ভারতীয় রাজনীতির কর্কটব্যাধি

লেখক
একর্ষি

পূর্ব প্রকাশিতের পর

 

শুণতে খারাপ লাগলেও প্রকৃত ঘটনা হ’ল---ভারতবর্ষে বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মূলতঃ একটা চোখ ধাঁধানো শোষণমূলক ব্যবস্থা৷ তাত্ত্বিক দিক দিয়ে গণতন্ত্রকে দু’ভাগে ভাগ করা যায় রাজনৈতিক গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্র৷ রাজনৈতিক গণতন্ত্র আবার দু’রকম উদারনৈতিক গণতন্ত্র ও সাম্যবাদী বা সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র৷ ভারতে প্রচলিত গণতন্ত্র উদারনৈতিক গণতন্ত্র৷ রাজনৈতিক গণতন্ত্রের দুটি শাখাতেই যে ফল ফলে তা আসলে সযত্ন  লালিত বিষবৃক্ষের বিষফল বিশেষ৷ আবার ভারতের  উদারনৈতিক গণতন্ত্রের গায়ে ঘটা করে লটকে দেয়া হল গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র নামক ফলক৷ সেটা না সমাজতন্ত্র, না গণতন্ত্র--- সোনার পাথরবাটি যেমন, তবে মাকাল ফল বিশেষ৷ ব্যাপারটা কী? একটা সোজা কথা মনে রাখা দরকার---

রাজনৈতিক গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে মূলতঃ পুঁজিপতিরা৷ উদারনৈতিক গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে ব্যষ্টি বা গোষ্ঠী, আর সাম্যবাদী পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র৷ উভয়ক্ষেত্রেই অর্থের চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণ৷ কিন্তু মানুষের কল্যাণ তথা গণতন্ত্র সফল হবার প্রকৃত পথটা হ’ল জনগণের হাতে আর্থিক ক্ষমতা দেয়া৷ অর্থাৎ অর্থনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, ভাষান্তরে  অর্থনৈতিক স্বাধীনতা৷ এর ব্যবহারিক রূপটা হল --- মানুষের সর্বনিম্ন প্রয়োজনপূর্ত্তিকে (খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান- শিক্ষা-চিকিৎসা) গ্যারান্টি দেয়া ও ওগুলির মান তথা জীবনযাত্রার মান দিন দিন বাড়িয়ে যাওয়া৷ মানুষের হাতে ক্রয়ক্ষমতা থাকলেই এটা সম্ভব মনে রাখা দরকার, ক্রয়ক্ষমতা মানে ভিক্ষা বা দয়ার দান নয়৷ বিনামূল্যে ও বিনা পরিশ্রমে সরকারি বা সমাজের সাহায্যে বা পরিসেবা প্রাপ্তি নয়, অনুগ্রহ -করুণা প্রাপ্তি নয়--- তা অর্থে বা প্রয়োজনীয় দ্রব্যে বা পরিসেবায়--- সে যাতেই হোক না কেন৷ সমাজ সচেতন ঋষি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখিছেন যে ওগুলো আসলে পুঁজিপতিদের ‘সেফ্‌টিভাল্‌ভ’,যাতে জনগণ বিদ্রোহী না হয়ে ওঠে! দৈহিক  বা মানসিক শ্রমের বিনিময়ে সম্মান-মর্যাদার সঙ্গে ন্যায্য অধিকার হিসাবে প্রয়োজনীয় সামগ্রী-সেবা লাভ করবার যে সামর্থ বা ক্ষমতা অর্জিত হয়--- তাকেই বলে ক্রয়ক্ষমতা৷ মানুষের হাতে এই সামাজিক অধিকার---ক্রয়ক্ষমতা থাকতে হবে৷ এজন্য দেশের প্রতিটি অংশে ১০০ শতাংশ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকা দরকার৷ কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ভারতে আজো তা অধরা৷

কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সৎ ও যোগ্য নেতাদের উঠে আসার প্রায় কোন সুযোগই থাকে না৷  ভারতের সংবিধান ও সে দায়িত্ব নেয়নি, নিশ্চিতিততা দেয়নি৷ দেবেই বা কি করে! ভারতের সংবিধান যে তিন শোষক-গোষ্ঠী দ্বারা রচিত! এই তিন গোষ্ঠী হ’ল যথাক্রমে--- দেশী সাম্রাজ্যবাদ, পরোক্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ  ও ভারতীয় পুঁজিপতিদের প্রতিনিধিত্ব করা শাসক দল৷ যেমন ধরণের গাছ তেমন তার ফল৷ সংবিধান হয়েছে ছদ্মবেশী পুঁজিবাদের দোসর৷ ফলে ভারতে অর্থনৈতিক ক্ষমতার  চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণ ঘটেছে, আর তাত্ত্বিকভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ স্বীকৃত হয়েছে৷ তবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোটা যতনা যুক্তরাষ্ট্রীয়, তার চেয়ে অনেক বেশী এককেন্দ্রীয়৷ যাইহোক ১৪০ কোটির অধিক মানুষের দেশে পুঁজিপতি পোষিত শাসন যন্ত্রের ফসল---আম্বানি, টাটা, বিড়লা, গোয়েঙ্কা, হাজারিয়া, বাজারিয়া প্রমুখ ৭৫টি পুঁজিপতি গোষ্ঠী আর নীরদ মোদি, হর্ষদ মেহেতা, মেহুল চোস্‌কি, লোলিত মোদির মত হাজার  হাজার কোটি টাকার  ব্যাঙ্ক প্রতারক৷

কর্কটব্যাধি আক্রান্ত ভারতীয় রাজনীতি এখন মারণ সেপ্ঢোসিমিয়ার বিবশ৷ সে আবার কী? এ হ’ল--- শিক্ষা ও সমাজ ভাবনায় এবং ব্যষ্টি ও সমষ্টি জীবনে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ‘ধর্মচ্যুতি’, এ যেন শিরঃপীড়ায় শিরচ্ছেদ৷ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’---একটা অবাস্তব, অপ্রাকৃত (এন্টি নেচার), অবৈজ্ঞানিক ও  আকাশকুসুম কল্পনা মাত্র৷ অথচ ১৯৭৬ সালের ৪২তম সংবিধান সংশোধন আইনে সংবিধানের প্রস্তাবনায় পশ্চিমী ও জড়বাদী ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে প্রকৃতধর্ম নিহিত আধ্যাত্মবিজ্ঞানকে, ভারতীয় জীবনধর্মকে ও বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে ভারতেরই সংবিধান-প্রণেতারা ভারতেরই সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শংসা-তকমা গুঁজে দিলেন৷ সংবিধানের ২৫ থেকে ২৮ অনুচ্ছেদে ধর্ম সংক্রান্ত নির্দেশগুলো দেওয়া হয়েছে৷ এখন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র বিরোধিতায় অনেক তথাকথিত আত্মপ্রসাদী বিজ্ঞানবাদী প্রগতিবাদী হয়ত নাসিকা কুঞ্চন করবেন৷ কিন্তু সত্যটা সকলেরই জানা দরকার৷ (ক্রমশ)