ব্লু হোয়েলের নেশার কবলে

লেখক
আচার্য সত্যশবিানন্দ অবধূত

খবরে প্রকাশ অনলাইনে ‘ব্লু হোয়েল গেম’ খেলে অনেক তরুণ-তরুণী ব্লেড দিয়ে নিজেদের শরীর নিজেরা ক্ষত-বিক্ষত করে কেউ কেউ শেষ পর্যায়ে এসে আত্মহত্যা করেছে৷ উদ্ভট এক গেম! উদ্ভট এই গেমের নেশা৷ ছেলেমেয়েদের মা-বাবারা চিন্তায়  পড়ে গেছেন৷ পুলিশ প্রশাসনও চিন্তায় পড়ে গেছে৷ এ এক মারাত্মক ব্যাধির ভাইরাস, যা ছড়িয়ে পড়ছে ও দেশের তরুণ-তরুণীদের জীবনকে ধবংস করছে৷

এছাড়া ট্রেনে, বাসে, ট্রামে প্রায় দেখা যায় তরুণ-তরুণী সহ বড়রাও সারাক্ষণ মোবাইলের ফেসবুক বা এই ধরণের কিছু নিয়ে মহাব্যস্ত৷ রাস্তায় চলতে চলতে কাণে হেড ফোন গোঁজা৷ এর জন্যে কত দুর্ঘটনাও ঘটছে!

নব নব অত্যাশ্চর্য সব বিজ্ঞানের প্রযুক্তি আজ মানুষের সামনে হাজির৷ তার আকর্ষণ তাই অপ্রতিরোধ্য৷ বিজ্ঞান অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এগিয়ে  চলেছে, মানুষ---মানুষের সভ্যতা তার পেছনে পেছনে ছুটছে৷ বিজ্ঞানকে আজ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে   মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, বিজ্ঞানই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে৷ সেই বিখ্যাত ফ্র্যাঙ্কেষ্টাইনের গল্পের মত৷ ফ্রাঙ্কেষ্টাইন হ’ল মানুষের তৈরী এক উন্নত রোবট৷ সেই ফ্র্যাঙ্কেষ্টাইন তার স্রষ্টা মানুষকে তাড়া করতে করতে মেরেই ফেলল৷

আজকের প্রকৃতপক্ষে সেটাই ঘটছে৷ বিজ্ঞানের এই নব নব আবিষ্কারকে শুভপথে চালাবার জন্যে যে উন্নত মানসিকতার দরকার মানুষের সেই মানসিকতাটারই তো সংকট দেখা দিয়েছে৷ এটা নাহলে তো হিতের পরিবর্তে অহিত হবে৷ আজকের এ্যাটম বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, রাসায়নিক অস্ত্র শুধু নয় পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন শাস্ত্রের নব নব আবিষ্কারকে মানুষ নিজের স্থূল ও সাময়িক স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগাতে গিয়ে সমগ্র সমাজের ক্ষতিসাধন করছে৷ সামূহিক জীবনকে চরমভাবে দূষিত করছে, পরিবেশকেও দূষিত করছে৷

ব্লু-হোয়েলের বিপদের কথা বলতে গিয়ে আমি এত কথা বলছি, কারণ এ সমস্ত এক মূল সূত্রে গাঁথা৷

মূল সমস্যাটা হচ্ছে, মানুষ আজ দিশাহীন৷ এটা কি মানুষ বুঝছে? জীবন আনন্দময় গৌরবময় হয় কীভাবে? মানুষ যখন কোনো একটা মহৎ আদর্শকে সামনে রেখে এগিয়ে চলে তখন সেই অভিষ্টটাই তার ধ্যান-জ্ঞান হয়৷ নানান ছোট-খাটো সমস্যা বা প্রতিমূহূর্ত্তে নানান ঘাত-প্রতিঘাত---দুঃখ-কষ্ট যা প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনে আসে সে সব সমস্যা তখন তাকে মোটেই বিচলিত করে না৷ কারণ, তার মন তখন আদর্শেই নিবদ্ধ৷ কষ্টকেও তখন সে আনন্দের সঙ্গে গৌরবের সঙ্গে বরণ করে নেয়৷

কিন্তু বর্তমানে মানুষ তার জীবনের আদর্শ কী হবে--- এটুকু চিন্তা-ভাবনা করার সময় বা অবকাশই পাচ্ছে না বা সেইটুকু সময়ও আজ তার কাছে নেই৷ শুধু নেশার ঘোরে ছুটে যাওয়া৷ কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, এর দূরবর্তী পরিণাম কী সেটুকু ভাবার মত ধৈর্য নেই৷

শ্রেয় ও প্রেয়--- এই দুটো জিনিসই মানুষকে  আকর্ষণ করে৷ মানুষ সাধারণত: যা আপাতমধুর, ‘বিষকুম্ভম্ পয়োমুখম’---অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে খুব আর্কষণীয় বা সুখকর মনে হলেও পরিণামে যা দুঃখকর---সর্বনাশের অগ্রদূত--- তারই দিকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছুটে চলে৷

মানুষের মনে হীনপ্রবৃত্তিও যেমন আছে উচ্চ-মূল্যবোধ ভিত্তি সদ্বৃত্তিও  রয়েছে৷ দুর্র্বর অনিয়ন্ত্রিত কাম, ক্রোধ, লোভ,মোহ, মদের হাতছানিও যেমন রয়েছে, আবার সাধুতা, প্রেম, দয়া, সৌজন্য, পরোপকারের বাসনা এসবও মনের মধ্যে রয়েছে৷

বিবর্তনের ধারায় মানুষ যেহেতু পশুজগৎ থেকে এসেছে, তাই এই পেছনের জগতের হীনবৃত্তিগুলোর জন্যে কোনো বিশেষ শিক্ষার বা অনুশীলনের প্রয়োজন হয় না, কিন্তু সদ্বৃত্তিগুলির বিকাশের জন্যে নৈতিক শিক্ষা ও তার অনুশীলনের প্রয়োজন আছে৷ এটাই মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক৷ আজকে মানুষ তার এই নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিকটিকে  উপেক্ষা করে কেবল জড়ের হাতছানিতে ছুটে চলেছে৷ এটাই আজকের সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা৷

এই গড্ডলিকা প্রবাহে  কেবল যে দেশের অধিকাংশ তরুণ-তরুণীও ভেসে চলছে তা নয়, দেশের অধিকাংশ নেতা-নেত্রী, বুদ্ধিজীবী, তথাকথিত সাংসৃকতিক জগতের  উল্কা বা তারকারাও এই নেশাতেই মসগুল হয়ে রয়েছে৷

মুখে---ভাষণে, বিতর্ক-সভায় কিন্তু চিৎকার করে বলে বেড়াচ্ছেন---সব গেল, সব গেল, দেশে নৈতিকতা নেই সর্বত্র দুর্নীতি, ব্যাভিচার! এই অশনি সংকেতের কথা সবাই বলছেন, কিন্তু এই মহাসংকট থেকে বেরুনোর জন্যে কার্যকরী কোন দাওয়াই বলতে পারছেন না বা এই মহাসংকট থেকে বেরুনোর আন্তরিক চেষ্টাও করছেন না৷ কেবল মহাসংকটের গভীরতা ব্যাখ্যা করে নিজেদের পান্ডিত্য ও বাক্পটুতা জাহির করছেন৷

সর্বশেষে বলি, আমরা সবাই কিন্তু এক এক ধরণের ব্লু-হোয়েল গেমের নেশাতেই মজে গিয়েছি৷ এই নেশার অন্ধকূপ থেকে বেরুতে হবে৷ আর বেরুতে হবে দেশের মহামনীষীদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার রশি ধরে৷ এছাড়া আর কোনো পথ নেই৷