দলত্যাগ আইন কঠোর হওয়া প্রয়োজন

লেখক
প্রভাত খাঁ

এদেশে জঘন্য দলবাজীর রাজনীতি গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করেছে৷ স্বাধীনতার পর আজ পর্যন্ত দেশে ৭০ বার রাষ্ট্রপতি শাসন জারী হয়েছে৷ দেশে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইন জারী হয়েছে একবার৷

১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন একটি দলত্যাগ বিরোধী আইন পাশ করেন৷ কিন্তু গণতন্ত্রের সুরক্ষায় স্বার্থান্বেষী দলত্যাগ রুখতে  সেই আইন যথেষ্ট নয়, কারণ কোনও দলের এক-তৃতীয়াংশ সদস্য জোট বেঁধে দলত্যাগ করলে সেটা বৈধ হয়ে যায়৷ এই সুযোগ দুর্নীতিগ্রস্ত জনপ্রতিনিধিরা নেয়৷ তাঁরা চাইলে যে কোনও সরকারকে ফেলে দিতে পারে৷ সেখানে অবৈধ অর্থের লেনদেনও চলতে পারে৷ দলবদল করিয়ে সরকার ফেলে দেওয়া বা অন্য দলের সরকার গঠনের নজির ভারতে নেহাত কম নেই৷ স্পিকার চাইলে কিছুটা আটকাতে পারেন, কিন্তু তিনিও কোনও দলেরই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি৷ তাই তাঁর কাছে সবসময়ই নিরপেক্ষতা আশা করা যায় না৷ তারও ভুরি ভুরি নজির আছে৷

সংবিধানের একটি বড় ত্রুটি যে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার পর জনগণের আর কোনও কিছু করার থাকে না৷ নির্বাচিত প্রতিনিধি দলত্যাগ করার জন্য জনগণের মত নেবার প্রয়োজন পড়ে না৷ ফলে দলবদলটা এখন জলভাতের মত হয়ে গেছে৷ বিশেষ করে রাজ্যে যদি কেন্দ্র বিরোধী সরকার থাকে তাকে ফেলার জন্যে অর্থ ও ক্ষমতার প্রয়োগ ব্যাপকভাবে ঘটে৷ একে রোখার কোনও আইন সংবিধানে নেই৷ তাই ক্ষমতাসীন দল অনেক সময় আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নানা কারচুপি করে ক্ষমতায় টিঁকে থাকতে চায়৷ গত লোকসভা নির্বাচনে ফলাফল নিয়ে এরকম সন্দেহ দেখা দিয়েছে৷ ই.ভি.এম.-এ কারচুপি, নির্বাচন কমিশনারের পক্ষপাতিত্ব এরকম আরও অনেক অভিযোগ উঠেছে৷ নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তো নির্বাচন কমিশনেরই আর এক সদস্য তুলেছেন৷ ফলে একবার কেউ ক্ষমতায় বসলে ছল-বল-কৌশল প্রয়োগ করে থাকে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্যে৷

ভারতে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত শাসন ব্যবস্থা চালু আছে৷ তার ফলে দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিক দেশ শাসনের অধিকার পেতে পারে৷ দলের বাইরে থেকে অনেক দেশ সেবক নির্দল প্রার্থী রূপে জিতে কাজ করে খ্যাতি লাভ করেছেন৷ এরকমও নজির আছে৷ কিন্তু এই পঞ্চায়েৎ ব্যবস্থাকেও দলতন্ত্র গ্রাস করেছে৷ এখানেও ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখার জন্যে দলবাজী চলে পুরোদমে৷ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ইচ্ছামত এ দলে-সেদলে  যাওয়া-আসা করেন৷ ফলে সাধারণ মানুষের কাছে ভোট দেওয়ার মৌলিক অধিকার ঠিকভাবে রূপায়িত হয় না৷

বর্তমানে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতা ও অর্থের জোরে ভয় অথবা প্রলোভন দেখিয়ে বিরোধী বিধায়কদের দলে টেনে বিভিন্ন রাজ্যে বিরোধী সরকার ফেলে দেশে একদলীয় শাসন কামেয়ম করতে চাইছে৷ এমনও দেখা যাচ্ছে বিরোধী দলের সাংসদ বিধায়ক থাকাকালীন যাদের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, শাসক দলে যোগ দিলেই সেই অভিযোগ থেকে মুক্ত হয়ে যান৷ এতে দলত্যাগী আইনকে অবজ্ঞা করে দলত্যাগের প্রবণতা বাড়ছে৷

ফলে রাজীব গান্ধীর আমলের দলত্যাগ বিরোধী আইন শুধু ভোঁতা নয়, গণতন্ত্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও হারিয়েছে৷ জনপ্রতিনিধিদের অবশ্যই দায়বদ্ধ থাকবে হবে ভোটারদের কাছে৷ যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁরা ভোটে জয়লাভ করেন সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার দায় সেই জনপ্রতিনিধিকে অবশ্যই নিতে হবে৷ পাঁচ বছরে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে পরবর্তী নির্বাচনে তাঁর দাঁড়াবার অধিকার থাকা উচিত নয়৷ তাই দলত্যাগ বিরোধী আইনের সমস্ত ফাঁকফোকর বন্ধ করে গণতন্ত্রের সুরক্ষা ও জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে দলত্যাগ বিরোধী আইন আরও কঠোর করতে হবে৷ যাতে জনপ্রতিনিধিরা জনগণের স্বার্থে কাজ করতে বাধ্য হন৷ যে দলের নির্বাচনী প্রতীকে তিনি জয়ী হয়েছেন সেই দল ত্যাগ করতে হলে সবার আগে জনপ্রতিনিধিদের বিধায়ক বা সাংসদ পদ ত্যাগ করতে হবে৷ তিনি চাইলে নূতন করে জনগণের রায় নিতে পারবেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে৷