বাংলা ভাষা ও বাঙালী জনগোষ্ঠী সম্পর্কে কিছু মূল্যবান তথ্য

লেখক
(‘কণিকায় প্রাউট’ ও ‘বাংলা-বাঙালী’ গ্রন্থের অনুসরণে একর্ষি কর্তৃক সম্পাদিত)

নৃতাত্ত্বিক বিচারে জাতিসত্তার উন্মেষ   হয় ভাষাকে কেন্দ্র করে৷ এর প্রকাশ ও বিকাশ ভৌম পরিচয়ে৷ সাবেক বাংলা বা অখন্ড বাংলা বা গৌড়বঙ্গের মাটির ভাষা বাংলা৷ বর্তমান বাঙালী জাতির পরিচয় ওই ভাষা দিয়েই৷ তাই ভাষা সংক্রান্ত তথ্যাবলী তো মনে গেঁথে রাখতেই হবে৷

l পৃথিবীর প্রধান ভাষাগুলির মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় (পোটেনশিয়াল) ভাষা হল বাংলা৷ এই ভাষা আগামী দিনে বিশ্বভাষা হওয়ার সম্ভাবনায় ভরপুর৷

l সাহিত্য সম্ভারের বিচারে বিশ্বে বর্তমানে ৪থ সাহিত্য সমৃদ্ধ ভাষা হল বাংলা৷

l ইউনেসকোর ভাষা বিভাগের অনুসন্ধানের প্রতিবেদন  হল-পৃথিবীর মধুরতম ভাষা হল বাংলা৷

l সঙ্গীতের জগতে অতলান্ত গভীর ভাবের অনুভূতির ব্যঞ্জনায় উদ্বেল ভাষার নামও বাংলা৷

l আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে শব্দসম্ভারের বিচারে  প্রথম ভাষার নাম বাংলা৷

l পৃথিবীর বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর  ভাষা বাংলা৷ চীনা ভাষার  পরেই বাংলা ভাষার স্থান৷

l সাবেক বাংলা খন্ড-বিখন্ড হলেও আজও সংখ্যা গরিষ্ঠ ভারতীয়দের ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ (মাতৃভাষা) বাংলা, হিন্দী নয়৷ কাজেই সংখ্যা ও শক্তির  বিচারে রাষ্ট্রভাষা হওয়ার একমাত্র দাবিদার বাংলা, হিন্দী নয়৷ তাছাড়া হিন্দী মাটির ভাষা নয়, কোন ভারতীয়ের মাতৃভাষাও নয়৷ ভারতীয় সংবিধান মোতাবেক হিন্দী ভারতের রাষ্ট্রভাষাও নয়, গায়ের জোরে রাষ্ট্রভাষা বলে চাপানো ও চালানো হচ্ছে৷

বাংলা ভাষার উৎস সংস্কৃত৷ তবে আধুনিক গবেষকদের মতে সংস্কৃত বিদেশ থেকে আসা ভাষা নয়৷ অর্র্থৎ সংস্কৃত বৈদিক ভাষা থেকে আসেনি৷ সংস্কৃত ভাষা ভারতেরই মাটির ভাষা৷ আর্যদের আবির্র্ভবের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই৷ আর্যদের বৈদিক ভাষার সঙ্গে সংস্কৃত ভাষার  অনেক পার্থক্য ৷ প্রমাণ হিসাবে  তাঁরা দেখাচ্ছেন  যে রাঢ় বাংলায় (পশ্চিম রাঢ়) (প্রাচীন গন্ডোয়ানা ল্যান্ডের পূর্র্বংশে, হিমালয় সৃষ্টির বহু পূর্বে এর উৎপত্তি) মানুষেরা যে বাংলা উপভাষা ব্যবহার করে তার প্রায়  ৯২  শতাংশ  শব্দ প্রত্যক্ষ ও  পরোক্ষভাবে সংস্কৃত শব্দ থেকে গৃহীত হয়েছে৷ ফলে রাঢ়ে ভাষা এত ধনী হয়েছে৷ ভাষাতত্ত্বের বিচারে সংস্কৃত বিদেশী ভাষা হলে এটা  সম্ভব ছিল না৷ বৈদিক ভাষার সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃত ভাষার অনেক পার্থক্য ছিল, কিছু মিলও ছিল৷ তবে বৈদিক  সংস্কৃত ভাষার সংস্পর্শে ভারতীয় সংস্কৃত ভাষা আরও সমৃদ্ধ হয়েছে৷ ভাষাচার্য, প্রাউট প্রবক্তা, দার্শনিকশ্রেষ্ঠ  শ্রীপ্রভাত রঞ্জন সরকার এই কথাই বলেছেন৷

বাংলা ভাষা সহ ভারতীয় অন্যান্য প্রাকৃত ভাষার উৎস হল সংস্কৃত ভাষা৷ আর প্রাকৃত ভাষা হল জনগণের মুখের ভাষা৷ প্রাকৃত ভাষায় বৈদিক সংস্কৃত ভাষার প্রভাবে ৭টি বিবর্তন লক্ষ্যণীয়৷  পূর্ব ভারতে ব্যবহৃত প্রাকৃত ভাষার নাম ‘মাগধী’ প্রাকৃত৷ এই ভাষার মূল শাখা দুটি ১) পূর্ব অর্ধ মাগধী ২) পশ্চিম অর্ধ ‘মাগধী’৷ পূর্ব  অর্ধ মাগধীর আবার ৬টি শাখা রয়েছে ---  ১) বাংলা ২) ওড়িয়া ৩)  অসমিয়া ৪) মৈথিলী ৫) কোশলী ৬) অঙ্গিকা৷

এই প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়৷ ভাষা নিয়ে বলতে গেলে কয়েকটা কথা  মাথায় রাখতেই হবে৷  প্রথম কথা হল ভাষা শিক্ষার্থী, ভাষা-আলোচক , ভাষা-সচেতন  সকলের কাছেই ভাষা ও  উপভাষা  শব্দ দুটি  পরিচিত৷ তথাপি  শব্দ দুটির  সম্যক  পরিচয় স্মরণে  রেখে অগ্রসর  হওয়াই  যুক্তি সঙ্গত ৷ সাধারণ ভাবে  মনোভাব প্রকাশের  জন্য বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত অর্থবহ,  বহুজন বোধ্য ধবনিসমষ্টিকেই বলা হয় ভাষা৷  আর কোনো ভাষাসম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছোট ছোট দলে বা অঞ্চল বিশেষে উচ্চারণ ভেদে  প্রচলিত মুখের ভাষার ছাঁচকেই বলে উপভাষা৷ তাই  ভাষাবিজ্ঞান  ভাষাতত্ত্বের  নিরিখে  ভাষা কতগুলি  উপভাষারই সমাহার ৷  যেমন ১৭ টি উপভাষার সমষ্টি  ফরাসী ভাষা৷ অনেকে মনে করেন উপজাতিদের  ভাষাই  হল উপভাষা৷ উপজাতিদের  ভাষা ও উপভাষা এক হতে পারে না৷  তাহলে প্রশ্ণ তো উঠবেই  ভাষা ও উপভাষার সীমারেখাটা কী? এবিষয়ে  উল্লেখ্য প্রাউট-প্রবক্তা ভাষাবিজ্ঞানী-দার্শনিক শ্রেষ্ঠ শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকারের বক্তব্যটি৷ শ্রী সরকার  বলেছেন -‘‘মোটামুটি  বিচারে আটটি মূল শর্তের উপর ভাষা  দাঁড়িয়ে আছে- অনেকটা আটপৌরে  চৌকির মতো৷ এই আটটি হচ্ছে - ১) নিজস্ব  শব্দভান্ডার ২) নিজস্ব সর্বনাম ৩) নিজস্ব ক্রিয়ারূপ ৪) নিজস্ব শব্দরূপ ৫) নিজস্ব মৌখিক ও লিখিত সাহিত্য ৬)নিজস্ব উচ্চারণ নীতি ৭) নিজস্ব মানসবোধাত্মক ধবনিবিজ্ঞানগত ও তন্মাত্রিক বোধাত্মক অভিব্যক্তি ৮) কর্র্ত-কর্মগত ব্যাকরণসম্মত সংরচনাশৈলী syntex)৷ যে কোন ভাষা-সম্প্রদায়ের ব্যবহৃত কথ্যভাষাকে তখনই  ভাষা বলা যাবে যখন  তাতে উপরের আটটি শর্ত বজায় থাকে, না থাকলে  সেই ভাষাকে  ভাষা বলা যাবে না৷’’

সব ভাষারই দুটি করে রূপ আছে- কথ্যভাষা ও লেখ্যভাষা৷ অর্থাৎ ভাষা কথ্য ও লেখ্য উপভাষার  সমন্বয়েই গড়ে ওঠে৷ আর একটি কথা, কোনো একটি ভাষা বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে প্রচলিত থাকলে ভৌগোলিক জলবায়ুগত বা ভৌম পরিবেশের সংরচনায় মানুষের বাগ্যন্ত্রের গঠন ও অভিপ্রকাশগত পরিবর্ত্তন ঘটে৷ ফলে বিভিন্ন অংশে ভাষার ব্যবহারগত ও উচ্চারণগত কিছু কিছু রূপান্তর দেখা যায় ৷ ফলে অঞ্চলভেদে ভাষা পরিবর্তিত হয়ে নোতুন রূপ পায় অথচ মূল ভাষার পূর্র্বেক্ত শর্ত গুলোও বজায় থাকে৷ অঞ্চলভেদে মূল ভাষার পরিবর্তিত রূপই হল ‘উপভাষা’৷ ১২ মাইল ব্যবধানে পরিবর্তন শুরু হয়৷ স্থানিক দৈর্ঘ্য যত বাড়ে ভাষাগত পরিবর্তনও তত বাড়ে৷ নোতুন উপভাষাও জন্ম নেয়৷ এমনকী মূল ভাষাটিও পালটে যেতে পারে৷ নোতুন ভাষা আত্মপ্রকাশ করতে পারে৷  তাই প্রতিটি উপভাষাই কোনো না কোনো ভাষার পরিভুর মধ্যে এসে যায়৷ (প্রত্যেক জীবন্ত ভাষারই উপভাষা রয়েছে) আবার অধিকাংশ ভাষারই একাধিক উপভাষা থাকে৷ বাংলা ভাষারও অনেক গুলি উপভাষা আছে৷ পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক বাংলা সিলেবাসে ভাষা ও উপভাষা সম্পর্ক প্রসঙ্গে প্রতিটি উপভাষাকে গুরুত্ব সহকারে  বিচার না করে একটা মনগড়া শ্রেণীবিভাগ করে বলা হয়েছে যে, বাংলা উপভাষা পাঁচ প্রকার যেমন- রাঢ়ী, বাঙ্গালী, ঝাড়খন্ডী, কামরূপী ও বরেন্দ্রী৷ কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানের  সম্যক বিচারে প্রমাণিত যে বাংলা ভাষাতে ১২টি উপভাষা আছে৷ তাদেরও নিজস্ব খন্ড-উপভাষা আছে৷ যা ছড়িয়ে রয়েছে সাবেক অখন্ড বাঙলা তথা পঞ্চগৌড় জুড়ে৷

মূল বাংলা ভাষার এই বারটি উপভাষা বাঙালীস্তানের যে যে ভৌম-এলাকায় রয়েছে, সংক্ষেপে তা হ’লো ঃ-

(১)  মধ্য রাঢ়ীয় বাংলা - দুমকা, জামতারা, দেওঘর, নলহাটি ও মুরারই বাদে বীরভূম জেলা বর্ধমানের দুর্র্গপুর থেকে আসানসোল ইন্দাস বাদে বাঁকুড়া জেলাসিংভূম জেলার উত্তরপূর্র্বংশ ধানবাদ, গিরিডি ও রাঁচী জেলার অংশ বিশেষ আর কাঁথি এলাকা বাদে মেদিনীপুর জেলা৷

(২)  কাঁথি বাংলা - রসুলপুর নদীর মোহনা থেকে সুবর্র্ণরেখা নদীর মোহনা পর্যন্ত৷

(৩)  কলিকাতা বাংলা - কলকাতা, (উভয়) চবিবশ পরগণা, হুগলি, উলুবেড়িয়া বাদে হাওড়া জেলা৷

(৪)  নদীয়া বাংলা - নদীয়া জেলা, বর্ধমানের কালনা মহকুমা বীরভূম ও নৈহাটি আর পূর্ব মুর্শিদাবাদের দক্ষিণাংশ৷

(৫)  শেরশাহবাদীয়া বা মালদাইয়া বা জঙ্গীপুরী বাংলা-মুর্শিদাবাদ জেলার অধিকাংশ এলাকা পাকূড় ও রাজমহল মহকুমা মালদা জেলা কাটিহার জেলার বারসই এলাকা ও পূর্র্বংশের কিছু কিছু এলাকা উত্তর দিনাজপুরের ডালখোলা ও রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ মহকুমা৷

(৬) বারেন্দ্রী বাংলা - নবাবগঞ্জ মহকুমা বাদে রাজশাহী জেলা পাবনা জেলার পশ্চিমাংশ দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাংশ কুষ্ঠিয়া জেলার উত্তরাংশ ও বগুড়া জেলার দক্ষিণাংশ৷

(৭) রংপুরী বাংলা - রংপুর জেলা দিনাজপুর জেলা উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা কুচবিহার জেলা জলপাইগুড়ি জেলা দার্জিলিং জেলার সমতট অংশ পূর্ণিায়া জেলার কিছু অংশ বগুড়া জেলার অংশ বিশেষ আসামের গোয়ালপাড়া ও নেপালের ঝাঁপা জেলা৷

(৮) সিলেটি বাংলা - সিলেট, কাছাড়, করিমগঞ্জ, কুমিল্লা জেলা ও খাসিয়া-জয়ন্তিয়া পাহাড়ের সমতল অংশ৷

(৯)  ঢাকাই বাংলা বা বিক্রমপুরী বাংলা - ঢাকা জেলা গোপালগঞ্জ মহকুমা বাদে ফািদপুর জেলা ও পাবনা জেলার পূর্র্বংশ৷

(১০) যশোর বাংশ - যশোর জেলা খুলনা জেলা ও ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমা৷

(১১) বরিশাল বা চন্দ্রদ্বীপী বাংলা - বরিশাল জেলাখুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমা ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর মহকুমা ও পটুয়াখালি জেলা৷

(১২) চট্টল বাংলা - দক্ষিণাংশ বাদে সমগ্র চট্টগ্রাম জেলা ও নোয়াখালি জেলার কিছু অংশ৷ এই ভাষায় অনেকগুলি উপভাষা আছে৷

এছাড়া রয়েছে কিছু উপভাষার (ডায়লেকটসের) খন্ড উপভাষা (সাব-ডায়েলেক্টস্)

ক) কেরা বাংলা ঃ এই সাব-ডায়লেক্টস্ টি উত্তরী উড়িয়া ও রাঢ় বাংলার  অদ্ভুত সমন্বয়৷ ওড়িশা ও বাংলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বারিপদা থেকে হলুদপুরের দু-পাড়ের মানুষ  এই ‘কেরা  বাংলায়’ কথা বলে৷

খ)খোট্টা বাংলা ঃ এই খন্ড উপভাষাটি (সাব-ডায়লেক্টস্)  বাংলা ও মাগধী ভাষার মিশ্রণ জাত৷ খোট্টা বাংলার দুটি ভাগ (অ) দক্ষিণী খোট্টা বাংলা ও (আ) উত্তরী খোট্টা বাংলা৷

অ) দক্ষিণী খোট্টা বাংলা---বোকারো থেকে হাজারিবাগের মধ্যবর্তী অঞ্চলে দক্ষিণী খোট্টা বাংলা৷

আ) উত্তরী খোট্টা বাংলা--- এই খন্ড উপভাষাটি (সাব-ডায়লেক্টস্) শেরশাহের  বাংলা ও অঙ্গিকার  বিমিশ্রণ৷ মালদা  জেলাসহ সীমান্তবর্তী অঞ্চল তথা কাটিহার শহরের পূর্বদিক পর্যন্ত খোট্টা বাংলা উপভাষাটির প্রচলন আছে৷

শ্রীপুরিয়া বাংলা ঃ এই খন্ড উপভাষা বা  সাব-ডায়লেক্টস্টি রংপুরী বাংলা অঙ্গিকার বিমিশ্রণগত উপভাষা৷ এই কথ্য উপভাষা ব্যবহৃত হয় কিষাণগঞ্জ থেকে পূর্ণিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলে৷

ঘ) জাবার্দি  বাংলা ঃ এই সাব-ডায়লেক্টস্টি বাংলা ও মগী উপভাষা (আরকান) ভাষার বিমিশ্রণ৷ নাফ নদীর অববাহিকায় কক্সবাজার মহকুমার টেক নাফ্ থানার অংশ ও মায়ানমারে এটি প্রচলিত আছে৷ মোটামুটি বিচারে টেকনাফ,মংদ, বুমিডং প্রভৃতি স্থানে এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়৷

ভাষা ও উপভাষার  পার্থক্যকে ক্রিয়ারূপের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার বোঝা যায়৷ সাধারণত ভাষার ক্রিয়ার স্পষ্ট রূপের বদলে একটা পরিবর্তিত স্থানিক রূপ পাওয়া যায়৷ তবে শিক্ষার  ব্যাপক প্রসার, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, বিজ্ঞান সচেতনতার প্রভাবের ফলে সাধারণ মানুষ আর উপভাষা ব্যবহার করবে না৷ এর ফলে বাংলা ভাষার প্রতিটি উপভাষার স্বাভাবিক গতিই হল সাহিত্যিক বাংলার দিকে৷

একথা মনে রাখতে হবে ভাষাকে আশ্রয় করে ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠী বা মানব সমাজের সৃষ্টি হয়েছে৷ মানব সমাজ যেমন পরিবর্তিত হয়েছে যুগে যুগে তেমনি ভাষাও কালে কালে রূপান্তরিত হয়েছে ৷ নানা পরিবর্তনের  মধ্য দিয়ে পৃথিবীর  বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জনসমাজে নানা ভাষা জন্ম  নিয়েছে ৷ বাঙালী বা ভারতীয়দের ঠোঁটের ডগায়  আজ তো সংস্কৃত নেই, কোথায় সে? সে তো বাংলা সহ  আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলির অন্তরেই আত্ম বিবর্তিত৷ বাঙলায় তো এককালে অষ্ট্রিক, নিগ্রো, দ্রাবিড় (নিগ্রো ও অষ্ট্রিকদের মিশ্রণজাত ) মঙ্গোলীয়, আর্যরা তো ছিলই৷ তারা এখন কোথায় ? সবাই হয়েছে একেতে হারা ৷ নাম হয়েছে বাঙালী৷ কৃষ্ণের শতনামের মত কত পরিচয়েই না বাঙালীর অভিপ্রকাশ৷ অর্র্থৎ বাঙালী একটা শঙ্কর জনগোষ্ঠী৷

কিন্তু বাঙালী কে? কোথায়? কী তার স্বরূপ?  বাঙালীর

বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ঃ- বাঙালী একটি শঙ্কর জনগোষ্টী৷ পৃথিবীর প্রধান জনগোষ্ঠী ৪ টি  ১) নিগ্রো ২) অষ্ট্রিক ৩) আর্য ৪) ও মঙ্গোলীয়৷ বাঙালীর মধ্যে চারটি সম্প্রদায়েরই মিশ্রণ ঘটেছে৷  অষ্ট্রিক নিগ্রোর মিশ্রণে  তৈরী হয়েছে দ্রাবিড় সম্প্রদায়ের৷ বাংলা দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয় রক্তের ব্যাপকভাবে সংমিশ্রণ ঘটেছে ৷ বাংলার পশ্চিমাংশে অষ্ট্রিক গোষ্ঠীভুক্ত দ্রাবিড় সম্প্রদায়ের প্রাধান্য৷  উত্তর-পূর্বে ছিলো  মঙ্গোলীয়দের প্রাধান্য৷  আবার দক্ষিণ-পূর্বে দ্রাবিড়দের সংখ্যা কম,  মঙ্গোলীয়দের  ছিলো সংখ্যাধিক্য৷ মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীভুক্ত  চাকম, ত্রিপুর,  বোড়ো,কোচ, কিরাত, চূয়াড় দ্রাবিড় গোষ্ঠীভুক্ত , কৈবর্ত, বাগ্দি, দুলে, শবর, কুর্মী ,মাহাত, খেড়িয়া, অষ্ট্রিক ভাবপ্রধান  সাঁওতাল, বাউড়ি, মালপাহাড়ী (মাল বা মালো) প্রভৃতিরাই সাবেক বাঙালী এদের এই পারস্পরিক মিশ্রণে ভাবের আদান-প্রদানে বাংলা সভ্যতা গড়ে উঠেছে৷ অনেক পরে আর্য রক্তের মিশ্রণ ঘটেছে৷ আধুনিক বাঙালী জাতি ওদেরই মিশ্রণজাত     পরিণাম৷ 

আবার বাংলার সভ্যতাও তিনটি ব-দ্বীপীয় সভ্যতা বিমিশ্র রূপ৷ গঙ্গা নদীর উপত্যকার সভ্যতা, ব্রহ্মপুত্র নদীর সভ্যতা, ও দামোদর নদীর উপতক্যার  সভ্যতা৷ এটাই জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ বিমিশ্র সভ্যতা৷  প্রায় সাড়ে  ৩ হাজার বছরের প্রাচীন৷

সামাজিক বিন্যাস ঃ- বাঙালীদের সামাজিক বিন্যাসের ক্ষেত্রে কোনো জাতপাত ছিলো না ৷  তবে সামাজিক পরিবেশগত কারণে বাঙালীদের মধ্যে বিভিন্ন  শ্রেণীর উদ্ভব হয়৷  এদের নাম যথা- ১)কৈবর্ত ২) নমঃশুদ্র ৩) গোপ ৪) মাহাত ৫) রাজবংশী ৬) চাকমা৷ বাঙালী বলতে ওই প্রধান ৬টি শ্রেণীর সঙ্গে আছে অসংখ্য উপজাতি বা জনজাতি ৷ যথা-  ত্রিপুরী, বোড়ো , কিরাত, কোচ, হাজং, ডালু, বাগদী, দুলে, শবর,

লোধা, পুলিন্দ, ক্ষেরিয়া, সাঁওতাল, হো, সিংথুরা, খাঙ্গার, মুড়া, খেলিয়ামুড়া, কুশমেটমুড়া, চূয়াড়, কুর্মী, বাউড়ি, মালপাহাড়ী, রোহিঙ্গা প্রভৃতি৷  এরা সবাই জাত বাঙালী৷ আর্থ-ভাষা-সাংস্কৃতিক অটুট বন্ধন,  প্রকৃতশিক্ষা,বিজ্ঞান শিক্ষা ,  আধ্যাত্মিক চেতনা একদিন একটা অখন্ড বাঙালীর জাতিসত্ত্বা গড়ে তুলবে যেখানে কোনো শ্রেণীভেদ থাকবে না৷

বাঙালীর আবাসভূমির ভৌগোলিক পরিচয় ঃ অবস্থান, সীমা, ক্ষেত্রমান ঃ- ১৮৭২ সালে প্রকাশিত মানচিত্র অনুযায়ী বাংলার দক্ষিণসীমা ১৯ ডিগ্রী ১৮  অক্ষাংশ থেকে ২৮ ডিগ্রী ১৪’ অক্ষাংশ পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিমে ৮২ ডিগ্রী পশ্চিম দ্রাঘিমা থেকে  পূর্ব দ্রাঘিমা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল৷ 

বাঙলার উত্তরে নেপাল , ভুটান ও সিকিম, দক্ষিণে মাদ্রাজ ও বঙ্গোপসাগর ৷  পূর্বে মায়ানমার ও চীন সীমান্ত৷ পশ্চিমে  যুক্ত প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ ৷ মোঘল যুগ থেকে ব্রিটিশ রাজত্বকাল পর্যন্ত এটাই ছিলো বাংলার সংস্কৃতির সীমা৷ ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ভারতে ১৮৭১ সালেই প্রথম জমি জরিপ ও লোক গণনার শুরু হয়৷  ১৮৭২ সালে তার প্রথম প্রকাশ৷ প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলা বিভিন্ন রাজার রাজ্যর ভুক্তির ফলে বাংলার সীমানার কিছু হেরফের হলেও মূল ভুখন্ড একই ছিল৷  ব্রিটিশ-ই প্রথম নানান অজুহাতে  বাঙলাকে টুকরো টুকরো করে বার বার কাটা ছেঁড়ার ফলে বাংলার অসংখ্য জনপদের সাবেক নামও পাল্টে যায়৷  সাবেক বাংলার ক্ষেত্রমান  -৫,৩৫,৪৭১ বর্গকিমি৷

 ভূতত্ত্ব ঃ-  ভূতত্বের বিচারে এই বিশাল ভূখন্ড-এর পশ্চিমাংশ ছিল  গন্ডোয়ানাল্যান্ড -এর  অন্তর্ভুক্ত উঁচু-নীচু  যার নাম রাঢ়ভূমি৷  পূর্র্বংশে ছিল গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পলিমাটি দিয়ে গড়া যার নাম নিম্ন গাঙ্গেয় সমভূমি ৷ রাঢ় সম্পর্কিত তথ্যপঞ্জী  থেকে জানা যায় যে, চীন ভূমিকে নাম দিয়েছিল লাতি, গ্রীস নাম দিয়েছিল গঙ্গারিডি আর্যরা নাম দিয়েছিল  রাট্ ৷  রাজশক্তি রূপে ভারতে আত্মপ্রকাশের সময় বাংলার সীমা ছিল উত্তরে বরফাচ্ছাদিত হিমালয়, উত্তর-পূর্বে চীন সীমানা৷ দক্ষিণ সীমা দাক্ষিণাত্যের মালভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল৷  সমুদয় অঞ্চলই পার্বত্য সর্বদা গভীর অরণ্যানী  দ্বারা আবৃত থাকত৷  সর্ব দক্ষিণে ছিল বিস্তৃত বঙ্গোপ সাগর- জল সম্পদের বিপুল ভান্ডার৷

বাঙালীর বাসভূমির আঞ্চলিক পরিচয় ঃ-  প্রায় ৫ হাজার বৎসর অধিককাল ধরে বাঙালী নামক যে জনগোষ্ঠী মানব সভ্যতাকে আলো দিচ্ছে সেই বাঙালীর সোনার বাঙলা পাঁচটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত  ছিল - ১) রাঢ় ২) সমতট বা বাগড়ী ৩) বরেন্দ্র ৪) বঙ্গ বা ডবাক ৫) শ্রীভূমি ৷ রাঢ়ের দুটি ভাগ -ক) পশ্চিম রাঢ় খ) পূর্ব রাঢ়৷  পশ্চিম রাঢ় বলতে বোঝায়৷ ১) আগেকার সাঁওতাল পরগণা ২) বীরভূমের অধিকাংশ অংশ ৩) বর্ধমানের পশ্চিমাংশ ৪) ইন্দাস থানা বাদে বাঁকুড়া জেলা৷ ৫) পুরুলিয়া ৬) ধানবাদ জেলা৷ ৭) হাজারিবাগ জেলার (বর্তমানে গিরিডি জেলার), কাশমার পেটাইওয়াড়, গোলা, জেড়িডি  ও বানগড়  প্রভৃতি এলাকা ৮) রাচি জেলার সিল্লি,  সোনাহাডু, বুন্দু, ও তোমার থানা ৯) সিংভূম জেলা                         ১০)  ঝাড়গ্রাম জেলা সদর উত্তর ও সদর দক্ষিণ মহকুমা (পশ্চিম মেদিনীপুর)৷ পূর্ব রাঢ় বলতে - ১) পশ্চিম মুর্শিদাবাদ ২) বীরভূম জেলার উত্তরাংশ ৩) পূর্ব বর্ধমান ৪) হুগলী ৫) হাওড়া ৬) পূর্ব মেদিনীপুর ৭) বাঁকুড়া জেলার ইন্দাস থানা৷

২) সমতট বা বাগড়ি ঃ-  বাংলার দাক্ষিণাংশকে সংস্কৃতে বলে সমতট ৷ অঞ্চলটি রয়্যালবেঙ্গল টাইগারের প্রিয় বাসভূমি থাকায় অঞ্চলটি ছিল ব্যাঘ্র প্রকম্পিত৷ তাই সমতটের অন্য নাম ছিল ব্যঘ্রতটী৷ ব্যাঘ্রতটী- বাগ্গডী-বাগড়ী৷ এজন্য বাংলার সমতটকে বাগড়ী বলে৷ সমতট হল বঙ্গ-ডবাকের পশ্চিমে, বরেন্দ্রের দক্ষিণে ও রাঢ়ের পূর্বে অবস্থিত ৷ বাগড়ীর উত্তরে গঙ্গাপদ্মা, পূর্বে মধুমতী নদী, পশ্চিমে ভাগীরথী ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর৷

 বর্তমানে  এর ভিত্তি হল  পূর্বে মুর্শিদাবাদ, ২৪ পরগণা , কলকাতা, অবিভক্ত কুষ্ঠিয়া ,অবিভক্ত খুলনা, অবিভক্ত ফরিদপুরের প্রায় সবটা , অবিভক্ত বাখার গঞ্জ (বড়িশাল)  জেলার প্রায় সবটা-এই সমতটে গাঙ্গেয় সভ্যতার উৎকর্ষ ঘটে৷

৩) রেন্দ্র ঃ- বাংলার উত্তরাংশকে বরেন্দ্র বলে৷ তবে রেন্দ্র কথার অর্থ -ক) প্রথম কথার অর্থ হল  শ্রেষ্ঠর মধ্যে শ্রেষ্ঠ৷ এককালে  এই ভূমি ছিল  প্রাচুর্যের দেশ তাই নাম হয়েছে রেন্দ্র৷

খ) প্রাচীন অনার্য বাঙলায় ‘রিন্দ’ শব্দের অর্থহল কৃষিযোগ্য ভাল জমি৷ এর থেকেও  বরেন্দ্র শব্দের উৎপত্তি হতে পারে৷

রেন্দ্র চতুঃসীমা হল- উত্তরে হিমালয় , দক্ষিণে পদ্মা ও গঙ্গা পূর্বে যমুনা ও নোতুন ব্রহ্মপুত্র আর পশ্চিমে কোশী নদীর পুরানো খাদ৷

বরেন্দ্রভূমি দুটি ভুক্তিতে বিভক্ত ছিল, ক) কামতাপুর ভুক্তি খ) পৌন্ড্র বর্দ্ধন ভুক্তি৷

ক) কামতাপুর ভুক্তি হল  বরেন্দ্রভূমির উত্তরাঞ্চল- এই ভুক্তির  জেলাগুলি হল গোয়ালপাড়া  জেলা, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার অবিভক্ত রংপুর জেলা,অবিভক্ত দিনাজপুর জেলা, দার্জিলিং জেলার সমতল অংশ, কিষাণগঞ্জ জেলা ও ব্রিটিশের নেপালকে দান করা ঝাঁপা জেলা৷

খ) পৌন্ড্র বর্দ্ধন ভুক্তি- এই ভুক্তির জেলা গুলি হল অবিভক্ত বগুড়া , পাবনা , রাজশাহী ও মালদা জেলা৷  এখানে শাসন  করতেন পৌন্ড ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের রাজারা৷

৪) বঙ্গ ঃ- ব্যাপক অর্থে বঙ্গ হল সমগ্র বাংলা৷  কিন্তু বিশেষ অর্থে হচ্ছে ‘ডবাক’৷ ‘ডবাক’ মানে যে ভূমি ডুবে যায়৷ এই অর্থে পুরানো নাম ‘ডবাক’৷ এই বঙ্গের উত্তরে বর্তমানে মেঘালয়৷                      (স্মরণীয় মেঘালয়ের গারো পাহাড় এককালে ময়মনসিংহের সবুজ রাজ্যের অধীনে ছিল) পূর্বে কখনো মেঘনা, কখনো আরাকলি হাওমা পর্বত, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, আর পশ্চিমে মধুমতি যমুনা৷

বিশিষ্টার্থে ‘বঙ্গ’ শুধু যে বাঙলারই  গৌরব নয় মণীষায়, বৈদুষ্যে, ধর্মনির্দেশনায় , ধর্মবাহকতার ও মানব চেতনায়  এককালে শ্রেষ্ঠ জনপদ বলে বিবেচিত হত৷

৫) শ্রীভূমি ঃ- শ্রীভূমিকে পূর্বে উপবঙ্গ বলা হত৷  বর্তমান ত্রিপুরা ,নোয়াখালি, পার্বত্য ত্রিপুরা, কাছাড় , চট্টগ্রাম, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম ও আরাকানের  অংশ বিশেষকে বলা হত ‘শ্রীভূমি’৷

বর্তমান ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে বাঙালীর বাসভূমির অবস্থান বা বাঙালী অধ্যুষিত অঞ্চল ঃ-

সাবেক বৃহত্তর বাঙলা গৌড় বঙ্গ নামেও খ্যাত৷ গৌড়ের পাঁচটি অঞ্চলকে বলা হত পঞ্চগৌড়৷ এককালে প্রাচীন বাঙলা গুড় উৎপাদনে  সারা বিশ্বে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল  বলে একে গৌড়দেশ নাম দেওয়া হয়েছিল৷

বাঙালীর  সেই গৌরব গাঁথার গৌড় ৷ মানব সভ্যতার আদিবিন্দু সেই বাঙলা ও বাঙালীর ঐতিহ্যমন্ডিত বাসভূমি খন্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে কী অবস্থিত আছে?

১) বাঙলাদেশ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র -মোট আয়তন ১,২২,৫৭০ বর্গকিমি৷

২)সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ অঙ্গরাজ্য- মোট আয়তন ৮৭,৬১৫ বর্গকিমি৷

৩)সমগ্র ত্রিপুরা অঙ্গরাজ্য -মোট আয়তন ১০,৬০০ বর্গকিমি৷

৪) ঝাড়খন্ড রাজ্যে সাবেক বাঙলার -(মোট আয়তন ৪১,৩৭০ বর্গকিমি) জায়গা গুলি হল ঃ-

ক) সমগ্র সিংভূম জেলা৷

খ) রাঁচী জেলার সিন্নি, জোনহা, বুন্দু, সোনাহাতু,তামার আরকি ও আঙ্গারা ব্লকের ১৩টি পঞ্চায়েত৷

গ) হাজারিবাগ জেলার  গোলা, পেটারবর, গিরিডি, কালমার ও দামোদরের দক্ষিণাংশ৷

ঘ) সমগ্র ধানবাদ জেলা৷

ঙ) সমগ্র বোকারো৷

চ) সাঁওতাল পরগণা জেলার জামতারা, দুমকা, গোড্ডা, দেওঘর, পাকুড় , রাজমহল, (সাহেবগঞ্জ টাউনবাদে)৷

৫৷ বিহার রাজ্যের- কিষাণগঞ্জ, জেলার অন্তর্গত বারসই , বলরামপুর, আমেদপুর, মুকুরিয়া, কুমেদপুর, বৈসি ব্লক, দুধনিয়া রেলষ্টেশন ও পরানপুর ব্লকের হোনা পঞ্চায়েত, পূর্ণিয়ার পলাশী থানা৷

৬৷ ওড়িষ্যা রাজ্যের -ক) সুন্দরপুর জেলার (পূর্ব সুন্দরগড়) অন্তর্ভুক্ত লোহানীপাড়া, কয়রা, বোনাই মহকুমার অন্তর্গত বিরশা ব্লকের লাঠি ও জলদা পঞ্চায়েত৷

খ) কেওনঝড় জেলার (উত্তর কেওনঝড়) অন্তর্গত চামপুয়া মহকুমার চামপুরী, জোরা ও ঝুমপাড়া ব্লক, বালেশ্বর মহকুমার কাঁকসা, ভোগরাই, চন্দ্রনেশ্বর ও জলেশ্বর ব্লকের অর্ধাংশ৷

গ) ময়ূরভঞ্জ জেলার (উত্তর - পূর্ব ময়ূরভঞ্জ) অন্তর্গত পত্নীপাশি মহকুমার ঠাকুরমুণ্ডা সকরুলি, বরুয়া, কোরজিয়া ও জৌশিপুর ব্লক, বামুনঘাটা মহকুমার রায়রংপুর বাহালদা জামাদা, কুসুমী, বিসই বেতনটি ও সুলিপদা ব্লক৷

৭৷ নেপাল স্বতন্ত্র রাষ্ট্র -এর অন্তর্গত বৃহত্তর ঝাঁপা জেলা৷

৮৷ মায়ানমার স্বতন্ত্র রাষ্ট্র-এর অন্তর্গত আরাকান৷

৯৷ আন্দামান ও নিকোবর দীপপুঞ্জ৷

১০৷ অসম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত----

(ক) গোয়ালপাড়া জেলার সমগ্র৷

(খ) ধূবড়ী জেলার সমগ্র৷

(গ) কোকড়াঝাড় জেলার সমগ্র৷

(ঘ) বরপেটা জেলার সমগ্র (কামরূপ জেলার)৷

(ঙ) কাছাড় জেলার সমগ্র৷

(চ) নওগাঁ জেলার অন্তর্ভুক্ত ভোজাই, লঙ্কা, লামডিং৷

(ছ) মিকির পাহাড়ের সমতল অংশ৷

১১৷ মেঘালয় রাজ্যের গারো, খাসিয়া, জয়ন্তিয়া পাহাড়ের সমতল অংশ৷

আয়তনের বিচারে বাঙলার অবস্থান হ’ল, বাঙলাদেশের থাকল ১,২২,৫৭০ বর্গ কি.মি., ভারত রাষ্ট্রের থাকল ২,৩৭,১৭৪ বর্গ কি.মি.৷

নেপালের থাকল ....... বর্গ কি.মি.৷

মায়ানমারের থাকল ...... বর্গ কি.মি.৷

আলোচিত তথ্য বিন্যাসে অতি সহজেই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল যেখানে একটা জনগোষ্ঠীকে এক ডজন টুকরো করে তার গঙ্গাযাত্রা ঘটানো হয়েছে৷ জাতটাকে খণ্ড খণ্ড করে তার ভাষা-সংস্কৃতিকে অবদমন করা হয়েছে৷ বাঙালীর বুক থেকে তার মুখের ভাষাকে কেড়ে নিয়ে বাঙালীকে বিনাশের পথে ঠেলে দিয়েছে৷

বাঙালী একটি মিশ্র জাতি, কাজেই বাঙালী বিশিষ্টার্থে বাঙলার অধিবাসী ব্যাপক অর্থে যারা বাঙলায় স্থায়ী ভাবে সপরিবারে বসবাস করেন৷ বাঙালীর সামাজিক, অর্থনৈতিক, ভাষা-সংস্কৃতির স্বার্থের সঙ্গে একাত্মবোধ করে উপার্জনের প্রতিটি পাই পয়সা বাঙলাতেই ব্যয় করে, বাঙলাকে ভালবাসেন, ভাষা-সংস্কৃতি গ্রহণ করেছেন তারাই বাঙালী---- সে পৃথিবীর যেখান থেকেই আসুক না কেন৷ দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন---‘‘এই জনগোষ্ঠী সুদূর অতীত থেকে আলোকোজ্জ্বল, ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে, তিন হাজার বা তার বেশী বছর ধরে৷ হঠাৎ জেগে ওঠা নতুন একটা বাউণ্ডারী পাওয়া রাষ্ট্রকেন্দ্রিক এই জনগোষ্ঠী নয়৷ এর রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভাঙ্গাগড়া অনেকবার হয়েছে৷ কিন্তু জনগোষ্ঠীটা অনেক দিনের৷ আর অনেক দিনের পুরোনো বলেই তার ঐতিহাসিক অগ্রগতি হয়েছে ধাপে ধাপে৷ সে অনেক কিছুই অন্যের থেকে নিয়েছে, অন্যকে অনেক কিছু দিয়েছেও৷ সেই জন্যে তার নিজস্ব পোশাক রয়েছে, মেয়েদের শাড়ী পড়বার পদ্ধতি রয়েছে, আর নিজস্ব পঞ্জিকা রয়েছে, ভাষা রয়েছে, লিপি রয়েছে, উচ্চারণ রীতিতে একটা বিশেষ ধরণের সামাজিকতা রয়েছে৷ এই বাঙালী নামধেয় জনগোষ্ঠী অতীতে জীবিত ছিল, আজও জীবিত আছে, ভবিষ্যতেও আরও দুর্দান্তভাবে জীবিত থাকবে৷’’

প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা স্পষ্ট হওয়া দরকার যে স্থানীয় ও বহিরাগত কারা? স্থানীয় মানুষ তারাই---যারা তাদের ব্যষ্টিগত সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বার্থকে যে সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলে তারা রয়েছে সেই অঞ্চলের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন  তাদের জাতি, বর্ণ, ধর্ম, মাতৃভাষা ও জন্মস্থান যাই হোক না কেন, সেটা এখানে বিচার্য নয়৷

বহিরাগত  ঃ যারা একটি বিশেষ সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলে অর্থ রোজগার করে কিন্তু অন্য এক সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলে ব্যয় করে এখানকার ভাষা-সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে, তাদেরই বহিরাগত বা অস্থানীয় মানুষ বলে গণ্য করা হবে (কারণ তাদেরই কাজকর্মে যে সামাজিক-অর্থনৈতিক এলাকায় তারা কর্মরত, তার স্বার্থের অনুকূল হচ্ছে না৷ এতে ওই বিশেষ এলাকার অর্থনৈতিক বিকাশোপযোগী মূলধনের বহিঃস্রোত ঘটেছে ও এর ফলে ওই এলাকার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে)৷