ধর্ম মহাসম্মেলনের পুরোধা প্রমুখের সংক্ষিপ্ত প্রবচন

লেখক
আচার্য মােহনানন্দ অবধূত

 আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে মানুষের মনে যে ধরণের জিজ্ঞাসা আসে তাদের বলা হয় পরিপ্রশ্ণ৷ অধ্যাত্ম জীবনের পরিপ্রশ্ণগুলির মধ্যে বিশেষ পরিপ্রশ্ণ হলো যে পরমপুরুষ  কাছেই আছেন  অথচ তাকে পাচ্ছি না কেন? আর তাকে পেতে গেলে সাধনাটাই কিরূপ ভাবে করতে হবে?

আমাদের দশটি ইন্দ্রিয় রয়েছে৷ পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়৷ পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় হলো---চক্ষু,কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক৷ আর পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় হলো বাক্,পাণি,পাদ,পায়ু ও উপস্থ৷  ওই দশটি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আমরা কাজ করে থাকি৷ আমরা যা কিছু বাহ্যিক জ্ঞান আহরণ করি জ্ঞানেন্দ্রিয় দ্বারা৷  এখন চক্ষু,কর্ণ,নাসিকা,জিহ্বা,ত্বক এই ইন্দ্রিয়গুলি কিন্তু আসলে ইন্দ্রিয়ের দ্বারমাত্র৷ এগুলির আসল অস্তিত্ব  হলো আমাদের মস্তিষ্কের বিশেষ বিশেষ বিন্দুতে৷  ভৌতিক সত্তাগুলির, রূপ,রস,গন্ধ,স্পর্শ ও শব্দ তন্মাত্রগুলি ইন্দ্রিয়ের দ্বারগুলিতে প্রবেশ করে৷ মস্তিষ্কস্থিত বিন্দুগুলিতে যখন সেগুলি পৌঁছায় তখন মন ওই তম্মাত্রগুলি অনুভব করে থাকে ও বস্তুজ্ঞান লাভ করে৷ ভৌতিক তন্মাত্রের তরঙ্গে মন তরঙ্গায়িত হওয়ার ফলে  মনের কিছু অংশ জড়তরঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে যায়৷ এর থেকে বাঁচতে গেলে মনকে ঊধর্বলোকে রাখতে হয়, অর্র্থৎ পরমপুরুষের ভাবনা রেখে কাজ করলে মনের এমন অধ:স্তরে নেমে আসা থেকে মনকে রক্ষা করা যায়৷ তমাত্রগুলির তরঙ্গে মন অশান্ত হয়ে ওঠে৷ এই অশান্তমনকে শান্ত করতে গেলে প্রাণায়াম সাধনা করা দরকার৷ এতে মন শান্ত হয় আর তবেই কোনকিছুকে সঠিক ভাবে অনুভব করা যায়৷ প্রাণায়ামের দ্বারা প্রাণ বায়ু নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে৷ তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ইন্দ্রিয়ানাং মনোনাথ, মন নাথস্তু মারুতঃ৷  ইন্দ্রিয়গুলির নাথ হচ্ছে মন আর  মনের নিয়ন্ত্রক বা নাথ হলো মারুত বা প্রাণ বায়ু ৷ আমাদের মনে যখন  ইন্দ্রিয়গুলি বাহিত তরঙ্গ পৌঁছায় এতে মন চঞ্চল হয়ে ওঠে কিন্তু প্রাণায়াম ও পরমপুরুষের ভাবনা থাকলে মন চঞ্চল হবে না--- এটাই হলো পদ্ধতি৷ শ্বাস জোরে চললে মন চঞ্চল হয়ে ওঠে আর ধীরে ধীরে চললে মন শান্ত হয়ে থাকে৷ তাই মনকে ট্রেনিং দেওয়ার জন্য প্রাণায়াম অভ্যাস করতে হবে৷

এখন শাস্ত্রে মনকে একটি ইন্দ্রিয় হিসাবে গণ্য করা হয়৷ মনকে একাদশ ইন্দ্রিয় বলা হয়৷ ভৌতিক তন্মাত্রের জ্ঞান আহরণে দশ ইন্দ্রিয়গুলি সাহায্য করে কিন্তু সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তরঙ্গের অনুভূতির জন্যে অর্র্থৎ আধ্যাত্মিক তরঙ্গের অনুভব মনের দ্বারাই হয়ে থাকে বলে মনকেও ইন্দ্রিয় পদবাচ্যের মধ্যে গণ্য করা হয়৷

এখন মন যখন মূলধারে পূর্ণভাবে কনসেন্ট্রেট হয়ে যায় তখন কুলকুন্ডলিনী জেগে ওঠে আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনতে পাওয়া যায়৷ আর এ অবস্থায় সাধক অনুভব করে যে সে আর পরমপুরুষ একই লোকে রয়েছে---এটাকে বলে সালোক্য স্থিতি৷ আর মন যখন স্বাধিষ্ঠানে পূর্ণভাবে কেন্দ্রীভূত হয়ে যায় আর কুন্ডলিনী যখন স্বাধিষ্ঠান পর্য্যন্ত উঠে আসে তখন সাধক নূপুরের ধবনি শুণতে পায় আর সাধক অনুভব করে যে সে পরমপুরুষের নিকটেই রয়েছে, একে শাস্ত্রে বলে সামীপ্য৷  আর মন যখন পূর্ণভাবে মণিপুরে কেন্দ্রীভূত হয়ে যায় আর কুলকুন্ডলিনী মণিপুর পর্য্যন্ত উঠে আসে তখন সাধক বাঁশরীর ধবনি শুনতে পায়, তখন সাধক অনুভব করে যে সে পরমপুরুষের কাছাকাছি একেবারে ঘেঁষাঘেষি, গায়ে গায়ে অতি নিকটে রয়েছে৷ এই স্তরটাকে শাস্ত্রে বলে সাযুজ্য৷ আর মন যখন অনাহত  পূর্ণভাবে কেন্দ্রীভূত হয়ে যায় ও কুলকুন্ডলিনী অনাহত চক্র পর্য্যন্ত উঠে আসে তখন সাধক শুণতে পায় সমুদ্রের গর্জনধবনি৷ এই অবস্থায় সাধক অনুভব করে যে  শুধু কাছেই নয় যখনই তাঁর ভাবনা নিচ্ছে তখন সবকিছুতেই পরমপুরুষের রূপ দেখছে৷ এ অবস্থাটাকে শাস্ত্রে বলা হয় সারূপ্য৷ এরপর মন যখন বিশুদ্ধচক্রে একাগ্র হয়ে পড়ে আর কুলকুন্ডলিনী বিশুদ্ধ চক্রে উঠে আসে সাধক ওঁ-কার ধবনি শুণে আর সাধক তখন পরমপুরুষকে সব রকমভাবে পাচ্ছে, সবরকম ভাবে দেখছে, ও তার সঙ্গে মিলে এক হয়ে যাচ্ছে৷  আমি রয়েছি তিনি রয়েছেন এই ভাবটুকু  থাকে৷  আবার তার সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে৷--- এই অবস্থাটাকে হয় সার্ষ্ট্রি৷  এখানে ক্ষীণ আমি ভাব থাকছে৷ এরপর আসে সাধকের কৈবল্যস্থিতি৷  এর ভাব হলো কেবল  তুুমি-ই  আছ৷ এই স্তরটা হলে মানব জীবনের চরম অবস্থা৷ আধ্যাত্মিক সাধনার এই হলো ছয়টা ক্রম৷

এখন সাধনায় মূূল পাঠ হলো ধ্যানক্রিয়া৷ ধ্যান করতে হলে ভাবনা নিতে হবে যে পরমপুরুষ আমাকে দেখছেন আর প্রার্থনা করতে হবে যে হে পরমপুরুষ তুমি আমার কাছে আবিভূত হও যাতে আমি আমার মানস ইন্দ্রিয়ের দ্বারা দেখতে পাই৷  এরপর আমি আমার মানস ইন্দ্রিয়গুলোর দ্বারা তোমার সেবা করতে চাই৷ আমি তোমার সুমধুর মুরলীধবনি যেন শুণতে পাই, যেন তোমার দিব্যজ্যোতিতে আমার মানস-চক্ষু ভরপুর হয়ে ওঠে৷ এইভাবে সাধকের মানস ইন্দ্রিয়গুলিকে পরমপুরুষের ভাবনায় নিযুক্ত করে নিতে হবে৷ আর তাঁকে পাবার জন্যে গভীর থেকে গভীর আকুতি জাগাতে হবে৷ এরফলে তাতে সাধক মিলেমিশে এক হয়ে যাবে৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন---‘‘কবে আমি বাহির হলুম সে তো আজকে নয়’’ অর্র্থৎ এই সৃষ্টি চক্রের ঘুরপাকে অনাদি অনন্তকাল ধরে ঘুরে চলেছি৷  তার পরিসমাপ্তিতে চরম প্রাপ্তি ওইভাবে হবে৷ ধ্যানক্রিয়া শিখে ধ্যান অভ্যাস করলে পরমপুরুষের সেবা করার আকুতি জাগবে৷ এইভাবে সাধনার ফলে তার প্রতি প্রবল আকুতি জাগবে৷ তখন তিনি বুঝে নেবেন যে, এ তো আমাকে ছাড়া আর কিছু চাইছে না৷ তখন তিনি আমাকে তার কোলে তুলে নেবেন---এইটাই মানব জীবনের গৌরবাম্বিত ও স্বর্ণিম মুহূর্ত্ত ও স্তর৷ এইটাই মানব জীবনের মূলকথা৷