ভারতে কর্ষক  আন্দোলন  ও সমাজ-চেতনা

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

দিল্লী শহরটি ভারতের রাজধানী শহর৷ দিল্লীতেই অবস্থিত ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সাংসদ ভবন--- রাজ্যসভা ও লোকসভা৷ সেখানেই অবস্থিত কেন্দ্রীয় কেবিনেট--- মন্ত্রীসভা ও রাষ্ট্রপতি ভবন৷ অর্থাৎ সমগ্র ভারতকে পরিচালনার জন্যে যে মস্তিষ্ক শক্তির সেটি দিল্লীতে রয়েছে৷  দিল্লীতেই ভারতের শীর্ষ আদালত আর বিচারালয় তাই, দিল্লীতে অবস্থিত শীর্ষ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টকে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশ্রেষ্ট চিকিৎসালয়ও বলা যেতে পারে, কেননা রাষ্ট্রদেহে যদি কোথাও রোগ-ব্যাধি দেখা দেয়, অসুস্থতা কিংবা অচলাবস্থা যেকোনো কারণেই উপস্থিত হোক না কেন, শেষ কথাটি শোণার জন্যে সকলেই শীর্ষ আদালতের রায়ের প্রতীক্ষায় অনড় থাকবেন৷ এমনকি ভারত রাষ্ট্রদেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গে অর্থাৎ  কোন না কোন রাজ্যে বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে সেই রাজ্যিক পরিচালনা ক্ষেত্রে গোলযোগ হতে দেখা যায় আর সেই গোলযোগের আশানুরূপ মীমাংসা যদি সংশ্লিষ্ট রাজ্যে বা প্রান্তিক অঞ্চলে হওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে,সেক্ষেত্রেও চরম মীমাংসার কথা শোণাবেন শীর্ষ আদালতই৷ এমনিভাবে, দেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়াদি ছাড়াও বহিঃরাষ্ট্র কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্কীয় নানা বিষয় আশয় নিয়েও সর্বশেষ কথা বলারও  অধিকার কেবল দিল্লীরই রয়েছে৷ সুতরাং দিল্লীর ভূমিকা ভারত ডোমিনিয়নে সর্র্বেচ্চ, একথা বলারও অপেক্ষা রাখে না৷

তবে,আমরা কিছুদিন ধরে কী দেখছি পঞ্জাব, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যগুলো থেকে হাজার হাজার কর্ষক ভাই-বোনেরা, যুবা থেকে বৃদ্ধ সকল বয়সের কৃষিজীবিরা  শীতের মরশুমে, দিল্লী অঞ্চলের  হাড়-হিম করা প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় দিনরাত খোলা আকাশের নীচে অবস্থান নিয়ে ধর্ণারত রয়েছেন৷ কিছুদিন আগে, গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতন বা মড়ার উপর খাড়ার ঘায়ের মতন প্রচণ্ড ঠাণ্ডার উপর নেমে এল আকাশ ভাঙা বর্ষনধারা৷ তাতেও কিন্তু দমেননি আন্দোলন গুটিয়ে চলে যান নি কর্ষক ভাই-বোনেরা৷ অসহনীয় কষ্ট ও দুর্র্ভেগ স্বীকার করেও তাঁরা তাঁদের জিহাদ বজায় রেখেই চলেছেন৷ আন্দোলন চলাকালীন অর্ধ-শতাধিক বীর-পুরুষদের মৃত্যু ও ঘটেছে৷ তাতেও কারোর ভ্রূক্ষেপ নেই৷ কারণ তাঁরা বীরযোদ্ধা বা যুদ্ধক্ষেত্রে রয়েছেন শত্রুপক্ষের মোকাবেলা করতেই নেমেছেন৷ কর্ষকদের প্রতি, কৃষিব্যবস্থার  প্রতি--- সমাজের অন্নদাতা ও রসদের যোগানদাতাদের প্রতি ভারত-সরকার যে জুলুমবাজির ও জল্লাদীপনার পরোয়ানা জারি করেছেন তিনটি ‘‘নয়া কৃষি-আইনের’ নামে এরই প্রতিবাদে দেশের  বিভিন্ন কর্ষক সংঘটনগুলোর পক্ষ থেকে চলছে গণতান্ত্রিক এই সত্যাগ্রহ---কর্ষকদের মরনপণ লড়াই৷ তাই, আন্দোলকারীদের প্রতি রইল আমারও কুর্ণিশ৷ জানাই তাঁদের বীরত্বব্যঞ্জক ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামী মানসিকতার জন্যে হাজার সালাম আর সংগ্রামী অভিনন্দন৷

কর্ষকদের এই আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ছল-চাতুরীর খেলায় নেমেছেন আমাদের আপামর ভারতবাসীর বোটে নির্বাচিত জন প্রতিনিধি যাঁরা কেন্দ্রে সরকার ঘটন করে দেশবাসীকে প্রতিপালন করবেন ও তাঁদের সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে  চলবেন বলে ঈশ্বরের নামে গণতন্ত্রের তিলক কপালে এঁটে  মন্ত্রীত্বের আসনে উপবিষ্ট রয়েছেন৷ সেইসব রাজনীতিজ্ঞ,তথা ---আইন-প্রণেতাগণই তিনটে কৃষি---আইন রচনা করেছেন যেগুলোর কোনটাই দেশের কৃষির স্বার্থে, কর্ষক-সমাজের স্বার্থে,কৃষি ব্যবস্থাপনারও স্বার্থে প্রযোজ্য কিংবা গ্রহণযোগ্য হবার যোগ্য আদৌ নয়৷ তাই, সরকারপক্ষ চাইছেন জোর জুলুম  চাপা রেখে চালাকির  দ্বারা কর্ষকদের বশমানাতে৷ তাই তো ছলা-কলার কোন অভাব থাকছে না৷  কিন্তু, ভেতরে ভেতরে ভাবখানা এমনই যে, সরকার পক্ষের প্রতিনিধিদের মনের সুপ্ত  কথাগুলো হয়তো---‘‘গাধারা জল খায় তবে  ঘোলা করেই...’’৷

সুবিধাবাদী ও দুরভিসন্ধি পরায়ণ রাজনীতিকদের একটা নীতি কৌশল রয়েছে ‘‘ধীরে চলো নীতি’’ নামে যার জনপ্রিয়তাও রয়েছে৷ এর গূঢ়ার্থ হচ্ছে---উত্তাল তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ সমুদ্রে তেল ঢেলে দিয়ে অপেক্ষা করলে ধীরে ধীরে  উত্তাল সমুদ্রও কাচ-শীটের মত অচঞ্চল ও শান্ত হয়ে যায়৷ আবার, কূট রাজনীতিকদের আরেকটি গুপ্ত-কৌশলও রয়েছে যার নাম ‘ডিবাইড্‌ অ্যাণ্ড রুল-পলিসি’৷ ভারতবর্ষে সেয়ানা ব্রিটিশ শাসকরা এই নীতির সুচারুরূপে উপযোগের  ফায়দা লুটে নিয়েছেন৷ আবার তাদের যোগ্য উত্তরসূরী বর্তমান ভারতের শাসকগোষ্ঠীদের মদতদাতা ও পৃষ্ঠপোষক হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীরাও  রয়েছেন৷ তাই,  দেখা যাচ্ছে একের পর এক কেন্দ্রীয় সরকার ও কর্ষক-প্রতিনিধিদের বৈঠক আলোচনা সবই ভেস্তে গেল,একাদশতম বৈঠক পর্যন্ত---ফয়সালা দূরস্ত৷ কেননা, পুঁজিপতি, ব্যবসায়ীগোষ্ঠী, ভূ-স্বামী ও অভিনেত্রী  পুঁজিপতিদেরই স্বার্থরক্ষায় যে কর্ষক-নীতি রচনা করেছেন   উক্তগোষ্ঠী বা শ্রেণীস্বার্থে, তা থেকে কেন্দ্রীয় সরকার কিছুতেই সরতে চাইছেন না, তাইতো তাদের ছলা-কলা ও ধানাই-পানাইয়ের  অন্ত হবার নয়৷ অপরদিকে কর্ষকরাও তাঁদের বাঁচার স্বার্থেই তাঁদের প্রতিবাদ স্বরূপ দাবী যে, কর্ষক-বিরোধী ও কৃষি-বিরোধী বরং বলা উচিত মানবতাবিরোধী তিনটি কৃষিআইন (নয়া) বাতিল করতে হবে নয়তো তা থেকে তাঁরাও পেছোবেন না বলে অনড় রয়েছেন৷

অবশেষে দেখা গেল,২৬শে জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন, উপলক্ষ্যে কর্ষক আন্দোলনের পক্ষ থেকে রাজধানী শহরে ট্রাক্টর-র‌্যালী’’ করা হবে বলে দাবী করা হল৷ প্রথমদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের অমত প্রকাশ  করা হলেও শেষ পর্যন্ত অবশ্য দিল্লী পুলিশের পক্ষ থেকে  সেই ট্রাক্টর র‌্যালীর অনুমতি মঞ্জুর করা হল৷ কিন্তু, কার্যক্ষেত্রে ভারতবাসীমাত্রেই এমনকি বিশ্ববাসীও প্রত্যক্ষ করতে পারলেন শাসক গোষ্ঠীর বেড়াল তপস্বীপনার আসল রূপ৷ অতি সূক্ষ্ম পরিকল্পনার মাধ্যমেই কর্ষকদের নাজেহাল করার সুন্দর ব্লু-প্রিন্ট সর্ব-সমক্ষেই নজরে  এসে গেল--- দু’টো কর্ষক-সংঘটন ইতোমধ্যেই সেই আন্দোলনের জোট  ভাঙতে মনস্থির করে নিলেন৷ অবশ্য দূর থেকে আমরা যারা দেখছি বা ভাবছি, আমাদের  পক্ষে দেখার মতো সেই দূরবীক্ষণ বা অনুবীক্ষণ তথা মনোবীক্ষণ জাতীয় কোন যন্ত্রাদিও নেই---আমাদের সেই অন্তর্যামিত্বও নেই৷ তবে, অবস্থা নিরিখে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না যে--- ‘ডাল মে কুছ তো কালা হ্যায়-ই ’--- নতুবা এমনতর ভাঙন ধরবে কেন? দ্বিতীয়তঃ, সরকার পক্ষের স্বৈরচারিতার নগ্ণরূপের প্রারম্ভিক বহিঃপ্রকাশ কিন্তু কিঞ্চিৎমাত্র হলেও প্রকাশ পেয়ে গেছে বললে বোধ হয় ভুল হবার নয়৷

আসলে, গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোকে প্লে-গ্রাউন্ড বানিয়ে ডেমোন্‌ক্র্যাসীর শোষকগোষ্ঠীর মহানায়করা তাদের  হাতের পুতুল-সদৃশ ও শিখণ্ডী-স্বরূপ সংসদীয় কেবিনেট তন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে মতলব হাসিল করে নেবার  কায়দা কানুন সবই তো পুরানো ষ্ট্র্যাটেজী বিশেষ৷ যুগে যুগে শুধু এর কালোপযোগী করে তোলার  স্বার্থে বাইরের দিকে মাজা ঘষা করে বা হর্তা-কর্র্ত্তদের কথার বার্ণিশিং ক্রীম লাগিয়ে একটু মোলায়েম করে তোলাটাই তাদের আসল কাজ৷ তা নাহলে আদর্শ বর্জিত ও নীতিহীন আর হিপোক্র্যাটিক দুর্নীতিভিত্তিক মাফিয়াতন্ত্র  বুভুক্ষু-অসহায় নিরীহ ভারতীয় জনতার ওপর রামভক্তরা চাপিয়ে রাখবেন কীভাবে!

তাই,পরিশেষে বলতে হচ্ছে যে, দেশে কর্ষকদের আন্দোলনকে শুধু কৃষিজীবীদের আন্দোলন না ভেবে ভাবতে হবে৷ সমগ্র দেশবাসীর আন্দোলন৷ কারণ, কর্ষকরা হচ্ছেন গোটা মানব সমাজটার অন্নদাতা---খাদ্যের যোগানদার--- সমাজের পালনকর্র্ত একথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না৷ শাসকদের শাসন করা, ব্যবসায়ীদের ব্যবসার নামে লোক ঠকানো মুনাফাদাবী, পুঁজিপতিদের পুঁজির পাহাড়-নির্মাণ, রক্ত-শোষকদের জলৌকাবৃত্তি, বিজ্ঞানীর বিজ্ঞান-সাধনা, দার্শনিকের দর্শন-চিন্তা, প্রযুক্তিবিদদের প্রযুক্তি নিয়ে নিত্যনোতুন গবেষণা, কবি-সাহিত্যিকদের কাব্য সাহিত্য-রচনা, শিল্প-মালিকদের শৈল্পিক প্রসার বৃদ্ধির কাজ,  নন্দন-শিল্পী, চারুশিল্পী, চলচিত্র-শিল্পীদেরও সংস্কৃতির উন্নয়নের সাধনা ইত্যাদি সহ শিক্ষা-দীক্ষা-অধ্যয়ন-অধ্যাপনা, এমনকি ধর্মানুশীলন রাজনীতিকদের রাজনৈতিক মহত্ত্ব কিংবা পলিটিক্যাল মামদোবাজি আর দস্যু-তস্কর,গুণ্ডা-বদমায়েসদেরও ‘দেখেঙ্গে’ মনোভাবের অতলযাত্রা হয়ে যাবে, যদি কর্ষকরা খাদ্যের যোগান না দেন৷ এক কথায়, কর্ষকরাই হচ্ছেন মানুষের অস্তিত্বরক্ষার জন্যে প্রাথমিক চাহিদা অন্নের যোগানদাতা--- এটাই মূলসত্য৷ অথচ সেই কর্ষকরাই মানুষের শিক্ষিত--- অশিক্ষিত সমাজে অবহেলিত লাঞ্ছিত৷

স্মরণীয়ঃ---বিগত ১৯৩৭ সালের ২৮শে অক্টোবর কিষাণ-সভায়   ভাষণ প্রসঙ্গে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেনঃ---

‘‘কৃষকরা সংঘবদ্ধ হউন, তাহা না হইলে আপনাদের অধিকার দাবী স্বীকৃতি পাইবে না৷ ইহা ভাগ্যের পরিহাস যে, যাঁহারা আমাদের খাদ্য উৎপাদন করেন, তাঁহাদিগকে খাদ্যের  অভাবে মৃত্যুর শিকার হইতে হয়৷ এই অবস্থার প্রতিকারের জন্য কৃষকদের উচিত নিজেদের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট গড়িয়া তোলা৷’’