ছুটিয়াছে জাতি প্রেম মৃত্যুর সন্ধানে

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

কয়েকদিন এক ভয়ঙ্কর বর্বরতার সাক্ষাৎদ্রষ্টা হয়ে থাকল দেশের রাজধানী শহর৷ তথাকথিত ধর্মের নামাবলী গায়ে একদল পাষণ্ড হিংসার উৎসবে মেতে উঠল৷ মানুষের রক্তের অকাল হোলি দেখল শহরবাসী৷ এই হিংসার উস্কানীদাতা লজ্জা-শরমহীন একদল দেশনেতা(!) কণ্ঠে যাদের হুঙ্কার ধবনি---‘গোলি মারো শা....’৷ এই দেশনেতারাই দেশের কর্ণধার৷ স্বাভাবিকভাবেই প্রশাসন সাক্ষীগোপাল হয়ে থাকল৷ একই হুঙ্কার কলকাতাবাসীকেও শুনিয়ে গেল দেশের রক্ষক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ তাঁর সভাতেও আবাজ উঠল---’গোলি মারো.....’৷ শাহজী শুনে উচ্ছ্বসিত হলেন, বাঙলা তাহলে দখলে আসছে! আশ্বাস দিলেন সোনার বাঙলার৷ গোলির বন্যায় সোনার বাঙলা---বাঙালী উদ্বেলিত! সত্তর দশকে একটি জড়বাদী দলের কণ্ঠেও শোণা গিয়েছিল---‘বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস’৷ লাল বাঙলার স্বপ্ণ দেখেছিল তারাও৷ কালের গতিতে সেই লাল আজ অস্তাচলে গেছে৷ লালের ধারক-বাহকরা তথাকথিত ধর্মমতের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে৷ গোলির আবাজ তো বন্দুকের নল থেকেই আসে!

আশি বছর আগে সুভাষচন্দ্রকে প্রতিহত করতে কংগ্রেসী মঞ্চে আবাজ উঠেছিল---‘হিন্দুস্থান কা হিটলার, মহাত্মা গান্ধী কি জয়’৷ ঘটনাচক্রে সেদিনের হিন্দুস্থান কা হিটলার আর আজকের শাহজী একই প্রদেশের লোক৷ প্রাদেশিকতার দোষে দুষ্ট হব কি না জানি না, গায়ের জোরে গণতন্ত্রকে বশে আনার রেওয়াজ হিন্দুস্থানের গো-বলয়ের ওই বিশেষ রাজ্য থেকেই শুরু হয়েছিল৷ তাই নির্বাচনে বিপুলভাবে জিতেও সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতি থাকতে পারেন নি৷ সেদিনের ‘হিন্দুস্থান কা হিটলার’ ও আজকের ‘গোলি মারো’ আবাজে শব্দগত পার্থক্য থাকলেও অর্থগত বা ভাবগত কোন পার্থক্য নেই৷ প্রাদেশিক জাতিগত পার্থক্য তো নেই-ই৷

এইভাবে অভিশপ্ত স্বাধীনতার বলি আর ক-ত হবে? ধর্মের মুখোশ ধারণ করে জাতিপ্রেমের নামে দেশবাসীকে লজ্জিত করে নরসংহারে যারা মেতে উঠল, রাষ্ট্রযন্ত্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের বরহস্ত তাদের মাথার ওপর৷ তাই তো প্রশাসনকে পঙ্গু করে অবাধে হত্যালীলা চালিয়ে যেতে পারল একদল নরপিশাচ৷

রক্ষক যেখানে ভক্ষক হয়ে ওঠে সেখানে সাধারণ মানুষের ভরসার জায়গাটাই হারিয়ে যায়৷ গত কয়েক দিনে রাজধানী শহরের সেই চেহাররাটাই দেখল বিশ্বের মানুষ৷ কিছু মানুষের  আক্রোশের বলি হ’ল কিছু মানুষ৷ ঘরবাড়ি যানবাহন জ্বলল, রাজধানী শহরের একপ্রান্ত রক্তস্রোতে ভেসে গেল, পঞ্চাশ জনের মত মানুষের মৃত্যু হ’ল৷ প্রশাসনের কোন হেলদোল ছিল না৷ রাষ্ট্র সংঘের মহাসচিব ঠিক সময়ে মুখ খোলায় দুর্যোগের আঁধার রাত্রি দীর্ঘস্থায়ী হ’ল না৷ মুখে কালি তো লেগেই গেছে৷ তবুও বিশ্বের দরবারে মান বাঁচাতে প্রশাসনকে সক্রিয় হতে হ’ল৷ অসহায় মানুষের রক্তস্রোতের গর্জন আর হিংস্র দ্বিপদের আস্ফালনের হাত থেকে রেহাই পেল রাজধানীর মানুষ৷

এই হিংস্র আবর্তে স্বার্থের বন্ধনে জর্জরিত মানুষ হারিয়ে যাওয়া পরিচিত জনের জাতের পরিচয়, সম্প্রদায়ের পরিচয় খোঁজায় ব্যস্ত ছিল৷ নির্মম মৃত্যুও রেহাই দেয়নি গুরুতর বিচ্ছেদের অভিশাপ থেকে৷ জাতের পাপ, সম্প্রদায়ের পাপ, তথাকথিত ধর্মীয় বিদ্বেষের পাপ মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছিল৷ চারিদিকে অসত্যের দ্বারা পরিবৃত মানুষগুলো বিভেদ-বিদ্বেষের বিষাক্ত পরিবেশে থেকে দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে৷ তাই দুর্বুদ্ধির তাড়নায় সহজেই ছুটে যায় বিনাশের পথে৷ স্বরচিত বিচ্ছেদের কুটিল ফণার ছোবলে ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়৷

মানুষ কবে বুঝবে জাতিপ্রেমের নামে এই হিংস্রতা, এই মৃত্যুর মিছিল ধর্ম নয়, ধর্মের মুখোশধারী শয়তানদের আবরণ৷ স্বার্থলোভে জর্জরিত, ক্ষমতার মোহে অন্ধ দাম্ভিক দানবীয় শক্তি স্তাবকদের বিপথে নিয়ে চলেছে৷ স্তাবকদল বোঝে না এই পথ ধর্মের পথ হতে পারে না৷ ধর্ম মানুষকে খুন করতে শেখায় না, মানুষের রক্তের স্রোত বহাতে শেখায় না৷ ধর্ম প্রেমে ভক্তিতে সকলকে সকলের আত্মীয় করে তোলে৷ সেখানে বিভেদ বিদ্বেষের কোনও স্থান নেই৷ তবু মানুষ ছুটে চলেছে বিভেদ-বিদ্বেষের বিষে জর্জরিত হয়ে তথাকথিত ধর্মমতের তাড়নায়৷ কে তাদের বোঝায় এই অন্ধ জাতিপ্রেম---এই জাতি বিদ্বেষ তাকে গহন আঁধারে, মৃত্যুর গহ্বরে ঠেলে দিচ্ছে---  

‘ছুটিয়াছে জাতিপ্রেম মৃত্যুর সন্ধানে

বাহি স্বার্থতরী, গুপ্ত পর্বতের পানে’৷