বাঙালীস্তান কেন প্রয়োজন?

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

পূর্বপ্রকাশিতের পর,

বর্তমানে ডি-বোটার, এন.আর.সি ইত্যাদির যে সমস্যাগুলো নিয়ে রাষ্ট্রনৈতিক কিনা সঠিকভাবে না বলতে পারলেও নেহাৎ যে রাজনৈতিক  চক্রান্ত  তা বোধ করি বিচারশীল ও বুদ্ধিমান মানুষমাত্রেই সহমত পোষণে দ্বিধা করবেন না৷  তারপরও বলতে পারি উপযুক্ত  যুক্তি দর্শাতে দক্ষিণ ভারতে  তামিলভাষী, উত্তর ভারতে বহিঃরাষ্ট্রের উর্দু-বেলুচ ইত্যাদি ভাষী আর নেপালের গোর্খা বা অনুরূপ ভাষাভাষী প্রমুখ অ-বাংলাভাষী কোন বহিরাগত বা অনুপ্রবেশকারীরা আদৌ নেই বলে কিন্তু ভারত সরকার অদ্যাবধি কোন ঘোষণা দেননি বা শ্বেতপত্রও প্রকাশ করেননি৷ তাহলে, শুধু বাংলাভাষীদের ওপরেই অনুরূপ অপবাদ কেন চাপানো চলছে? তবে হ্যাঁ, যদি বলতে চান যে,  এজন্যেই তো এন-আর-সি বা সি-এ-এ প্রয়োগের কথা বলা হচ্ছে৷ তর্কের খাতিরে  তা মেনে নিয়েও প্রশ্ণ রাখছিঃ--- তাহলে, অনেক কাল ধরে শুণছি সারাভারতেই এন-আর-সি চালু করা হবে, অথচ এখন পর্যন্ত সেই তীর ফলাটি তাক করা হয়েছে৷--- কেবল অসম, মেঘালয়, মণিপুর, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ জুড়েও যতদূর জানি শুধুমাত্রই বাঙালী-অধ্যুষিত রাজ্য বা এলাকাগুলো নিয়ে৷ এ থেকে কী প্রমাণিত হয়, খুলে বলতে হবে? প্রশ্ণ ---কেন?

আরেকটি বিষয়৷ ব্রিটিশ শাসকরা ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়ে নিজ দেশে ফিরে যাবে৷ ভাল কথ৷ কিন্তু সেই স্বাধীনতা-প্রদানের প্রধান শর্ত হয়েছিল ভারত-বিভাজন৷ আবার ভারত ভাগের চাক্ষুষ ফল দাঁড়াল বাঙলাভাগ আর পঞ্চাব ভাগ৷ ১৯৪৭ সালে সেই ভাগাভাগির পর  ১৯৪৯ সালের মধ্যেই পঞ্জাবের উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে যথার্থ ক্ষতিপূরণসহ পুনর্বাসন মিটিয়ে দেওয়া হলেও বাঙালী-উদ্বাস্তুদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন-দান-ক্রিয়া আজও কেন অসম্পূর্ণ রইল--- এ প্রশ্ণও অবান্তর? প্রসঙ্গক্রমেই বলতে হচ্ছে, হিন্দু আর মুসলিম এই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতেই যদি ভাগাভাগি হয়ে থাকে, সে সময়ে মুসলিমরা তো দক্ষিণ ভারত, পশ্চিমভারত ও উত্তরভারতেরও বিভিন্ন অঞ্চলে ছিলেন৷ তারা কেন সেই র‌্যাডক্লিফ সাহেবের তালিকাভুক্ত হননি৷ সুতরাং ১৯০৫ সালে যে লর্ড কার্জন  প্রথমবার বাঙলাভাগ করেছিলেন  তারই পুনরাবর্তন যে ১৯৪৭ সালে মাউন্টব্যাটেন সহ এদেশীয়  ষড়যন্ত্রকারীরা করেন নি, তাও বুঝব কি করে? অবশ্য সাম্রাজ্যবাদী শোষকগোষ্ঠীর দালাল-মদতদারদের আরও একটা অমানবিক কু-কীর্তির নজিরবিহীন নজির তারা স্থাপন করে গেছেন৷ যে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ববাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যে  একই রাষ্ট্রভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও দূরত্বের ব্যবধান ছিল প্রায় ষোলশ কিমি৷ পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির নেই৷

এবারে আসি বাঙালী জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ও বঙ্গভূমির আদি পরিচয় সম্পর্কীয় কিঞ্চিৎ বর্ণনায়৷ সে আজ থেকে ত্রিশ কোটি বছর পূর্বেকার কথা ৷ সেকালের সেই পৃথিবীতে  আর্যবর্ত  ছিল না,  বাঙলা ও দক্ষিণের সমতলভূমি বা সমতটও ছিল না, রাজস্থান গুজরাটের মরুভূমিও ছিল না৷ সেই মানুষ-না-থাকা পৃথিবীতে সেই নাম-না-জানা গিরিভূমিকেই পরবর্তীকালে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রাঢ়দেশ’ বা ‘রাঢ়া’ বলে, যার বাংলা মানে হয়---রক্তমৃত্তিকার দেশ৷ পরবর্তীকালে আর্যরাও এর নাম দিয়েছিল রাটঠ আব গ্রীকরা বলত গঙ্গা-রিঢ়ি বলে ৷ সেদিনকার সেই মানবহীন পৃথিবীপৃষ্টে রাঢ়ভূমি ছিল অন্যদের চাইতেও বেশী প্রাচীন৷ তারই তুষারাবৃত পর্বতগুলি জন্ম দিয়েছিল বরফগলা নদী সমূহের, যারা বয়ে চলত কখনও পূর্বমুখে, কখনও বা দঃ-পূর্বদিকে সমুদ্রের পানে৷ রাঢ়ভূমি সমেত সেই সুবিস্তীর্ণ স্থলভূমিরই নাম দেওয়া হয়েছিল গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ড৷

কালের গতিতে ধীরে ধীরে পর্বতগুলিও ক্ষয় পেতে থাকে৷ নদীপথে সেই পর্বতক্ষয়িত বালিপলিরাশিতে নোতুন ভুভাগ রচিত হচ্ছিল আর তা থেকেই ক্রমশঃ জন্ম নেয় পশ্চিম রাঢ় থেকে পূর্বরাঢ়৷ রাঢ়ের জন্মের বহুকোটি বছর পরে জন্ম নেয় হিমালয়৷ তারপর হিমালয় থেকে বেরিয়ে এসেছিল গঙ্গানদী ও ব্রহ্মপুত্র নদ৷ আর তাদের  বাহিত পলিবালিতে গড়ে ওঠে  সমতট (বাগড়ী), বরেন্দ্রভূমি (বরীন্দ) আর বঙ্গ বা ডবাক ও শ্রীভূম (ত্রিপুরা)৷ প্রখ্যাত দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর রচিত  ‘‘বাঙলা ও বাঙালী’’ গ্রন্থে  উল্লেখ করেছেন ‘‘রাঢ় ভূমিতে মানুষের উদ্ভব অতি প্রাচীন৷ এর চেয়ে প্রাচীনতর মনুষ্য-নিবাসের কোন সন্ধান  পাওয়া যায় না৷.... রাঢ়ের  ইতিহাস কেবল মাত্র  রাঢ়েরাই নয়, তা বাগড়ী, ডবাক, বরেন্দ্র ও উড়িষ্যারও ইতিহাস৷....এককালে রাঢ়ের মানুষ যেমন পূর্বদিকে সমতট-বরেন্দ্র-বঙ্গভূমিতে বসতি স্থাপন করেছিল ঠিক তেমনি তারা পশ্চিমে মগধ-মিথিলা ইত্যাদি অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল৷

মগধ প্রাগৈতিহাসিক গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের উঃ পূর্ব কোণে অবস্থিত৷ গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ড যেমন বিশ্বের প্রাচীনতম ভূমি তেমনি  মানুষেরও আদিবাস..........মানব সভ্যতারও আদি পীঠস্থান৷ প্রাগৈতিহাসিক যুগে রাঢ়ের মানুষই মগধে এসে বসবাস করেছিল৷ মগধ ও রাঢ়ের মানুষ তাই মূলগতভাবে একই৷ প্রাগার্য মগধের  সূর্য-পূজোই আজ ‘ছটপূজা’ নামে পরিচিত৷ মগধের মানুষরা আর্যদের কোন ব্যবস্থাই মেনে নেয় নি বলে দেশটার নাম হয়েছিল ‘মগধ’, আর ‘মগ’ কথাটার মানেই হচ্ছে---আর্যবিরোধী৷ রাঢ়ের রাজা শশাঙ্ক একবার মগধরাজ রাজ্যবর্ধনের  রাজধানী দখলে নিয়েছিলেন৷

সুপ্রাচীনকাল থেকেই রাঢ়, সমতট, বরেন্দ্র, মিথিলা প্রভৃতি অঞ্চলে উৎকৃষ্ট রকমের গুড় উৎপন্ন হত ও সেই গুড় সমুদ্রপথে  বাইরের বিভিন্ন দেশেও রফতানী করা হত বলেই এই বঙ্গভূমি তথা বাঙালীস্তানের  অপর নাম ছিল গৌড়দেশ৷ গৌড়দেশটার ছিল পাঁচটা প্রধান বিভাগ, যথাঃ- ১) রাঢ়, ২) সমতট, ৩) বরেন্দ্র, ৪) মিথিলা, ৫) বঙ্গ বা ডবাক৷ এজন্যেই গৌড়দেশকে  বলা হত পঞ্চগৌড়৷

বিগত ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন এসে সেই বঙ্গভূমি তথা বাঙালীস্তানকে কেটে দ্বিখণ্ডিত করেছিলেন, যার একভাগের নাম ছিল ‘পূর্ববঙ্গ’ ও অসম-প্রদেশ’ ও এর রাজধানী ছিল ডাকায় (বানানে ঢাকা নয়) আর অপর অংশের নাম ছিল পশ্চিমবঙ্গ, যার রাজধানী রইল কলকাতাতেই৷ পরে ১৯১২ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ রদ করে বাঙলার দুইখণ্ডকে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, তখনও কিন্তু বাঙালীস্তানের কিছু কিছু অংশ কোন অজানা কারণেই বাইরে রাখা হয়েছিল৷ হয়তো ভবিষ্যৎই এর সঠিক  উত্তর খুঁজে পেতে সক্রিয় হবে? অবশ্য এরও পেছনে লর্ড মেকলে সাহেবের সুপরামর্শটাই প্রধান কারণ ছিল বলেই অনেকে অনুমান করতে পারেন৷ (ক্রমশঃ)