বাঙালীস্তান কেন প্রয়োজন?

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

পূর্বপ্রকাশিতের পর,

১৮৩৫ সালেই লণ্ডনের আদেশে লর্ড মেকলে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন নিষ্কণ্টক রাখতে সুপরামর্শের সুপারিশে এক রিপোর্টে জানিয়েছিলেন ঃ ১)ভারতবর্ষে বাঙালী জনগোষ্ঠীটার জাতীয় সংহতি আর ঐক্য-চেতনাকে চূর্ণ করে দিতে হবে৷ ২) বাঙালীদের আধ্যাত্মিক-চর্র্চ ও ধর্মচেতনায় বড় জোর আঘাত হানতে হবে৷ ৩) বাঙালীর শিক্ষা ও  সংস্কৃতিকে সমূলে তছনছ করে দিতেই হবে৷ বস্তুতঃ এখান থেকেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণবাদী শোষকরা মরিয়া হয়ে উঠেছিল মস্তিষ্ক চালনায় অগ্রসর বাঙালী জাতটাকে নস্যাৎ করে  দিতে ও গোটা বাঙলাকেই পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে৷ খুবই সম্ভবতঃ যে সেই কায়দা অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করে চলেছে, ব্রিটিশরা এদেশ ছেড়ে  চলে যাবার পর থেকে দেশীয় বাদামী চর্মের হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী শোষক-গোষ্ঠীর ক্রীড়নক ও দালাল, দেশীয় পুঁজিপতিদের সাকরেদ-বাহিনীর নায়ক-নায়িকারা, যারা সমাজতন্ত্র ধাঁচা গণতন্ত্রের আলখাল্লায় গা-গতর মুড়ে ধনতন্ত্রের তপস্যায় নিমগ্ণ রয়েছেন ও ক্যাপিটালিজমের অপদেবতাদের উদ্দেশ্যেই বাঙালীজাতির বলি চড়াতে খড়গ-হাতে তুলে নিয়েছেন৷

পাঠকবর্গ নিশ্চয়ই উপলদ্ধি করতে পারছেন ঃ ১) ভারতবর্ষে ব্রিটিশ-পূর্ব মোগল শাসক আকবরের আমলে যে সুবে বঙ্গাল ছিল তার উত্তর সীমায় হিমালয়, পূর্বে বার্র্ম (মায়ানমার), দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও পশ্চিমে ছিল সুবেহ হিন্দোস্তান৷ পরবর্তী ব্রিটিশ  আমলেও বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তভুর্ক্ত ছিল--- বাঙলা, বিহারও উড়িষ্যা৷ সেই বাঙলা থেকে ব্রিটিশরাই খনিসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো কেটে নিয়ে বিলিয়ে দিয়েছিল বিহার রাজ্যকে (বর্তমান ঝাড়খণ্ড) ও উড়িষ্যাকে আর কিছু নেপালকে৷ কৃষি সমৃদ্ধ অঞ্চল কেটে নিয়ে বিলালো জঙ্গলাকীর্ণ অসম রাজ্যকে৷ ২) তারপরে বাঙলার শিল্প-কে ব্রিটিশরাই ধবংসস্তূপে পরিণত করেছিল গোটা বাঙলাকে তাদের ঔপনিবেশিক, সাম্রাজ্যবাদী ও রাজনৈতিক ফ্যাসিস্ট শোষণের এক উৎকৃষ্ট কাঁচামাল-সরবরাহকারী পশ্চাদভূমি ও বাজারে পরিণত করতে৷ ভারতবর্ষের মোট কয়লার প্রায় ৬২ শতাংশ যোগান দেয় একা পশ্চিমবঙ্গ৷ ভারতবর্ষ যে কাঁচামাল সংগ্রহ করে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে এর সিংহভাগই যোগান দেয় পশ্চিমবঙ্গ৷ পশ্চিমবঙ্গের পাটকলগুলোর মালিক বহিরাগত পুঁজিপতিরা৷ কেন্দ্রীয় সরকার বিদেশে পাট রফতানী করে বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করে ও পাটজাত দ্রব্যের উপর শুল্ক ও কর বাবদও আয় করে কোটি কোটি টাকা৷ কেন্দ্রের উপার্জিত ২০শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা আসে বাঙলার পাট থেকেই অথচ বাঙলার চাষীকুল তা থেকে বঞ্চিত৷ বর্তমান পশ্চিমবাঙলা আয়তনে সমগ্র বাঙালীস্থানের এক-অষ্টমাংশ প্রায়৷  বাঙলার ৯০ শতাংশ মানুষই দারিদ্রসীমার নীচে৷ বাঙলায় প্রায় কোটিরও বেশী যুবক-যুবতীরা বেকার, অথচ চাকুরী ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ লোক আনা হয় বাইরে থেকে৷ ভারতে এখনও বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর নামে উনিশটি রেজিমেন্ট রয়েছে, কিন্তু ব্রিটিশদের ভেঙে দেওয়া বেঙ্গল-রেজিমেন্ট পুনর্ঘটিত হচ্ছে না৷ বাঙলার শিল্পোদ্যোগ প্রায় নির্মুল--- কৃষিক্ষেত্রের অবস্থাও শোচনীয়৷ পশ্চিমবঙ্গে বাম-শাসনের আমল থেকে ঋণাত্মক বাজেটের পরিমাণ ক্রমশই বেড়ে চলেছে অব্যবস্থার কারণে৷

তারপরেও জঘন্য ষড়যন্ত্র  চলছে পশ্চিমবাঙলাকে ভেঙে গোর্র্খল্যাণ্ড, কামতাপুর, জঙ্গলরাজ্য মাড়োয়ারীল্যাণ্ড বানাবার ত্রিপুরাকে নিয়ে তিপ্রাল্যাণ্ড বানাবার, অসম ভেঙে বেরোল্যাণ্ড বানাবার৷ আর সব কিছুরই মূলে রয়েছে--- নরমেধযজ্ঞে বাঙালীদেরই আহুতি দেবার সুপরিকল্পিত ছলনা৷

কিন্তু প্রায়, ৩০০০ বছর পুরণো বাঙালী জনগোষ্ঠীটারও তো জন্মগত অধিকার রয়েছে মার খেয়েও মারের ওপরে মাথা তুলে দাঁড়াবার৷ তাই না? আর সেই অধিকারই বাঙালীকে কায়েম করতে হবে আপন শক্তিতে ও নিজস্ব শৌর্যগৌরবে৷ আর বাঙালীস্তানকে গড়েও তুলতে হবে প্রাউট নির্দেশনায় আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শোষনমুক্ত ও বিভেদমুক্ত নব্যমানবতাবাদ ভিত্তিক এক আদর্শ মানব সমাজ গড়ে তোলারই লক্ষ্যে৷ সুতরাং, বাঙালীস্তানই হচ্ছে আজকের মানুষের লক্ষ্য পূরণের প্রথম পদক্ষেপমাত্র৷

পুনঃ--- বাঙালীস্তান কেন চাই--- এর সম্পর্কে আরো কতিপয় যুক্তি সন্নিবেশিত করছিঃ-

প্রাচীন জম্বুদ্বীপ ও সুবর্ণদ্বীপ (বর্তমান মায়ানমার) প্রত্যন্ত দেশ ছিল বঙ্গদেশ৷ উক্ত বঙ্গদেশের অন্তর্ভুক্ত ৯ (নয়টি) জনপদ ছিল ঃ- পুণ্ড , গৌড়, সুহ্ম, রাঢ়া, তাম্রালিপ্ত, সমতট, বঙ্গ, বঙ্গাল, হরিকেল৷ বাঙালীর সভ্যতা তথা বঙ্গীয় সভ্যতা সম্পর্কেও প্রখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের সুচিন্তিত অভিমত হচ্ছে---‘‘....দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় ও অষ্ট্রিকদের সমবায়ে খ্রীষ্টজন্মের প্রায় এক হাজার বৎসর আগে বাঙলায় একটি নূতন সভ্যতা গড়ে উঠেছে৷ এ সভ্যতা ভারতের অন্যান্য সভ্যতার সমধর্মী হলেও, সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব রীতি, ভাষা, উচ্চারণ, আচার-ব্যবহার ধর্মানুষ্ঠান, সমাজ ব্যবস্থা দায়াধিকার, বস্ত্র ও ভোজ্যের সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব একটি ধারা নিয়ে চলেছে৷.... বাঙলা আর্যাবর্তের অধীনতা থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যে বারবার বিদ্রোহ করেছে৷

বাঙলা সভ্যতা তিন সভ্যতার ত্রিবেণী সঙ্গম....’’ এই ত্রিবেণী সঙ্গম বলতে তিনি অন্যত্র বলেছেন--- রাঢ়ীয় সভ্যতা  ও সংস্কৃতি গাঙ্গেয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি আর ব্রহ্মপুত্রসভ্যতা ও সংস্কৃতি, যার কোন তুলনা পৃথিবীতে হয় না৷

আবার, বঙ্গদেশ তথা বাঙলা সম্পর্কেও তাঁর অভিমত যুক্তিগ্রাহ্য হবার মত৷ তিনি বলেছেন---‘‘আমাদের এই গৌড়দেশকে সামগ্রিকভাবে গৌড়দেশ বা পঞ্চগৌড় অথবা বাঙলা...যে কোন একটা নাম দেওয়া যেতে পারে৷  বাঙালীস্তানও বলা যেতে পারে কারণ যে অর্থে--- তামিলনাড়ু, রাজস্থান, নাগাল্যাণ্ড, মিজোরাম নামগুলি  চলছে  সেই অর্থেই গৌড়দেশকে ‘‘বাঙালীস্তান বললেও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না৷ ওতে আঁৎকে ওঠার কি আছে৷ বরং ওই নাম এই পরিচিতিই বহন করবে যে, দেশটা বাঙালীদের মাতৃভূমি৷৷’’

উল্লেখ্য আরও যে, অতীতেও বাঙলাভাগের জল্পনা শুরু হলে, নেতাজীর অগ্রজ প্রণম্য শরৎবসু  ও সোহরওয়ার্দি উভয়েই প্রস্তাব রেখেছিলেন যে, ওই ‘‘বাঙালীস্তান’’ নাম দিয়েই বাঙালীদের আবাসভূমির ফয়সালা করা হোক৷ তবে তা’ মানা হয়নি৷