ভারতের অর্থনীতির দুর্দশা, সীমাহীন বেকারত্ব ও সমাধানের পথ

লেখক
সৌমিত্র পাল

চরম খাদে ভারতের অর্থনীতি৷ সমগ্র দেশ জুড়েই  চলছে  চরম আর্থিক মন্দা৷ উৎপাদন হ্রাস,বিক্রিবাজারে ধস, নিত্যপণ্যে লাগামছাড়া  মূল্যবৃদ্ধি, জনসাধারণের ক্রয়সাধারণের  ক্রয়ক্ষমতা’র অধোগামীতা প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে দেশের অর্থব্যবস্থা (ইকোনমিক সিস্টেম) ক্রমশঃ দুর্বল হচ্ছে৷ বিভিন্ন সেক্টরে চলছে ব্যাপকভাবে কর্মীছাটাই তৈরী হচ্ছে না যথোপযুক্তভাবে কর্মসংস্থানের  পরিধি৷ ফলে দিন দিন  বাড়ছে কর্মহীন বেকার যুবক যুবতীদের সংখ্যা৷ অভাব অনটনে  নিত্য জর্জরিত  হচ্ছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ৷ আর্থিক চাপে ক্রমশঃ অধোগামী হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার  মান৷ পথভ্রষ্ট হয়ে বাঁচার  তাগিদে অনেকেই  নোংরা দলীয়  রাজনীতির  শিকার হচ্ছে কেউবা হারিয়ে যাচ্ছে দুর্নীতির চোরাবালিতে৷ অসহায় মানবতা অর্থনৈতিক  স্বাধীনতা  (ইকোনমিক লিভারেশন) তথা অর্থনৈতিক  গণতন্ত্রের  আশায় অন্ধকারে মাথা কুটে মরছে৷

দেশজুড়ে কর্মপরিধির ক্রমোসংকোচন, ভয়াবহ বেকার সমস্যা খাদ্য ঘাটতি দারিদ্র প্রভৃতি’র জন্য জনবিস্ফোরন বিশ্বমন্দার ছাপ প্রভৃতিকে দায়ী করা হলেও, প্রধানতঃ যে কয়েকটি কারণে ভারতের  অর্থব্যবস্থা ক্রমশঃ ভেঙে পড়ছে তা নিম্নে আলোচনা করা হলঃ

প্রথমত ঃ চূড়ান্ত পুঁজিবাদী শোষন ৷ ভারতের  অর্থ পরিকল্পনা হল কেন্দ্রিত  অর্থপরিকল্পনা যা পুঁজিবাদী শোষণের  প্রধান  হাতিয়ার৷ কেন্দ্রীত অর্থব্যবস্থায় একদিকে কতিপয়  পুঁজি পতির হাতে পুঁজি (সম্পদ) কেন্দ্রীভূত হতে থাকে ও  অন্যদিকে পুঁজির স্বল্পতা বা  শূন্যতা তৈরী হয়৷ পরিসংখ্যান  অনুযায়ী বলা যায় যে, দেশের  অর্থনীতির  যাবতীয় সিদ্ধান্ত , তথা কর্মপদ্ধতি, নিজেদের  আনুকূল্যে প্রয়োগ করার মাধ্যমে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি দেশের প্রায় ৮০-৮৫শতাংশ  পুঁজি নিজেদের হাতে কেন্দ্রিভূত  করে রেখেছে আর অবশিষ্ট ১৫-২০ শতাংশ পুঁজি’র উপর নির্ভর করে  বেঁচে থাকতে হচ্ছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ  কে৷  প্রসঙ্গতঃ পুঁজিপতিদের  অঙ্গুলীহেলনেই দেশের সরকার তথা প্রশাসন পরিচালিত হয় ফলে এই কেন্দ্রিত অর্থব্যবস্থায়  তৈরী হয়েছে ধনী ও দরিদ্রের  মধ্যে চূড়ান্ত অর্থবৈষম্য এখানেই শেষ নয়৷ পুঁজিপতিদের আগ্রাসী লোভ অমানবিকভাবে ক্রমশঃ গরীবের সীমিত পুঁজিতে ও থাবা বসাচ্ছে সুকৌশলে৷ পুঁজি (সম্পদ) এর বন্টনজনিত এটিই জনসাধারণের দুর্দশার জন্য  প্রধানতঃ দায়ী৷

দ্বিতীয়ত ঃ সরকারী সম্পত্তির বেলাগাম বেসরকারীকরণ৷ বর্তমান সরকার নানান অজুহাতে  রাষ্ট্রীয়  সম্পত্তিগুলিকে ক্রমে ক্রমে বেসরকারীকরণ করে চলেছে৷  ফলে ঐ সমস্ত সম্পত্তি বেসরকারী গোষ্ঠী তথা পুঁজিপতিদের হস্তগত হতে থাকায় জনগণের উপর  ক্রমশঃ বাড়ছে আর্থিক চাপ৷

ঐ সমস্ত পুঁজিপতিরা বিভিন্ন সেক্টরে  তাদের ইচ্ছামতো কাজের মেয়াদ  নির্ধারণ থেকে  শুরু করে কর্মী নিয়োগ ছাঁটাই প্রভৃতি কাজ করে চলেছে৷ অনিশ্চিত হচ্ছে একদিকে  কর্মীদের ভবিষ্যৎ অন্যদিকে, পুঁজিপতিদের হস্তগত সেক্টরগুলিতে  উৎপাদিত দ্রব্যাদি৷ মূল্য নির্ধারণ থেকে বৃদ্ধি সবই ক্রমাগতভাবে  জনসাধারণের উপর চাপ বাড়িয়েই চলেছে ৷ কয়লা , তেল থেকে শুরু করে রেল, বিমান প্রভৃতি পরিষেবা আজ বেসরকারী সংস্থার  হাতে ৷  প্রফিট  ছাড়া জনস্বার্থ কখনোই  বোঝে না (অমানবিক)  এইসব  সংস্থার  মালিকানা তথা পুঁজিগোষ্ঠী৷ এদের সংখ্যা খুবই  মুষ্টিমেয়৷ অথচ এদের হাতেই কুক্ষিগত  অধিক সম্পত্তি আর  তাদেরকে  টিকিয়ে  রাখতেই  বেশী সংখ্যক  মানুষের  রক্ত চুষে সঞ্চিত অর্থ বলে  সমাজের  সব অংশের  মানুষের  বুদ্ধি জ্ঞান-ক্ষমতা সবকিছু কিনে নিচ্ছে তারা আর এভাবেই  সবাইকে গোলামে পরিণত করে চলেছে৷  মূল সূত্রটা হল পুঁজিবাদ আগে  অর্থ ছিটিয়ে  সার্বিক সমস্যা তৈরী করে আর বেশী হলে সমাধানের নামে এক একটা  নমুনা তৈরী  করে উদাহরণ  স্বরূপ  বলতে পারি যে, ভারতের অন্যতম প্রধান পুঁজিপতি  মুকেশ আম্বানী শুধুমাত্র  জিও  ব্যবসার দ্বারা ৪১০ কোটি এ পর্যন্ত সঞ্চয় করেছেন৷ প্রথমে মার্কেটে  এসে কয়েকটা মাস মানুষকে  প্রলুদ্ধ করে নেশাগ্রস্ত করে দেয় তারপরে ধাপে ধাপে  ‘জিও’ কে পুঁজি টানার হাতিয়ার করে , জনসাধারণের  পুঁজিকে  শোষণ করতে  থাকছে৷ একই পদ্ধতিতে গোটা দেশ জুড়ে  চলছে পুঁজিপতিদের নানান বুদ্ধিদীপ্ত শোষণ  পর্দার আড়ালে থেকে এই পুঁজিপতিরাই সরকারের আসল চালিকাশক্তিরূপে কাজ করে আর  ধুরন্ধর  দলীয় রাজনীতির সরকার তথা প্রশাসকগণ এদের  স্বার্থ রক্ষার্থে জনসাধারণকে নিত্যআর্থিক শোষণ করে চলেছে৷ আবার শোষিত জনসাধারণের  সম্মিলিত  ক্ষোভ যেন সরকার তথা পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে ‘বিপ্লব’ এর রূপ না নেয়, তার জন্য  ভিক্ষারতি স্বরূপ কিছু নমুনা  বা প্রকল্প  চালু রেখে  জনরোষ নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র৷ জনগণের সার্বিক সুরক্ষা  তথা  মৌলিক অধিকার রক্ষার  দায়িত্ব থাকে যে সরকারের উপর সেই সরকারই পুঁজিপতিদের তোষণ  করতে গিয়ে জনগণকে  চরমভাবে শোষণ করে চলেছে৷  রাজনৈতিক  গণতন্ত্রের এটাই  প্রহসন! এখানে ক্ষমতার  মুখোশ হল গণভোট নির্বাচিত সরকার তথা প্রশাসক আর  ক্ষমতার  প্রকৃত মুখটা হল শোষক  পুঁজিবাদ৷

লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে পুঁজিপতিরাই জনসংযোগকারী প্রচারযন্ত্র (মিডিয়া চ্যানেলগুলি)- কে কিনে নিয়ে নিজেদের  আণুকূল্যে পুরোমাত্রায়  কাজে লাগিয়ে  তাদের  পোষ্য ব্যষ্টিদের  ক্ষমতার অলিন্দে  বসায় ৷ এরপরে ক্ষমতায় এসে পুঁজিপতিদের  নিঃশর্ত অঙ্গুলিহেলনে  ঐসব ব্যষ্টিরা (মন্ত্রী সাংসদ,বিধায়ক, আমলা প্রমুখরা) ধৃতরাষ্ট্রের  মতো  তাদেরকে  দেশজুড়ে  পুঁজিটানার  জাল বিস্তারে  অনুমোদন দেয়৷ জনসাধারণকে নিত্য ধোঁকা  দিয়ে এভাবেই  তাদের কাজ চলতে থাকে৷ পুঁজিগোষ্ঠী ও সরকার  যৌথ শোষণ, অবাধ ব্যষ্টি স্বাধীনতার জেরে তারা  জনসাধারণকে  মানসিক ও বৌদ্ধিক দিক  থেকে শোষণ করতে থাকে৷  দেশজুড়ে  মদের দোকানের ঢালাও লাইসেন্স প্রদান, নানান মাদক বাজারে ছাড়ার অনুমোদন, অশ্লীল সিনেমা ও দৃশ্যের  প্রচার  প্রকৃতির  মাধ্যমে নিত্য নৈমিত্তিক যুব সমাজকে  আসক্ত  করে,  তাদেরকে  বিপথগামী করে তুলছে৷ ফলে যুবসমাজ  এর একটা বড়ো অংশ (পুঁজিবাদের তোষক)  সরকারের কর্মসংস্থান তৈরীর ব্যর্থতা কিংবা আর্থিক দেউলিয়াপণার  বিরুদ্ধে  গর্জে ওঠতে ভুলে যাচ্ছে৷ জনগণের অধিকার রক্ষার লড়াই থেকে তাদের মনকে অনত্র্য ঘুরিয়ে দেওয়ার ঘৃন্য ষড়যন্ত্র জনগণের  উপর মানসিক  ও  বৌদ্ধিক  শোষণের একটা রূপ মাত্র৷

তৃতীয়ত ঃ  ভারতীয় অর্থনীতির  দেউলিয়াপনার  অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলF D I বা ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেসমেন্ট অর্থাৎ  বিশ্বায়নের  নামে  বিদেশী পুঁজি প্রত্যক্ষভাবে  দেশীয়  বাজারে বিনিয়োগ হচ্ছে ৷ এতে করে উৎপাদিত দেশীয় সম্পদের  লভ্যাংশের একটা  বড়ো অংশ  চলে যাচ্ছে  বিদেশী  পুঁজিগোষ্ঠীর হাতে৷ সরকারী মদতে এইভাবে দেশীয়  সম্পদের ক্রমশঃ চোরাস্রোত ঘটায় দেশীয়  অর্থবাজারে ক্রমশ খালি  (শূন্য) হচ্ছে৷ দুর্বল হয়ে পড়ছে ক্রমশঃ মাঝারি  ও খুচরো ব্যবসায়ীরা  কাজ হারাচ্ছে অসংখ্য বেকার যুবক-যুবতী৷

পুঁজিপতিদের  নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায়  দেশে কর্মসংস্থান তৈরী  তো হচ্ছেই না বরং  নিত্য কাজ হারাচ্ছে অসংখ্য কর্মী৷ বছর বছর বহু শিল্প কারখানা  বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ বিকল্প  কর্মসংস্থান  তৈরীতে সরকার মনোযোগী না হয়ে কর্মচারী  ছাঁটাই  করে চলেছে  অমানবিক সাম্প্রদায়িকতার ফলে ভারতের আর্থিক অবস্থা  খুবই শোচনীয়  হয়ে পড়েছে৷ ক্রমশঃ তা তলানির দিকে যাচ্ছে৷ এক ঝলকে  তার কয়েকটি  নমুনা তুলে ধরছি সংক্ষেপেঃ

 ১. মারুতি সুজুকি  কোম্পানী ইতিমধ্যে ৩০০০ কর্মী ছাঁটাই  করল৷

২. দেশের বৃহত্তম  ‘পারলে’ বিসুকট কোম্পানী  ১০,০০০ কর্মী ছাঁটাই  করতে চলেছে৷

৩.GST-এর পরিমাণ  বাড়িয়ে গাড়ি কোম্পানীগুলিকে ক্ষতির মুখে বসিয়ে হতভাগ্য  কর্মচারী  ও তাদের  পরিবারগুলোকে  পথে বসানোর  চক্রান্ত করা হচ্ছে৷ গত ১৯ বছরে সবচেয়ে কম গাড়ি বিক্রি হওয়ায় ১৫০০০ কর্মচারী  কাজ  হারিয়েছে৷

৪. ফুড ডেলিভারি সংস্থা  ‘জেমাটো ইতিমধ্যে  ১০ শতাংশ কর্মচারী ছাঁটাই -এর সিদ্ধান্ত  নিয়েছে৷

৫. কম্পিউটার  নির্র্মতা সংস্থা  ইতিমধ্যে  ৯০০০ কর্মী ছাঁটাই করতে চলেছে৷

৬. ভারতীয় রেলে ৫০ টি ট্রেন ও ১৫০ টি প্লাটফর্ম ইতিমধ্যে  বেসরকারীকরণের  চুক্তি হয়ে গেল ৷ ভারত  সরকারের সবচেয়ে লাভজনক  সংস্থা রেলের বিভিন্ন পরিষেবা বেসরকারী হলে, প্রায় ৩ লক্ষাধিক  কর্মচারী  ছাঁটাই হবে৷ সাথে সাথে যাত্রীপথ  ভাড়া  ও খাদ্যসামগ্রীর মূল্য৷

৭.  BSNL- নামক  টেলিকম সংস্থা  আয় মন্দের মুখে৷ এতে ২ লক্ষের কাছাকাছি  কার্যকরী  কাজ হারানোর আশংকা তৈরী হয়েছে৷