আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও সমাজ

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্‌হা

বিশ্ববিধাতার মানস কল্পনা সঞ্জাত এই বিশ্ব সৃষ্টির সংরচনায় সৃষ্টিচক্রের ঘূর্ণনকে সচল ও সুসমঞ্জস রাখার জন্যে সৃষ্টি হয়েছে নারী ও পুরুষ৷ আর পরমপিতার সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান মানুষের ক্ষেত্রেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি৷ নারী ও পুরুষ যেন একটি কাগজের এপিঠ-ওপিঠ৷ দুইয়ের মধ্যে একচ্ছেদ্য সম্পর্ক বর্তমান৷ একপক্ষকে বাদ দিলে অপরপক্ষের অস্তিত্ব সংকট দেখা দেয়৷ মানুষ্য সৃষ্টির প্রথম ভাগে মানুষ যখন অরণ্যচারী ও পর্বত গুহাবাসীর জীবন যাপন করত, সে সময় মানুষের সমাজে কোনও বন্ধন ছিল না--- তাদের জীবনযাত্রা ছিল অনেকটাই বন্য প্রাণী সুলভ, ছন্নছাড়া৷ পরবর্তীকালে যখন মানুষ একটু সঙ্ঘবদ্ধ হতে শিখল ও এক-একটা পাহাড় বা গোত্রকে কেন্দ্র করে সমাজের বাঁধন শুরু হ’ল তখন সেই সমাজ ছিল মাতৃকেন্দ্রিক৷ গোষ্ঠীমাতার নিয়ন্ত্রণেই গোষ্ঠীর কাজকর্ম পরিচালিত হ’ত৷ নারী প্রধান সেই সমাজ ব্যবস্থায় নারী সম্মান ছিল উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত৷ মাতৃকেন্দ্রিক এই সমাজ ব্যবস্থা পৃথিবীর বুকে দীর্ঘকাল প্রচলিত ছিল৷  পরবর্তী পর্যায়ে মানুষ ক্রমে বিভিন্ন রকম অস্ত্রের ব্যবহার শিখল ও অস্ত্র বিদ্যায় পারদর্শীদের গুরুত্ব সমাজে বেড়ে যেতে লাগল কারণ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও জনজাতিরমধ্যে সর্বদাই যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে থাকত জীবন সংগ্রামের অঙ্গ হিসেবেই৷ যারা এই যুদ্ধবিদ্যায় অতিশয় দক্ষ ছিল তারা বিভিন্ন এলাকায় তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করল ও বিজিত নারী-পুরুষদের নিজেদের অধীনে নিয়ে এল৷ বিজিত পুরুষরা দাস ও নারীদের দাসী  তথা সন্তান উৎপাদনের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের লোকবল বাড়াতে প্রয়াসী ছিল৷ এইভাবেই সামাজিক বিবর্তনে ক্ষত্রিয় যুগের সূচনা হ’ল৷ এই পর্যায়ে নারীদের শারীরিক কিছু দুর্বলতা, বিশেষতঃ গর্ভধারণ ও প্রসব পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিকভাবেই তাদের অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছিল৷ ফলে সমাজের নারীদের প্রতিপত্তি একটু একটু করে কমতে শুরু করে ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজের গোড়াপত্তন হয়৷ ক্ষত্রিয় সমাজে ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’---এই নীতির প্রাধান্য পরিলক্ষিত হ’ল ও পিতৃতন্ত্রের শিকড় ক্রমশঃ সমাজ ব্যবস্থায় আরও বেশী দৃঢ় হতে থাকল৷

কালক্রমে সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে মানব মনীষারও ক্রমোন্নয়ন ঘটার ফলে মানুষ বৌদ্ধিক স্তরে আরও উন্নত হ’ল ও বিপ্রগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়৷ তৎকালীন বিপ্র সম্প্রদায় তাদের বুদ্ধিবলে ক্রমশঃ ক্ষত্রিয়কুলকে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসতে সমর্থ হ’ল৷ সমাজের শাসন ব্যবস্থা ক্ষত্রিয়েরর হাতে ন্যস্ত থাকলেও বৌদ্ধিক পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ বিপ্র সমাজের করায়ত্ত হয়ে গেল৷ বস্তুত ক্ষত্রিয়ের বৌদ্ধিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ও তাদের সহযোগিতায় সমাজে বিপ্রের শোষণ আরও তীব্র হয়ে উঠল৷ তৎকালীন নারী সমাজও এই শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকল ও তাদের ব্যষ্টি স্বাধীনতা খর্ব হতে হতে একেবারে শোচনীয় স্তরে নেমে গেল৷ বিবিধ বিধি-নিষেধের নিগড়ে নারীর জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকল ও তাদের আত্মসম্মান, মর্যাদা সবই ভুলুণ্ঠিত হ’ল৷ ধর্ম সাধনা ও শিক্ষা-দীক্ষার অধিকার থেকেও তাদের বঞ্চিত করা হ’ল৷ সমাজ শোষণের আর একটি অঙ্গ জাতিভেদ প্রথার প্রচলনের ফলে সার্বিকভাবে মানুষের অবমূল্যায়ণের কারণে নারী সমাজের মর্যাদা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে৷ তারা পুরুষের সেবাদাসী ও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রে পর্যবসিত হ’ল৷

পরবর্তীকালে মানুষের সমাজ যখন বিপ্র যুগের হাত ঘুরে বৈশ্য যুগে এসে পৌঁছল তখন নারী সমাজের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে ওঠে৷ এই যুগে তারা একটি ভোগ্যপণ্য হিসেবে পরিগণিত হ’ল যার রেশ বর্তমানের তথাকথিত সভ্য সমাজের বৈশ্য নিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থায় আরও বেশী প্রকট৷ শিশু থেকে পরিণত বয়স্ক সব বয়সী নারীর অবস্থাই সম্প্রতি মর্মান্তিক স্তরে পৌঁছে গেছে৷ এক ধরণের বিকৃত মানসিকতা যুক্ত মানুষের দুর্দম ভোগ -লালসা ও ঘৃণ্য লোভের শিকার হয়ে নারীরা কালাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে৷ সমাজের অবহেলা ও সহমহির্মতার অভাবের দরুণ বহু মহিলা বিপথে চালিত হয়ে অন্ধকার জগতে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে৷ এখনও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও রাজ্যে পণপ্রথা নারী সমাজের কাছে অভিশাপ স্বরূপ৷ পণপ্রথার বলি হয়ে অজস্র নারী ও তাদের আত্মীয় পরিজনকে চোখের জলে দিনাতিপাত করতে হয়েছে, এমনকি মৃত্যুবরণ করতেও বাধ্য হয়েছে৷ এই কারণে হাজারে হাজারে কন্যা ভ্রূণ হত্যা ও সদ্যজাত শিশুকন্যাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে বিসর্জন দিতে হয়েছে৷ পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেক পুরুষ ও অর্ধেক নারী৷ সমাজের অর্ধেক সংখ্যা যদি পিছিয়ে থাকে, চোখের জলে জীবনের সব সুখ জলাঞ্জলি দেয় তবে সেই সমাজের সর্বাত্মক উন্নতি কোনভাবেই সম্ভব নয়৷ যদিও অতীতকাল থেকেই মানব সমাজে নারীগণের অবদান অনস্বীকার্য৷ সুদূর অতীতে নারীদের মধ্যে অগ্রগণ্যা কুন্তী, গান্ধারী, দ্রৌপদী সত্যভামা, গার্গী, মৈত্রেয়ী থেকে শুরু করে মাদার টেরেসা, সিস্টার নিবেদিতা ও আধুনিক জগতের মাদাম কুরী, সুনীতা উইলিয়ামস্‌ প্রমুখ অনেক বিদূষী, সেবাব্রতী, মহীয়সী নারীগণের নাম অবিস্মরণীয়৷ পুরুষ অপেক্ষা নারীকে দুর্বল বা নিম্নস্তরের মনে করার কোনও কারণ নেই৷ তারা পুরুষের থেকে কোনও অংশে কমও নয়, পিছিয়েও নেই৷ বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সংবেদনাত্মক মানবিক গুণাবলী অনেক বেশী উন্নত৷ সমান সুযোগ পেলে তারাও পুরুষের সঙ্গে সব ক্ষেত্রেই অনায়াস দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারে৷ শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্পকলা, ব্যাবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞান সাধনা, বিমান চালনা, যুদ্ধক্ষেত্র, পর্বতরারোহন, ক্রীড়াজগৎ প্রভৃতি জীবনের সব ক্ষেত্রেই নারীরা সমান দক্ষতাই বর্তমানে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে ও কৃতিত্বের ছাপ রাখছে৷ যদিও এই সংখ্‌্যা খুব বেশী উৎসাহব্যাঞ্জক নয়৷ বিভিন্ন দেশের গ্রামে গঞ্জে বসবাসকারী মহিলাগণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের ব্যবস্থা সমাজ ও সরকারকেই করতে হবে যাতে যুগসঞ্চিত অশিক্ষা-কুশিক্ষার অন্ধকার, কুসংস্কার, ভাবজড়তার তমসামুক্ত হয়ে তাঁরা সমাজের মান উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন৷ নারীদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হলে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস  বৃদ্ধি ও পরনির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে আর তার সুফল সামগ্রিকভাবে সমাজকেই উন্নীত করবে৷ নারীগণের মধ্যে সহজাত সেবাপরায়নতা, মমতা, স্নেহ-ভালবাসা এইসব মানবিক গুণগুলি তাদের আরও মহীয়সী করে তুলেছে যার স্পর্শে মানব জীবন তথা সমগ্র মানব সমাজ উপকৃত ও ধন্য৷ তাই মহিলাদের যথাযথ সম্মান ও মর্যদার আসনে  অধিষ্ঠিত করার দায়িত্ব সমাজকেই নিতে হবে৷ আর এই কাজে পুরুষ সমাজকে আরও বেশী সংবেদনশীল, সহযোগিতা প্রবণ ও সক্রিয় হতে হবে৷ তবেই মানব সমাজ সর্বাঙ্গসুন্দর মানুষের সমাজে পরিণত হবে৷ নারী সমাজকে পরাধীনতার বেড়াজালে আবদ্ধ না রেখে পুরুষের পাশে হাতে হাত দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলার অঙ্গীকার নিতে হবে সমাজের সকলের স্বার্থে৷ সমাজের ভাবী নাগরিক, শিশুদের স্নেহ-মমতা-ভালবাসা দিয়ে পরিচর্যা করে সুনাগরিক ও মানুষ করে তোলে এই নারীকুল---সুতরাং ভাবী প্রজন্মের স্বার্থেও তাঁদের যথোচিত সম্মান ও মর্যাদা অবশ্যই প্রাপ্য৷                          

নারীর মর্যাদা সম্পর্কে মহান দার্শনিক প্রাউট-প্রবক্তা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের মন্তব্য বিশেষ অনুধাবনযোগ্য---‘‘সমাজের শতকরা পঞ্চাশ জন লোক যদি কুসংস্কারাচ্ছন্ন জড় হয়ে থাকে তাহলে সমাজের বাকী পঞ্চাশ জনকে এই জড়ের বোঝা বয়ে নিয়ে এগিয়ে চলতে রীতিমত বেগ পেতে হবে৷ ব্যষ্টিগত জীবনে শুচিতা নারী-পুরুষ দুয়েরই সমানভাবে প্রয়োজন আর সে প্রয়োজন সিদ্ধ করতে গেলে সত্যিকারের অধ্যাত্ম দৃষ্টি থাকা দরকার৷ নারী বা পুরুষ কারও প্রতি অবিচার করে এ প্রয়োজন সিদ্ধ হবার নয়৷ মানুষ মাত্রেরই বোঝা দরকার যে কোন কিছুকে গড়ে তুলতে গেলে বা বাঁচিয়ে রাখতে গেলে তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে দরকার একটি নিবিড় সহযোগিতামূলক আচরণের৷..... এই সহযোগিতাটা প্রভু-দাসের সম্পর্কে গড়ে না উঠে স্বাধীন মানুষের স্বহৃদয়তাপূর্ণ পরিবেশেই গড়ে উঠা দরকার৷That should be a co-ordinated co-operation and not a sub-ordinated one.’’ এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে এখনও ধর্ম সাধনার ক্ষেত্রে ও অনেক মন্দির-মসজিদ্‌-দেবালয়ে নারীর অবাধ প্রবেশাধিকার নেই বা থাকলেও বিভিন্ন রকম বিধিনিষেধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত৷ কিন্তু আনন্দমার্গ দর্শনে নারী-পুরুষ সকলকেই সমস্ত রকম ধর্মাচরণে ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনে উৎসাহ তথা সমানাধিকার প্রদান করা হয়েছে ও নারী সমাজের প্রতি কোন কুসংস্কার বা ভাবজড়তা সঞ্জাত বিধিনিষেধকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি যাতে তারা কোনভাবেই সামাজিক বা ধার্মিক অবিচারের বা শোষণের শিকার হন৷ সমাজের অর্ধেক অংশ নারী সমাজকে তাদের সমস্ত সঙ্গত অধিকারকে মর্যাদা দিয়ে সকলে একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারলেই পৃথিবীর সম্যক সর্বাত্মক মঙ্গল সাধিত হবে ও মানব সমাজ একটি শোষণমুক্ত সমাজ হিসেবে গড়ে উঠবে৷

‘আন্তর্জাতিক নারী দিবসে’ সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের দাবী হোক---কন্যাভ্রূণ হত্যা চলবে না, পণপ্রথাকে কোন ভাবেই প্রশ্রয় নয় ও এর বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব পোষণ করে পণ বিরোধী আইনকে সঠিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে হবে, প্রতিটি নারীর সুশিক্ষার ব্যবস্থা সম্পূর্ণত সরকারী ব্যয়ে সুনিশ্চিত করতে হবে, কোন নারী যেন কোনভাবেই অবহেলা বা বঞ্চনার শিকার না হয়, অর্থনৈতিক, বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক সবক্ষেত্রেই নারীজাতির সার্বিক উন্নতিকল্পে সচেষ্ট হতে হবে যাতে আগামী প্রজন্ম সুনির্দিষ্ট স্নেহ-লালিত শান্তির নীড়ে বসবাস করে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়৷ একমাত্র তখনই এই ‘নারী দিবস’কে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন সম্ভব হবে৷