দার্শনিক তত্ত্ব ও সমাজ।

লেখক
খগেনচন্দ্র দাস

এডাম স্মিথ (১৭২৩-১৭৯০)

পুঁজিবাদী দর্শনের জনক। কোন দার্শনিক যখন কোন তত্ত্ব সৃষ্টি করেন তখন সমাজ ও তার বাস্তব চিত্রটি তাঁর সামনে থাকে। সেখান থেকেই তিনি তাঁর দর্শন সৃষ্টির মূল প্রেরণা পান। সঙ্গে থাকে অবশ্যই তাঁর অন্তৰ্দৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি। কোন দার্শনিকই মানুষের অ-হিত বা অ-কল্যাণ কামনা করে কোন তত্ত্বের জন্ম দেন না। শুধু কালপ্রবাহে অথবা ভুল প্রয়োগে তা নষ্ট হয়।  উদাহরণ হিসেবে অত্যন্ত সহজভাবে যদি এডাম স্মিথের লেজিসফেয়ার তত্ত্বকে বুঝতে চাই তবে এক কথায় (Laissez-Faire) এই ফরাসি শব্দটির আক্ষরিক অর্থ "মানুষ যা পছন্দ করে তাকে তা করতে দেওয়া।" ব্যবসা-বানিজ্যে রাষ্ট্রের কোনধরণের হস্তক্ষেপ থাকবে না, সম্পূৰ্ণ ব্যষ্টিস্বাধীনতা। যে সময়ে স্মিথ তাঁর তত্ত্ব ব্যাখ্যা করছেন তখন শিল্প বিপ্লব হয়নি ফলে স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন ছিল অত্যন্ত অপ্রতুল। অথচ বস্তুর চাহিদা বাড়ছিল। ফলে তিনি বললেন----- কোন শিল্পপতি যদি কোন একটি বস্তুর দশ ইউনিট উৎপাদন করে দশ টাকা লাভ করে তবে তাকে একশো ইউনিট উৎপাদন করে একশ টাকা লাভ করার সুযোগ দেওয়া উচিত। যুক্তি ছিল যে,এতে একজন মালিকের পুঁজি বাড়ছে এটা মুখ্য বিষয় নয়,সমাজ অধিক সামগ্রী পাচ্ছে সেইটেই বিবেচ্য,কারণ চাহিদা অনুযায়ী ছিল বস্তুর অভাব ।  

 এডাম স্মিথ বুঝতে পারেন নি যে, তাঁর তত্ত্বের সুযোগ নিয়েই পরবর্তী সময়ে শিল্প বিপ্লবের যুগে শুরু হবে শিল্পপতিদের বাড়বাড়ন্ত। ফলে একদিকে জমে উঠলো পুঁজির পাহাড়,অন্যদিকে শ্রমিক-কৃষকের হাহাকার। উনবিংশ শতাব্দীর এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩)। শিল্প বিপ্লব শ্রমিকদের উপর যে দুৰ্বিসহ, অমানবিক অত্যাচার নামিয়ে এনেছিল তা দেখে কার্ল মার্ক্সের হৃদয় কেঁদে উঠল। জন্ম নিল মার্ক্সের দর্শন কমিউনিজম। স্মৰ্তব্য যে,শ্রদ্ধেয় দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার কার্ল মার্ক্সকে মহামতি কার্ল মার্ক্স বলে সম্বোধন করেছেন। মার্ক্স বললেন--- শিল্পপতির যত আয় তাতে শ্রমিকেরও অধিকার রয়েছে। এডাম স্মিথ যে বিষয়টি উপেক্ষা করেছিলেন কার্ল মার্ক্স সেটিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিলেন।

 কিন্তু না; শিল্পপতি বা শ্রমিক,'কেউ কথা রাখেনি'। উভয় পক্ষই নিজেরদের আখের গুছিয়েছেন। মার্ক্সবাদ মুখথুবড়ে পড়েছে। ভারতবর্ষে মার্ক্সবাদকে মার্ক্সবাদীরা রীতিমত হত্যাই করেছে। আজকের শিল্পপতিরা আরও অনেক বেশি চতুর --- শুরুতে তারা চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করত আর আজ;'যা ইচ্ছা যতখুশি উৎপাদন কর, যোগান নিজেই তার চাহিদা অর্থাৎ বাজার তৈরি করে নেবে।'

 এমন এক জটিল সন্ধিক্ষণে বিংশ শতাব্দীতে উপর্যুক্ত দুই তত্ত্বকেই নস্যাৎ করে নোতুন দর্শন "প্রাউট"  নিয়ে আবির্ভূত হলেন শ্রীপ্রভাতরঞ্জন (সরকার১৯২১-১৯৯০)। প্রথমোক্ত দুই দার্শনিকের তত্ত্বের তত্ত্বগত ভুলের চেয়েও প্রায়োগিক  ত্রুটি ছিল বেশি। একথা বিশ্বকবি তাঁর ঋষিদৃষ্টিতে উপলব্ধি করেছিলেন।(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  "রাশিয়ার চিঠি" উপসংহার দ্রষ্টব্য) 

  পুঁজিবাদের দোসর গণতন্ত্র। আর দুর্নীতির আতুরঘর গণতন্ত্র। সে যাই হোক, 'মন্দের ভাল' হলেও শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রের বিকল্প এইমুহুর্তে নেই। মার্ক্সবাদীরা গণতন্ত্রকে শিকেয় তুলে একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে মার্ক্সীয় সমাজবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। প্রাউট প্রবক্তা নেতৃত্বে এক নোতুন সম্প্রদায় "সদবিপ্র" কে চেয়েছেন। (সদবিপ্রের যোগ্যতা কী,কি করে সদবিপ্র তৈরি হবে ইত্যাদি আজকের আলোচ্য বিষয় নয়।) 

সদবিপ্রেরা কী করে অর্থ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্ৰণ করবে ? এর একাধিক  রাস্তা হতে পারে (এক) গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে। (দুই) পুঁজিবাদীদের নিয়ন্ত্ৰিত অর্থনীতিকে চেলেঞ্জ করে প্রাউট প্রবক্তার প্রদর্শিত পথে সমগ্র অর্থব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্ৰণ করার মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ অর্থব্যবস্থার সর্বস্তরে সমবায় ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। (তিন) বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। (চার) তথ্যভিজ্ঞ মহলের ধারণা, প্রাউট প্রবক্তা তাঁর প্রবর্তিত সংঘটনের সাংঘটনিক পরিকাঠামোগত ব্যবস্থার মধ্যেই প্রাউট দর্শন বাস্তবায়নের রূপরেখা গুপ্তধন সন্ধানের রেখাচিত্রের মত অঙ্কিত করে রেখেছেন। 

   তত্ত্বের বাস্তবায়নের সঙ্গে ক্ষমতায়নের সংযোগ একেবারে শূন্য না হলেও অত্যন্ত ক্ষীণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে মার্ক্সবাদের সবচেয়ে বড় ত্রুটি ছিল 'মার্ক্সবাদের উপযুক্ত করে সমাজের মানুষের মানসিকতাকে গড়ে তুলতে না পারা'। কথাটা প্রাউট তত্ত্বের প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সমানভাবেই প্রযোজ্য। একথা অনস্বীকাৰ্য যে,"সমবায়," প্রাউট দর্শনের প্রাণ।  সমবায়ের জন্য সাধারণ মানুষের মানসিক প্রস্তুতি  বিহনে প্রাউট দর্শন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা অর্থহীন। প্রবক্তা সমবায়ের সাফল্যের জন্য যেসব পূর্ব শর্ত আরোপ করেছেন সেগুলো মধ্যে অন্যতম----  যাদের জন্য সমবায়,সেই জনগোষ্ঠীকে মনে প্রাণে সমবায়কে গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ সমবায়ের প্রয়োজনীতার বিষয়টি সাধারণ মানুষকে সম্যকরূপে উপলব্ধি করাতে হবে। আর এই সমবায় মানুষকে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করাতে; স্কুল কলেজের বিজ্ঞান শিক্ষার থিওরি ও সেই বিষয়ের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের মত হাতে কলমে জনসাধারণের সামনে উপস্থাপিত করতে হবে। আর এখানেই মার্ক্সবাদের প্রয়োগকৌশল (methodology)র সঙ্গে প্রাউট দর্শন বাস্তবায়নের মৌলিক পার্থক্য। মার্ক্সবাদীরা চেয়েছিলেন ক্ষমতায়নের পর ক্ষমতার স্টীমরুলার চালিয়ে মার্ক্সবাদের প্রয়োগ করতে। আর সেজন্যই মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এইভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে-- কৃষি,শিল্প, বাণিজ্য, সেবা ইত্যাদিতে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়নের রীতির জন্যই প্রাউট প্রবক্তা তাঁর দর্শনকে "প্রয়োগভৌমিক তত্ত্ব" বলে আখ্যায়িত করেছেন।  প্রাউট প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার শুধু বলেই ক্ষান্ত থাকেন নি,কারা কীভাবে এই কাজ করবেন তার জন্য প্রয়োজনীয় বিভাগ অর্থাৎ ডিপার্টমেন্টেরও ব্যবস্থা করেছেন। অতঃ কিম্।