ভারতের উদ্বাস্তু সমস্যা ও বাঙালীকে রাষ্ট্রহীন করার সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত

লেখক
এইচ এন মাহাত

একদা দেশটির নাম ছিল ভারবর্ষ৷ হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী দালালদের দৌলতে ভারতের স্বাধীনতার নামে যে রাষ্ট্র আমরা পেলাম তার নাম হলো শুধুমাত্র ভারত৷ এই ভারতের স্বাধীনতার জন্যে সব থেকে বেশী রক্ত দিয়েছে বাঙালী, আর আজ সেই বাঙালী জাতিকেই ৭০ বছর পর প্রমাণ দিতে হবে তাঁরা কী ভারতীয়? আমার মনে পড়ে  শ্রদ্ধেয় শরৎচন্দ্র বসুর লেখার কয়েকটি লাইন‘‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বার বার আমাদের জাতীয়তাবোধকে দুর্বল করার জন্যে যে পন্থা অবলম্বন করে জয়যুক্ত হয়েছে তাহা হলো বিচ্ছিন্ন করে শাসন করো---এটাই ছিল বিগত ১০০ বছরের নীতি৷’’ তিনি আরওবলেছেন---‘‘বাঙলার দাবীকে শ্বাসরুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সর্বভারতীয় রাজনীতির খেলায় তাদেরকে দাবার বোড়ে হয়ে থাকতে হয়েছে’’৷ আজও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে৷ স্বাধীনতার সময় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস ভারতের নেতৃবর্গকে বলেছিলেন, ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়---এই মুহূর্ত্তে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দরকার৷ ভারতের বৃদ্ধ ও পঙ্গু নেতৃত্বের এটা বোঝার মত বোধশক্তি ছিল না৷ তারা ভারতের মসনদের লোভ ও বৃদ্ধাবস্থার মৃত্যু ভয়ে ‘যাহা পাই তাহাই লুটপাট করে খাই’---এই নীতিতেই ভারত ভাগ মেনে নিল৷ স্বাধীনতার পর যারা দেশভাগের বলি হবেন তাদের কী পরিণতি হবে তাদের তখন সেটা চিন্তা করার কোন অবকাশ ছিল না৷

ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছিল মূলতঃ পঞ্জাব ও বাঙালীস্তানকে কেন্দ্র করে৷ পঞ্জাব ভাগের ফলে ওপার থেকে এসেছিল নয় লাখ তেতাল্লিশ হাজার বেশী বা কম মানুষ৷ কিন্তু কাগজে কলমে তের লাখের বেশী পাঞ্জাববাসীকে কেন্দ্রীয় সরকার বিনামূল্যে বসতবাড়ি চাসের জমি ও কয়েক বছরের জন্যে খাওয়া পরার ও শিক্ষা গ্রহণের জন্যে বিভিন্ন জায়গায় সাহায্য করে৷ তৎসহ ভাংড়া  ও নাঙ্গালের সুবৃহৎ বাঁধ নির্মাণ করে রুক্ষ মাটিকে সুজলা সুফলা করতে একটি মাষ্টার প্ল্যাণ করে পঞ্জাবের উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান করেছিল৷ শুধু তাই নয়, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে সব উদ্বাস্তু এসেছিল তাদেরকে পঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরাখণ্ডের লাগোয়া জায়গাতে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল৷

অপরদিকে দেখুন যে বাঙালীর রক্তের বিনিময়ে ভারত স্বাধীনতা লাভ করলো তাদের কী অবস্থা? হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীদের কুটিল বুদ্ধির কারণে বাঙালী উদ্বাস্তুদের দুটি ভাগে বিভক্ত করা হলো---‘বাস্তুত্যাগী উদ্বাস্তু’ ও ‘অবৈধ বাস্তুত্যাগী উদ্বাস্তু’৷ সরকারী ঘোষণায় বৈধ বাস্তুত্যাগী কারা বা এদের সঠিক সংখ্যাতত্ত্ব কারোর জানা নেই৷ বলা হয়েছিল ধীরে ধীরে এদের সরকার পুনর্বাসন দেবে৷ তাও কবে কোথায় হবে তাও কারোর জানা নেই৷ আর সরকারী মতে অবৈধ যারা এসেছিলেন তাদের পঞ্জাবের মতো একই লাগোয়া স্থানে বসতি না দিয়ে পাঠানো হলো আন্দামান ও নিকোবর, মধ্যপ্রদেশের দণ্ডকারণ্যে, জববলপুর, ওড়িশার কালাহাণ্ডি সহ ভারতের বিভিন্ন প্রত্যন্ত সুখা মরুভূমি বা বনাঞ্চলে৷ এদের উল্লেখিত পাণ্ডব বর্জিত স্থানে বসতি দিয়ে ও সামান্য খাবার  থাকবার খরচ দিয়ে সরকার নিজ দায়িত্ব খালাস করে৷ এদের সংখ্যাটি ৫৩ লাখের কিছু বেশী৷ হিন্দী সাম্রাজ্যবাদ তাদের ঔপনিবেশবাদ প্রতিষ্ঠা করতে ও বাঙালী জাতীয়তাবাদ ধবংস করতে স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও বলে বেড়াচ্ছে ভারতের বাঙালীরা নাকি বহিরাগত, অনুপ্রবেশকারী, উদ্বাস্তু ইত্যাদি৷ বাঙালীরা যখন উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন জায়গা নতুন করে নানা সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পেয়ে চলছে তখন বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার নানা প্রকার বাঙালী বিদ্বেষী আইন তৈরী করে বাঙালীর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে জাতির বৈপ্লবিক চেতনাকেই শেষ করতে চাইছে৷ সেটা কোনো দিনই হবার নয়৷ কেননা বাঙালী যেমন সহনশীল জাতি তেমনি একবার রুখে দাঁড়ালে সে অসাধ্য সাধন করতে পারে৷

এ অবস্থায় বাঙালীকে বাঁচতে হলে ও তার হৃতগৌরবের পনরুদ্ধার করতে হলে সুবা বাঙলা অর্থাৎ শরৎচন্দ্র বোস ও সুরাবদ্দীজী ভারতের স্বাধীনতার পরে যে স্থানটির নাম বলেছিলো বাঙালীস্তান তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷ এর চৌহদ্দি মগধ রাজ্যের সীমানা তথা পশ্চিমে  পরেশনাথ পাহাড় থেকে পূর্বে আরাকান, দক্ষিণে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর, উত্তরে হিমালয় পাদদেশ থেকে বিস্তৃত অঞ্চল৷ এর মধ্যে রয়েছে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ১১টি জেলার  যেমন পশ্চিম রাঢ় অঞ্চলের সমগ্র সঁাঁওতাল পরগণা, ধানবাদ, বোকারো, রাঁচী জেলার সিল্লী, সোনাহাতু, বুন্দু তামার আরকী, আংগারা, পূর্ব  সিংভূম, পশ্চিম সিংভূম, সরাইকেল্লা জেলা, ওড়িশার সুন্দরগড় জেলার চম্পুয়া সাব ডিভিশনের ময়ূরভঞ্জ জেলার মেঘাসিনি পাহাড় ও বৈতরণী নদীর পূর্বপাড়, তৎসহ ভদ্রক জেলার ভোগরাই ও চন্দনেশ্বর আড়াইটি ব্লক, বিহারের কিসানগঞ্জ জেলা, পলাসি ব্লক, বারসই এর সাতটি ব্লক, অসম রাজ্যের আপার অসম বাদে উত্তর- পূর্বাঞ্চলের সমতল অঞ্চল, ত্রিপুরা, আন্দামান নিকোবর, পশ্চিম বাংলা  সহ সমগ্র বাঙালী অধ্যুষিত অঞ্চল৷ এ মুহূর্তে বাঙালীকে বাঁচতে হলে সার্বিক শোষণমুক্ত নিজস্ব বাসভূমি বাঙালীস্তান ছাড়া আর কোন দ্বিতীয় বিকল্প নেই৷

এ যুগের শ্রেষ্ঠ মহান দার্শনিক (সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শন) প্রাউট দর্শন প্রণেতা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের মতে---‘‘আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা’’ সম্ভব৷ এই তত্ত্ব অনুযায়ী ভারতের আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করে শোষণমুক্ত সমৃদ্ধ ভারত গড়ার লক্ষ্যে গোটা ভারতবর্ষে ৪৪টি সমাজ (অঙ্গ সমাজ, মগহী সমাজ, তামিলনাড়ু, সয়েদ্রি সমাজ ইত্যাদি৷ ) আন্দোলন করে চলেছে৷ যার নেতৃত্বে রয়েছে  ‘‘প্রাউটিষ্ট সর্বসমাজ সমিতি’’৷ বাঙালীস্তান উল্লেখিত সমাজ আন্দোলনের একটি৷ তাই সবার উচিৎ সম্মিলিত প্রয়াসের দ্বারা এই আন্দোলনকে সফল করে তোলা৷