‘‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’’

লেখক
পথিক বর

রাজনীতি সেদিন আজকের মত স্বার্থের তরী বেয়ে রাজক্ষমতা ভোগের পেছনে ছুটতো না৷ সেদিনের রাজনীতি ছিল দেশের জন্যে, দশের কল্যাণের জন্যে জীবনাদর্শে উজ্জীবিত, উৎসর্গীকৃত৷ পরাধীন ভারতবর্ষে বাঙলার রাজনীতি তাই ছিল৷ বাঙলার কথাই বললাম কারণ স্বাধীনতার জন্যে স্বর্গীয় হাসি মুুখে নিয়ে ফাঁসীর মঞ্চে নির্ভয়ে এগিয়ে দাঁড়াবার হিম্মত অবশিষ্ট ভারতে ক’জনেরই বা ছিল?

আজ তো রাজনীতি মানে স্বার্থের সংঘাত, লোভ লালসা চরিতার্থ করার সংগ্রাম৷ ধর্মের মুখোশ ধারণ করে দেশপ্রেমের নামে দেশকে লুটে নেওয়াই আজকের রাজনীতি৷ আর সেদিন বাঙলার রাজনীতি বুঝতে সুভাষচন্দ্রের একটি আবেদনই যথেষ্ট---‘‘ভুলো না যে, দাসত্বের চাইতে বড় অভিশাপ আর নেই৷ ভুলো না যে, অন্যায় ও দুর্নীতির চাইতে আপোষ করার চাইতে বড় অপরাধ আর নেই৷ জীবনকে পরিপূর্ণভাবে পেতে হলে জীবনের বিনিময়ে তা পেতে হবে৷ আরও মনে রেখো সমস্ত ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে৷’’

অগ্ণিযুগের বাঙলা৷ মানিকতলা বোমার মামলায় অনেকেই তখন কারাগারে বন্দী৷ অরবিন্দ ঘোষ সহ অনেকেই সেই কারাগারে আবদ্ধ৷ নরেণ গোঁসাই, সত্যেন বসু, কানাইলাল দত্ত সহ আরও অনেকেই জেলখানা আলো করে হৈ-হুল্লোরে মেতে থাকে৷ হঠাৎই ছন্দপতন৷ নরেণ গোঁসাই বিপ্লবীদের অনেক গোপন কথা পুলিশের কাছে ফাঁস করে দিয়েছে৷ সে রাজসাক্ষী হতে চেয়েছে৷ খবর পেয়ে চমকে ওঠে কারাবন্দী বিপ্লবীরা৷ দেশ ও জাতির সঙ্গে নরেণের এই বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নেওয়া যায় না৷ বিশ্বাসঘাতকের ক্ষমা নেই৷

বিশ্বাসঘাতকতার জবাব দিতে তৈরী হ’ল দুই বন্দী তরুণ৷ সব পরিকল্পনা তৈরী, অসম্ভবকে সম্ভব করে হাতে আগ্ণেয়াস্ত্র এসে গেছে, এখন শুধু সুযোগ ও সময়ের অপেক্ষা৷ এমন সময় বেঁকে বসল আর এক তরুণ৷ পুলিশের কাছে খবর গেল সেও রাজসাক্ষী হবে৷ তবে তার আগে নরেণের সঙ্গে একটু পরামর্শ করে নেবে৷ ফাঁদে পা দিল শক্তির দম্ভে অন্ধ ব্রিটিশ পুলিশ৷

১লা সেপ্ঢেম্বর ১৯০৮৷ আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের দোতলায় একটি ওয়ার্ডে অপেক্ষা করছে সত্যেন৷ একটু পরেই প্রহরী বেষ্টিত হয়ে প্রবেশ করল নরেণ৷ কিন্তু কীসের পরামর্শ দেশদ্রোহীর সঙ্গে! মুখ নয় কথা বলল সত্যেনের পকেট থেকে বেরিয়ে আসা হাতের রিভলবার৷ কিন্তু গুলি ঠিক জায়গায় লাগেনি৷ উরুতে আঘাত নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায় নরেণ৷ বাইরে তখন অপেক্ষা করছিলেন কানাইলাল দত্ত৷ বিশ্বাসঘাতকের ক্ষমা নেই৷ গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল নরেণের দেহ৷

সাম্রাজ্যবাদী শাসকের বিচারের প্রহসন৷ সাজা যথারীতি  মৃত্যুদণ্ড৷ ১০ই নভেম্বর ১৯০৮৷ বিষণ্ণ্ সকালে আলিপুর জেলগেটের বাইরে হাজার হাজার মানুষ৷ একটু আগেই স্বর্গীয় হাসিমুখে ফাঁসীর মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়ে চলে গেলেন কানাইলাল দত্ত৷

তার ঠিক দশ দিন পরেই ২১শে নভেম্বর,আর এক বিষণ্ণ্ সকালে সেই আলিপুর জেলগেটের বাইরে একই দৃশ্য৷ এবার বিদায় নিলেন সত্যেন বসু৷ এইভাবেই শত সহস্র বাঙালীর জীবনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা৷ আর আজ সেই বাঙালীর শিরে এন.আর.সি-র খড়্গ, বিদেশীর তক্‌মা৷ আর একবার কি ফিরে আসবে না সেই অগ্ণিযুগ? আর এক বার কি জেগে উঠবে না সেই সব তরুণ দামাল ছেলে---চিত্ত যাদের ভয়শূন্য, উচ্চ যাদের শির!