বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে সমস্ত অন্যায়ের  বিরুদ্ধে লড়তে হবে

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

ভারতের স্বাধীনতা  সংগ্রামে  সবচেয়ে  বেশী রক্ত ঢেলেছে বাঙালীরা৷  ক্ষুদিরাম-প্রফুল্লচাকী থেকে  শুরু করে , বাঘা-যতীন-মাষ্টার সূর্যসেন  সহ শত শত বাঙালী বীর ব্রিটিশ  পুলিশের গুলিতে  প্রাণ দিয়েছেন, ফাঁসীকাঠে ঝুলেছেন, চরম আত্মত্যাগ করেছেন৷ অথচ স্বাধীন  ভারতে  সেই বাঙালীরাই  নাকি বিদেশী, তাদের এদেশে স্থান নেই! যারা স্বাধীনতার জন্যে কোনো সংগ্রামই করেনি, তারাই নাকি এদেশের  সাচ্চা বৈধ নাগরিক!

অসমে বর্তমান রাজ্যসরকার  গত ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৭ নাগরিকপঞ্ছীর প্রথম পর্র্যয়ের তালিকা তৈরী করার সময়  অসমে বসবাসরত  ১.৩৯কোটি অসমে বসবাসরত বাঙালীর নাম তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে৷ এটা নোতুন নয়, স্বাধীনতাব পর থেকে  বাঙালীদের  বিরুদ্ধে অসমে চক্রান্তের  শুরু৷

না, শুধু স্বাধীনতালাভের  সময় থেকেই  বলব কেন! স্বাধীনতা লাভের অনেক পূর্ব থেকেই  এই চক্রান্তের  সূত্রপাত ৷ প্রথম চক্রান্ত  শুরু করে ব্রিটিশ  সাম্রাজ্যবাদীরা ৷ তারাই  স্বাধীনতা কামী বুদ্ধিতে শৌর্যে-বীর্যে অগ্রগণ্য এই বাঙালী  জাতির  মেরুদণ্ডকে ভাঙ্গতে  প্রথম ষড়যন্ত্র শুরু করে৷  তাই তারা ১৯০৫ সালেই বাঙলাকে সরাসরি  দ্বিধাবিভক্ত করে  বাঙালী ঐক্যকে ভেঙ্গে বাঙালী জাতিকে  দুর্বল করবার চক্রান্ত করে৷

তখনকার  বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও তরুণযুবারা ব্রিটিশের এই ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে জোরদার বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে  সামিল  হয়েছিল৷  বিপ্লবী অরবিন্দ  থেকে শুরু করে  বারীন ঘোষ, ক্ষুদিরাম , প্রফুল্ল চাকী এমনকি  কবি রবীন্দ্রনাথও তখন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন৷

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান লিখেছিলেন---

বাঙলার মাটি, বাঙলার জল

বাঙলার বায়ূ বাঙলার ফল---

পুণ্য হউক পুণ্য হউক

পুণ্য হউক হে ভগবান৷.......

সারা বাঙ্লা জুড়ে  উত্তাল আন্দোলনের  চাপে ব্রিটিশ  সরকার সেদিন পিছু হটেছিল৷ তারা মাঝামাঝি  বাঙলাকে  দ্বিধাবিভক্ত করার পরিকল্পনা থেকে  সরে এলেন৷  কিন্তু একদিকে  বাঙালার উত্তরাংশের  সিলেট, কাছাড় ও  উত্তর পূর্ব  রংপুরজেলা  তিনটিকে  বাঙলা থেকে  কেটে অসমের সঙ্গে যুক্ত  করে দিলেন, অন্যদিকে  বাঙলার পশ্চিমাংশের খনিজ  সম্পদে  পরিপূর্ণ সিংভূম, ধানবাদ,  গিরিডি, দুমকা প্রভৃতি এলাকাকে বিহারের সঙ্গে যুক্ত করে  বাঙলাকে অর্থনৈতিক সহ বিভিন্ন দিক থেকে  পঙ্গু করার ব্যবস্থা করল৷ ভারত স্বাধীন হওয়ার পরও  স্বাধীন ভারতের  শাসকগোষ্ঠী ও ব্রিটিশের  বাঙালী বিরোধী ষড়যন্ত্রকে ‘উত্তরাধিকারী সূত্রে’ গ্রহণ করল  ও বাঙালী বিরোধিতা চালিয়েই যেতে থাকল৷

হয়তো বাঙালীর বুদ্ধি, তেজ, বীর্যের প্রতি যে ভীতি ব্রিটিশ শোষকদের বুকে দেখা দিয়েছিল, হয়তো  একই ভীতিও  বাদামী শোষকদের মধ্যেও দেখা দিয়ে থাকবে৷

স্বাধীনতার পর বাঙলা ও পঞ্জাব বিভক্ত হল৷ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে পূর্ব-পঞ্জাবের উদ্বাস্তুরা উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ  পেয়ে  ভারতে  পুনর্বাসন পেয়ে গেল কিন্তু পূর্ব বাঙলার উদ্বাস্তুরা  ভারতে এসে  পুনর্বাসনের  কোনো সুযোগ  পেল না৷ সাংসদে তখন  নেহেরু-লিয়কৎ চুক্তি অনুসারে ঘোষণা করা  হ’ল পূর্ব বাংলার বাঙালীদের জন্যে ভারতের দ্বার সব সময়ের জন্যে উন্মুক্ত থাকবে৷ এর কিছুদিন আগেও (৭ই সেপ্ঢেম্বর,২০১৫) বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারও বিজ্ঞপ্তি জারী করে বলল, ৩১ শে ডিসেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত যারা বাঙলাদেশ থেকে  ভারতে আসবে  ভারতে তাদের  স্বাগত জানানো  হবে৷

তাই যদি হয়  তাহলে অসমে আবার ১৯৬৬ কে ভিত্তিবর্ষ ধরে বিদেশী চিহ্ণিত করণের  কথা বলা হচ্ছে কেন? তারও ওপর  বলা হচ্ছে, ১৯৬৬ সালের আগেকার রেশন কার্ড থাকতে হবে, তবে বৈধ নাগরিক বলে স্বীকৃতি দেওয়া হবে৷

স্বাধীনতার পর থেকেই তো দফায় দফায় বাঙালীদের ওপর আক্রমণ , অগ্ণিসংযোগ, লুঠপাট, গণহত্যা--- এসব  হয়েছে৷  এ সবের মাঝে পুরোনো রেকর্ড  গচ্ছিত রাখা সব সময়  সম্ভব কি? পুরাতন রেশনকার্ড সাবমিট করে নোতুন রেশন কার্ড হয়েছে, অন্যান্য রেকর্ড-এর  বেলাতেই  ওই একই কথা৷ তা হলে  এত পুরানো রেকর্ড জমা থাকবে কী করে? আসলে বাঙালী  বিতাড়নের এ  এক অজুহাত মাত্র৷  স্বাধীনতার পর থেকেই  বারে বারে  নানান্ অজুহাতে বাঙালীদের তাড়ানোর  হুজুগ  তোলা হচ্ছে৷ যারা এইভাবে বছরের পর বছর জঙ্গীপনা দেখিয়ে চলেছে, উগ্রপন্থাকে আশ্রয় করে বাঙালী বিতাড়নে মেতেছে , তাদের সঙ্গে  চুক্তি করেই কি রাজীব গান্ধী, কি কেন্দ্রের শাসক গোষ্ঠী বাঙালী বিরোধী চক্রান্তে সামিল হয়েছিল৷

তাই কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতায়  অসম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, সর্বত্রই  বাঙালীরা  বঞ্চনার শিকার৷ বাঙালী জাতির অস্তিত্বই সংকটজনক অবস্থাতে এসে পৌঁছেছে৷ এমনকি  পশ্চিমবঙ্গেও কলকাতা, আসানসোল, দার্জিলিং-এ তো আছেই  সর্বত্রই  বাঙালীরা  স্বভূমিতে পরবাসীর  মত অবস্থা৷ এখন  যদি বাঙালীদের সম্মানজনকভাবে স্বাধিকার নিয়ে  বাঁচতে হয়, তাহলে ঐক্যবদ্ধ ভাবে বাঙালী জাতির বিরুদ্ধে সমস্ত প্রকার অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে৷

চৈতন্যদেব, রাজা রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজীর বাঙলা সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানবতার মুক্তির পথ দেখাবে৷ তার আগে বাঙালী জাতিকে  অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে  আজ ঐক্যবদ্ধ না হলে শোষকশক্তির কাছে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী৷ আর ঐক্যবদ্ধ হলে বাঙালী জাতি নিজেরা কেবল বাঁচবে না, সমগ্র বিশ্বকেও  বাঁচাবে৷