এন আর সি--- রাষ্ট্রের মানবিক হওয়া উচিত

লেখক
প্রভাত খাঁ

গত ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চের  আগে অসমে যাঁরা ভারতীয়  ছিলেন সেই ৩কোটি  ৩০ লক্ষ মানুষকে প্রমান দিতে হয়েছে৷ এই এন.আর.সি খসড়ায় ৪১ লক্ষ মানুষ  বাদ গেছে৷  গত ৩১ শে আগষ্ট তাঁদের  তালিকা  প্রকাশিত হয়েছে৷ এতে সারা অসমে  জনগণের  মধ্যে এক চরম আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে৷ চুড়ান্ত তালিকায় যাদের  নাম বাদ যাবে ---কেন্দ্রীয়  স্বরাষ্ট্র দফতর গত ২০শে আগষ্ট এক বিজ্ঞপ্তিতে ট্রাইব্যুনালে আবেদন করার মেয়াদ ১২০ দিন বাড়িয়েছে৷ জানানো হয়েছে এন.আর.সিতে নাম না থাকলেই তারা বিদেশী নয়, এই বিজ্ঞপ্তিতে অবশ্য মানুষের আতঙ্ক সামান্য পরিমাণেও কাটেনি৷ ২০১৮ সালের জুলাই মাসে  প্রকাশিত খসড়ার পরিপ্রেক্ষিতে অসমের রাজনৈতিক দলগুলির আশঙ্কা ছিল যে এন.আর.সি.-র যাঁতাকলে প্রকৃত ভারতীয়দের মধ্যে অনেকেই বিদেশী হয়ে যাবেন আবার অনেক অনুপ্রবেশকারী ভারতীয় নাগরিকের তক্মা পেতে পারেন৷

সরকারের কাছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল গত ২০১৩ সালে নাগরিকপঞ্জী সংশোধন করার৷ তারই  পরিপ্রেক্ষিতেই এই এন.আর.সি-র খসড়া, যা অনেক ভারতীয় বিশেষ করে বহু বাঙালীর কাছে মারণফাঁদ৷

১৯৭১ সাল আজ ২০১৯ সালের আগষ্ট মাস৷ সুপ্রিমকোর্ট ২০১৩ সালে নাগরিকপঞ্জী সংশোধন করতে বলেন৷ এরমধ্যে ৪১ লক্ষ মানুষ প্রধানত বাঙালী হিন্দু ও মুসলমান৷ এখন  ২০১৯---১৯৭১ সালে ৪৮ বছর৷ অন্যদিকে  ১৯৭১ ও ২০১৩ সুপ্রিম কোর্টের আদেশ ১৯৭১  থেকে ২০১৩অর্থাৎ ৪২ বছর৷

যে সব হিন্দু ও মুসলমান নারীপুরুষ ঐ সময় থেকে জন্মেছে তাদের বয়স হয়েছে ৪৮ থেকে ৪২ বছর৷ তাছাড়া ২০১৩ থেকে ২০১৯ এই ৬ বছরে যে সব  হতভাগ্য শিশু  জন্মগ্রহণ করেছে তারা নিশ্চয়ই এই হিসাবের মধ্যে আসেনি, কারণ তারা ভারত য়ুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নয়৷

নির্দ্দেশ নামা হয়েছে ৪২ বছর পর৷  এদের মধ্যে ৪২ বছরের ও তার অধিক বয়সের লোকেরাই এই তালিকায় পড়েছে৷ গণতান্ত্রিক (?) রাষ্ট্রে যদি অবিভক্ত ভারতবর্ষের নরনারীদের নিয়ে বর্ত্তমান বাংলাদেশ ও ভারত যুক্তরাষ্ট্র যে অমানবিক ঘটনা ঘটাচ্ছে সেটা দু’দেশের মধ্যে কী  একটা তিক্ততা সৃষ্টি হচ্ছে না? আর অতি সাধারণ দুঃখী মানুষের মনে চরম আতঙ্ক ও মানসিক যন্ত্রনার সৃষ্টি হচ্ছে৷ বাংলাদেশ কোনদিনই  স্বীকার করবে না যে তাদের দেশত্যাগীরা ভারতে এসেছে৷ তাছাড়া প্রাণের দায়ে যারা  বাঁচার তাগিদে এসেছে তারাতো রিক্ত হাতে এসেছে! তারা তো উদ্বাস্তু হিসাবে এসেছে৷ তাদের কাছে এরা আজ নথিপত্র চাইছে! এটা যে মানবতার অবমূল্যায়ণ সেটা কী বোঝার  শক্তি  এদেশের  শাসকদের  কী  মাননীয় সুপ্রিম অথরিটির আছে?

এটা অত্যন্ত লজ্জার বিষয় বাঙালীদের নিয়ে ভারত সরকার যা করছে৷ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সরকারের মান মর্য্যাদা রক্ষা হচ্ছে বলে মনে হয় না৷ এতোদিন পরে এমন একটা অমানবিক নিয়ম চালু করাটা গণতন্ত্রের পক্ষে কলঙ্ক!

‘শুনহে মানুষ ভাই---

সবার ওপরে মানুষ সত্য---

তাহার ওপরে নাই৷

কবি চন্ডীদাসের এই মহামূল্যবান উক্তিটি বড়ই সত্য৷  ভারতবর্ষ পৃথিবীর মানুষকে চিরকালই আদর্শের পথ দেখিয়ে এসেছে৷ বর্তমানে অত্যন্ত দুঃখের কথা যে অনেক নেতানেত্রী স্মরণেই রাখেন না৷ ছিট মহল বিনিময়ে বহুভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশকে  দেওয়া হয়৷ যেখানে অনেক স্থানেই হিন্দু শূন্য ছিল দীর্ঘ বছর পর৷ তাদের বিতাড়ণ করা হয়৷ তারা সবাই  প্রাণের দায়ে ভারতে যে আশ্রয় নেয় সেটাই অপ্রিয় সত্যকথা৷ তাদের জমিজমা সবটাই চলে যায় ও দেশের মুসলীম ভাইয়েদের হাতে৷ হিন্দু (শত্রু) সম্পত্তি বিনিময়ের যে আইন হয় সেটা সরকারী নির্দ্দেশ থাকলেও  বাস্তবে সরকারী কর্মচারীদের কারচুপীতে বাস্তবায়িত হয়নি৷ এটাই অপ্রিয় সত্য কথা৷ দেশ ভাগ মিঃ জিন্না  ও মিঃ জহরলালের ইচ্ছা ও গান্ধীর মৌন সম্মতিতে  ইংরেজদের  ষড়যন্ত্রের ফল৷ কিন্তু তার পরিণতি আজ ভোগ করতে হচ্ছে বাঙালীদের৷ দেশভাগ যে কতবড় সর্বনাশ বাঙালীরা আজ মর্মে মর্মে টের পাচ্ছে৷

শেষ সংবাদে  অসমে  নাগরিকপঞ্জীর বিষয়ে জানা যায় যে ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জনের নাম বাদ পড়েছে৷ তাঁরা ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারবেন৷ কিন্তু এই সমস্যা কি সমাধান হবে? নথিপত্রের অভাবে  যে সব নাগরিক প্রমান দিতে পারবে না তারা যাবে কোথায়?৷ রাষ্ট্র সংঘের শরণার্থী বিষয়ক আধিকারিক ফিলিপ্ল গ্যাণ্ডি ভারতকে আবেদন করেছে কেউ যেন নাগরিকত্বহীন না হয়৷

যারা আতঙ্কের মধ্যে কাল কাটাচ্ছে তাদের কথা সারা ভারত তথা এই পৃথিবীর সব সরকারকে ভাবতে হবে কারণ  সবাই এই গ্রহেরই অধিবাসী৷ নিছক মাইনরিটি অসমিয়াদের বোটের  স্বার্থে ভারতীয়দের বিতাড়ণের নক্কারজনক ষড়যন্ত্রকে  আমরা ধিক্কার জানাই৷

অসমের হতভাগ্য জনগণ যারা এন.আর.সির  রাজনৈতিক শিকার হয়েছে  তাদের হয়ে কী কেউ  বলার নেই৷ এই রাজ্যের  জনগণকে  তো তাদের  হয়ে সচেতন হতে হবে৷ কলকাতার শিক্ষিত মহল নীরব কেন? সাংবাদিকরা তাদের পাশে দাঁড়ান ৷ মুখ্যমন্ত্রী কিছু বলছেন মাত্র৷ আর দু’একটি  সংঘটন মতামত দান করছে৷

তবে প্রথম থেকে  বাঙালী সমাজের  ‘আমরা বাঙালী সংস্থা অসমের  এন.আর.সি নিয়ে যে অসমরাজ্য সরকার কুৎসিত দলীয়  স্বার্থসিদ্ধির  খেলা খেলছে  তার বিরুদ্ধে  প্রতিবাদ  করে চলেছে---যেটা আশার কথা৷

আবার বলি মিঃ ফিলিপ্পো গ্যাণ্ডির ভারত সরকারকে  আবেদনটি নিশ্চয়ই  বিফলে যাবে না৷  গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত সরকারের আচরণ যেন দেশের  মর্য্যাদাকে  উঁচুতে ধরার চেষ্টা করেন৷ মানবিক মূল্যবোধ যেন রক্ষা পায়৷