২১শে ফেব্রুয়ারীর ডাক

‘২১শে ফেব্রুয়ারী’ বাক্যাংশটি উচ্চারিত হলেই শরীরের প্রতিটি শিরা-ধমনীতে তপ্ত-শোণিত স্রোত প্রবাহিত হতে থাকে, প্রতিটি অণু-পরমাণুতে এক অদ্ভুত অনুরণন ধবনিত হয়, সমগ্র দেহে এক তীব্র কম্পনের অনুভূতি জাগে৷ একদিকে মানব অস্তিত্বের প্রতি শিরা-উপশিরায়, স্নায়ূতন্ত্রের প্রতিটি কোষে কোষে প্রচণ্ড যন্ত্রণা ও ক্ষোভের সঞ্চার হয় অন্যদিকে এক অনাস্বাদিত গর্বে বুক ভরে যায়৷ ১৯৫২ সালের এই দিনটিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (অধুনা বাঙালী রাষ্ট্র বাঙলাদেশ) ডাকা (ঢাকা) শহরে উর্দু ভাষার ধবজাধারীদের আগ্ণেয়াস্ত্রের গুলিতে পাঁচটি তাজা প্রাণ (রফিক, বরকত, জববার, সালাউদ্দিন, আতায়ূর রহমান) বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বুকের রক্ত তর্পণ দিয়েছিল৷ পশ্চিম পাকিস্তানের মূল শাসক ও উর্দু সাম্রাজ্যবাদীদের আদেশনামায় বাংলা ভাষাভাষী পূর্ব পাকিস্তান সহ সমগ্র দেশের শিক্ষা, দীক্ষা ও সমস্ত রকম কাজে উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ডাকা (ঢাকা) বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিশাল জনজোয়ার গর্জে ওঠে৷ বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার এই আন্দোলন উর্দু ভাষী প্রশাসন মেনে নেয় নি ও তা দমন করার জন্য বর্বরোচিতভাবে গুলিবর্ষণ শুরু করে৷ ফলশ্রুতি হিসেবে উপর্যুক্ত পাঁচ তরুণ শহীদ হন৷ উর্দুভাষী শাসক বর্গের ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালী সমাজে বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে ও পরবর্তী পর্যায়ে প্রশাসন পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়৷ এই মাতৃভাষা আন্দোলনের তখনকার তরুণ নেতা শেখ মুজিবর রহমান কালক্রমে বাঙালীর মুক্তি আন্দোলনকে সংঘটিত করে সঠিক দিশায় পরিচালনা করেন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমবাঙলার আপামর বাঙালী সহ ভারতের সক্রিয় সহযোগিতায় পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা দলের হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেন৷ স্বাধীন বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়৷ বাঙলাদেশই হ’ল বাংলা ভাষভাষী মানুষের একমাত্র নিজস্ব রাষ্ট্র যার বীজ উপ্ত হয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ভাষা শহীদদের আত্মবলিদানে৷ তাদের এই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য উৎসর্গীকৃত জীবন বৃথা যায়নি৷ শুধু তাই নয়, বাঙলাদেশ সরকারের অনলস প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালেUNESCO দ্বারা ২১শে ফেব্রুয়ারী দিনটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে ও ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়৷ তারপর থেকে প্রতি বছরই যথাযোগ্য মর্যাদায় এই দিবসে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন  করা হয়৷ বাঙালী হিসেবে আমাদের গর্বের বিষয় এই যে, বাংলা ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি স্বরূপ পৃথিবীর সমস্ত দেশের মানুষের মাতৃভাষা সম্মানিত হয়েছে---এই ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর মাধ্যমে৷

প্রতিটি শিশু জন্মের পর প্রথম আশ্রয় রূপে পায় মায়ের উষ্ণতাপূর্ণ কোল, প্রথম খাদ্য-পানীয় রূপে পায় মতৃস্তনের দুগ্দ, প্রথম অনুভূতি রূপে পায় মাতৃস্নেহ---একই ভাবে প্রথম ভাষা হিসেবে পায় মায়ের মুখের ভাষা---মাতৃভাষা৷ মানুষ ও মনুষ্যেতর সকলেই এই মাতৃভাষাতেই প্রথম কথা বলা শুরু করে, মাতৃভাষাতেই হাসে-কাঁদে, মাতৃভাষাতেই নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে৷ মাতৃভাষার অবলম্বনেই মানুষ গান গায়, কবিতা লেখে, প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা বিনিময় করে---একই ভাবে প্রয়োজনে এই মাতৃভাষাতেই বিক্ষোভ দেখ্‌ায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবিচারের প্রতিবাদে গর্জে ওঠে৷ মাতৃভাষাই হ’ল জগৎ মাঝে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যম৷ মাতৃভাষার ওপর আঘাত এলে মানসিক দিক দিয়ে দুর্বলেরা সংকুচিত হয়ে যায়, অন্যদিকে যারা মানসিকভাবে সবল তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, প্রতিবাদ করে৷ এই কারণে ধূর্ত শয়তানরূপী শাসকের দল কোনও জাতিকে ধবংস করতে চাইলে সরাসরি আঘাত না করে মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রথমে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপরে ধীরে ধীরে আক্রমণ চালিয়ে দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা করে৷ ভাষা হচ্ছে মানুষের আত্মসম্মানের দ্যোতক, আত্মমর্যাদার বাহক৷ ভাষা আঘাতপ্রাপ্ত হতে হতে ক্রমশঃ অবদমিত হয়ে মানুষের মনের গভীরে বিরূপ মনস্তাত্বিক প্রভাব ফেলে৷ যার ফলে মানুষ ভেতবে ভেতরে দুর্বল হয়ে যেতে থাকে ও আত্মসম্মান তথা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে৷ এইভাবে ক্রমে ক্রমে এক-একজন মানুষ থেকে সমগ্র জাতিরই মেরুদণ্ড ভেঙ্গে পড়ে...ঠিক এই অবস্থারই প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে৷ এই সত্য অনুধাবন করেই স্বামী বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ মনীষীগণ বিভিন্ন ভাবে ভারতবাসীর তথা বাঙালীর পৌরুষ, ব্যষ্টিত্ব ও আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন৷ বর্তমানে বাংলা ভাষার ওপরেও একইরকম আক্রমণ চলছে৷ ফলশ্রুতি হিসেবে ঘরে ঘরে হিন্দী টি.ভি.-সিরিয়ালের রমরমা৷ সিনেমা হলে হিন্দী ছবির দৌরাত্ম্য অথচ বাঙলা ছবিগুলি দুয়োরাণীর দশাগ্রস্ত, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষাকে ক্রমশঃ ব্রাত্য করে দেওয়ার সীমাহীন প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে বাঙালীদেরই চোখ ও মনের থেকে দূরে রাখার পরিকল্পিত আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্র চলেছে৷ বাঙালী জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে এই পরিস্থিতির শিকার হয়ে বাঙলা ভাষার পরিবর্তে হিন্দী বা ইংরেজীর প্রতি বিভিন্ন বাস্তব কারণে অনেক বেশী করে আকৃষ্ট হচ্ছে৷ ফলে সমগ্র বাঙালী জাতি যেন স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলতে বসেছে৷ এই অবস্থা থেকে মুক্ত হতে গেলে প্রতিটি বাঙালীকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সতর্ক ও সজাগ হতে হবে, মাতৃভাষাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে হবে, আর অভিভাবক-অভিভাবিকা, পিতা-মাতা, শিক্ষক-শিক্ষিকা, প্রশাসকবর্গ সকলকেই আরও বেশী দায়িত্বসচেতন ও তৎপর হতে হবে৷

প্রতিটি ভাষার উন্নতিকল্পে দেশীয় নেতৃবৃন্দকে অনেক বেশী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সহনশীল ও মানুষের প্রতি আন্তরিক ভালবাসার মাধ্যমে সচেষ্ট হতে হবে৷ বিশেষ করে ভারতবর্ষের মত বিভিন্ন ভাষাভাষী বিশাল দেশের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি আরও সঠিকভাবে প্রযোজ্য৷ কোন একটি বা কয়েকটি ভাষার প্রতি প্রাধান্য বা পক্ষপাতিত্ব আরোপিত হলে বাকী ভাষাগুলি দুর্বল হয়ে গিয়ে সমাজদেহে এক বিষম ব্যধির সৃষ্টি হবে, দিকে দিকে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দানা বাঁধবে, বঞ্চনার আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকবে যা হয়তো ভবিষ্যতে এক বিরাট অগ্ণ্যুৎপাতের কারণ হবে৷ একটি মানুষের দেহের প্রতিটি অঙ্গে সুষম বিকাশ হলে তবেই সেই মানুষকে স্বাস্থ্যবান বলা যায়---ঠিক তেমনি পৃথিবীর প্রতিটি ভাষা, প্রতিটি জাতিগত সত্ত্বার প্রকৃত উন্নয়ন ও উজ্জীবন হলে তবেই একটি সর্বাঙ্গসুন্দর সুসংবদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সর্বকল্যাণপ্রদ আশ্রয় তথা বাসভূমি প্রতিষ্ঠিত হবে৷ এই মর্মে প্রাউট প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের মন্তব্য প্রণিধান যোগ্য--- ‘ভাষা সমস্যার সমাধানের যথার্থ নীতি ও কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করতে হলে চাই দূরদৃষ্টি, সহনশীলতা, বাস্তব জ্ঞান, বিশ্বপ্রেম, যথার্থ আদর্শ, আন্তরিকতা ও বিচক্ষণতা- আর এগুলি পাথেয় করে নিয়ে চললে শুধু ভাষা সমস্যা কেন---আমাদের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবনের যে কোন কঠিনতম সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যাবে ও আমাদের সমগ্র অস্তিত্ব বিজয় গৌরবের আলোকচ্ছটায় উদ্‌ভাসিত হয়ে উঠবে৷’