লাগিয়ে অস্ত্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যুদ্ধের আবহ তৈরী করা৷ তাকে সযত্নে ও সুপরিকল্পিতভাবে যুদ্ধাতঙ্কে পৌছে দিয়ে অস্ত্র ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করা৷

তাই দেশ রক্ষার নামে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আমূল পাল্টে অত্যাধুনিক সামরিক সাজে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সাজিয়ে কোন দেশপ্রেম দেখানো হবে? সেই দেশপ্রেমের জন্য প্রতিরক্ষার মধ্যে দেশমানব থাকবে কতখানি? জনসাধারণ এই তথাকথিত দেশপ্রেম নির্ভর প্রতিরক্ষার , প্রতিরক্ষা পাবে কি?

 স্থির বিশ্বাস এই যে, পৃথিবীর কোনও দেশের সাধারণ মানুষই যুদ্ধ চায় না৷ সাধারণ মানুষ মাত্রই তার প্রতিবেশী দেশের মানুষের সঙ্গে সৌহার্দ্যের সম্পর্ক চায়৷ তাহলে যুদ্ধ চায় কারা আর যুদ্ধ করে কারা?