ধর্মের নামে ধর্মমতের উদ্বাহু নৃত্য বন্ধ হোক

লেখক
সুকুমার সরকার

ধর্ম(Dharma) আর ধর্মমত (Religion) এক না হলেও এখনো পর্যন্ত সমাজ, রাষ্ট্রের হোতারা ধর্মমতকেই ধর্ম বলে চালিয়ে যাচ্ছেন৷ আর ধর্মের নামে ধর্মমতকে নিয়েই রাজনীতি করছেন৷ যদিও তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা বলছেন, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি নয় তথাপি ভারতবর্ষের রাজনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ধর্মের নামেই৷ কোথাও প্রত্যক্ষভাবে কোথাও পরোক্ষভাবে৷ আর সমস্যার বীজ রোপিত হচ্ছে সেখানেই৷ যে বীজ উপযুক্ত পরিবেশ পরিস্থিতি পেলে মহীরুহে পরিণত হয়ে সমাজরাষ্ট্রের কাঠামোতে ফাটল ধরিয়ে দিচ্ছে৷ ধবংস করছে সমাজ-সৌধের দৃঢ় ভিত্তিটাকে৷

ইদানিং পশ্চিমবঙ্গসহ সমগ্র ভরতবর্ষে সমাজ রাজনীতিতে এমনি নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্মমত ও ধর্মমতের সমর্থকদের দ্বারা পালিত প্রথা-পদ্ধতি, আচার-আচরণ৷ যা অনেকাংশেই যুক্তি তর্কের ধার ধারে না৷ যার মূল ভিত্তি অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কার৷ যার গতি পিছনের দিকে৷ যা দেখে চিন্তিত প্রগতিবাদীরা, স্তম্ভিত প্রকৃত ধার্মিক মানুষেরা৷

আমরা জানি সত্তাগত বৈশিষ্ট্যে (Self characteristics) সকল মানুষের ধর্ম এক হলেও অতীতে স্থান কাল পাত্রে সীমাবদ্ধতার কারণে মানুষের সমাজে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন ধর্মমতের৷ ভৌম চরিত্রগত ভিন্নতার কারণে, বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে, অনেকক্ষেত্রে ব্যষ্টি বিশেষের প্রাধান্যের কারণে প্রতিটি ধর্মমতের প্রথা পদ্ধতি আলাদা, বিশ্বাস, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক আলাদা৷ শুধু আলাদা নয় , পরস্পর বিরোধী৷ আর এই বিরুদ্ধ মানসিকতার কারণেই যুগ যুগ ধরে ঘটে চলেছে নানান ক্রুসেড৷ আর ধর্মের নামে এইসব বিরুদ্ধ আচার-আচরণ, প্রথা-পদ্ধতি---সর্বস্ব ধর্মমতগুলোকেই মদত দিয়ে চলেছে শাসক ও শোষকেরা৷ আর সেই মদতেই উদ্বাহু নৃত্যে পালিত হচ্ছে রামনবমীর ‘রামদা’র মিছিল ! মহরমে তলোয়ারের মিছিল!

এতদিন শুধু মহরমের মিছিলই বেরোতো৷ এখন রামদার মিছিল৷ কেউ কি ভেবে দেখেছেন দুয়ের সামনা, সামনি হলে কি হবে? --- আরেকটা বিষাদ সিন্ধু তৈরী হবে না!

না, আমরা কোন বিষাদ সিন্ধু চাই না৷ কিন্তু চাই না বলে বালির ঝড়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকলে কি ঝড় থামবে? আগেই বলেছি ধর্মমতগুলি পরিচালিত হয় পরস্পর বিরোধী মানসিকতার দ্বারা৷ সেখানে একে তাজিয়ার মিছিল করলে অন্যে রামদার মিছিল করবেই৷ বিশেষ করে ৪৭ পরবর্তী ভারতবর্ষের বৃহত্তর হিন্দু ধর্মমতের সমর্থকরা তো ইসলাম ধর্মমতের প্রতি বেশী তোষামোদ দেখলে আরোও বেশী ক্ষুদ্ধ হবে৷ সংখ্যালঘুর নামে ইসলাম ধর্মমতের মানুষদের যে বাড়তি সুযোগ দেওয়া হচ্ছে আর সেই সুযোগের অপব্যবহার করে ইসলাম ধর্মমতের একাংশ যেভাবে ভারতবর্ষে জঙ্গী কার্যকলাপ চালাচ্ছে, বৃহত্তর হিন্দু ধর্মমতের মানুষেরা তাতে বেশ ক্ষুদ্ধ৷ আর রাজনীতির ধর্ম ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে তৎপর৷ কি সরকার পক্ষের, কি বিরোধী পক্ষের সকলেই ৷ উদ্দেশ্য কিন্তু ধর্মমতের সাধারণ মানুষের আর্থ সামজিক উন্নতি নয়৷ উদ্দেশ্য বোট বাক্সে সমর্থন আদায়৷ সাধারণ মানুষের আর্থ-সামজিক উন্নতি হলে তো ক্ষেতি-জমিতে কাজ থাকবে৷ পরস্পর মিলে মিশে আনন্দ উৎসব করবে৷ বিরোধ করার সময় পাবে কোথায়? নেতারা সেটা চান না৷ কেননা বিরোধ না থাকলে রাজনীতির নামে শোষণ চলবে কি করে?

অতএব ধর্মের নামে ধর্মমতের বিরোধ জিয়িয়ে রাখতেই হবে৷ বর্তমান রাজনীতিতে এ এক ভীষণ মারাত্মক খেলা চলছে৷ আর এই খেলার ময়দানে কেউ হিজাবে মুখ ঢাকছে তো কেউ হনুমানে মুখ পোড়াচ্ছে৷

রাজনীতিতে এতদিন ছিল সংখ্যালঘু তোষণ৷ কারণ এতদিন সংখ্যালঘুরা এককাট্টা ছিল৷ তাদের ধর্মনেতারা বোটের ভয় দেখাতো৷ এখন সংখ্যা গুরুরা এককাট্টা হতে শুরু করেছে৷ তাদের একক বোটেই বাজিমাত হছে৷ এতে অনেক নেতাই এখন হিজাব ছেড়ে হনুমানের দ্বারস্থ হতে শুরু করেছে৷ ফলে রাজনীতির খেলার ময়দান আরও জমজমাট৷ আরও আশঙ্কার মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে৷ কেন না ভারতবর্ষ কোনদিনই একক ধর্মমতের দেশ ছিল না৷ এখনও নেই৷ ভারতবর্ষের ঐতিহ্য হচ্ছে বহুত্বের মধ্যে মিলনসংস্কৃতি৷ ভারতবর্ষের এই বহুত্ববাদী মিলন সংস্কৃতিকে সমন্বয়ের পথে পরিচালিত না করে যে নেতা-নেত্রীরা বিরোধের রঙ চড়াচ্ছেন সংখ্যালঘু তোষণের নামে, সংখ্যাগুরু তোষণের নামে, আজকের রাম-রহিমের বিরোধ সৃষ্টি তাদেরই কীর্তি৷ এদের ছক্কা পাঞ্জায় আমরা যারা হাততালি দিয়ে পক্ষে বিপক্ষে বুলবুলির লড়াই করছি তাঁদেরও সতর্ক হওয়ার দিন এসেছে৷ কেননা এই মারাত্মক খেলা আত্মঘাতীর নামাম্তর৷

অতএব এই খেলা এখনই বন্ধ করা হোক৷ ধর্মের নামে ধর্মমতের বাড়বাড়ন্ত ঠেকানো হোক৷ যে বাড়বাড়ন্তকে মদত দিয়ে চলেছে শাসক, শোষক ও শোষকের প্রচারযন্ত্রগুলি৷ সর্বনাশের মূল শিকড় এখানেই রোপিত৷ তাবিজ কবজ বিক্রি করতে, এরাই সর্প হইয়া দংশন করছে, এরাই ওঝা হয়ে ঝাড়ছে৷ আর আমরা বেহুলা হয়ে লখিন্দরের লাশ বহন করে চলেছি উজান পথে৷

কিন্তু আর কতদিন?

এবার অন্তত মানুষের সমাজ-রাষ্ট্র পরিচালিত হোক প্রকৃত ধার্মিক মানুষের হাত ধরে৷ তার জন্য ধর্ম ধর্মমতের পার্থক্য আর মানুষকে জানানো হোক৷ ধর্মমতগুলির ঊধের্ব উঠে নোতুন প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের সহায়তা নেওয়া হোক৷ মানুষ প্রকৃত ধর্ম ও ধর্মমতের পার্থক্য ভাল ভাবে বুঝতে পারলে আর হয়তো ধর্মমতের বাড়াবাড়িতে উৎসাহিত হবে না৷ আমার মনে হয়, হয়তো তখনই ধর্মের নামে ধর্মমতের নগ্ণ নৃত্য বন্ধ হবে তার আগে কখনই নয়৷