জাতির নামে বজ্জাতি

লেখক
একর্ষি

পূর্ব প্রকাশিতের পর,

ধর্ম ও রিলিজনের বা ধর্মমতের মধ্যে পার্থক্যগুলো দেখলেই  তা পরিষ্কার হবে৷ যথা- ‘ধর্ম’ একটা সংস্কৃত তথা বাংলা তৎসম শব্দ৷ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত, তাৎপর্যগত ও প্রয়োগগত অর্থ হচ্ছে সত্তাগত বৈশিষ্ট্য বা গুণ--- যা কোন সত্তার অস্তিত্ব বজায় রাখে বা সত্তাটিকে ধরে রাখে বা ধারণ করে থাকে৷  ইংরেজিতে একে বলে ‘প্রপার্টি’, একে নেচারও  বলা যায়৷ যেমন আগুনের দহন করার ক্ষমতা, জলের নীচের দিকে গড়িয়ে যাওয়া ইত্যাদি৷ সেইরকম মানুষের ধর্ম হল বৃহতের প্রতি এষণা, অনন্ত হয়ে ওঠা বা অনন্তভাবে চাওয়া৷ অর্থাৎ মানুষ যা চায়, তা অনন্ত ভাবে চায়৷ এটাই মানুষের ধর্ম৷ তবে  ‘ধর্মে’র কোন যথার্থ ইংরেজী প্রতিশব্দ নেই, যদিও ইংরেজী ‘রিলিজন’ কে বাংলা  ‘ধর্মে’র প্রতিশব্দ ধরা হয়....যা মোটেই ঠিক নয়৷ কারণ ‘রিলিজন’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ‘রিলিজিও’ থেকে --- যার মানে গডস্‌ ফিয়ার, ঈশ্বর ভীতি, এর সঙ্গে  ইংরেজি আয়ন্‌ প্রত্যয় যুক্ত করে হয়েছে ‘রিলিজন্‌’৷ কাজেই ধর্ম ও রিলিজন শব্দ দুটো একে অন্যের থেকে আলাদা৷

অন্যদিকে রিলিজন্‌ কতগুলো রিচ্যুয়্যাল্‌স্‌- --(আচার-অনুষ্ঠান)৷ রিচ্যুয়্যালস্‌ ও  এসেছে ল্যাটিন শব্দ রিচ্যুজ্‌, রিচ্যুয়ালিস্‌ থেকে (রিচূ্যজ্‌  রিচূ্যয়্যালিস্‌ রিচূয়্যাল্‌স)--- যার  মানে ধর্মগত শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠান৷ তাই বুৎপত্তিগত, তাৎপর্যগতও প্রয়োগগত দিক  থেকে পূজা-অর্চনায় আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্বতাই রিলিজন৷ তাই এর উপযুক্ত বাংলা পরিভাষা ধর্মমত, বা আরবিজাত ‘মজহব’৷ কেননা রিচ্যুয়্যাল্‌স্‌ দেশ,কাল, ব্যষ্টি-গোষ্ঠী, অঞ্চল ভেদে পার্থক্য কৌম স্বভাবে পার্থক্য হয়ে থাকে, এর কোন সর্বান্যুসূত শাশ্বত রূপ থাকে না৷  পৃথিবীর প্রচলিত তথাকথিত ধর্মগুলোর ব্যাপার-স্যাপার এই রকমই৷ ধর্মমতই এই ভাবের উপযুক্ত প্রতিরূপ৷ বাস্তবটা হল রিচূ্যয়ালস্‌গুলোর প্রবর্ত্তক ও প্রচারক হলেন কিছু ধর্মগুরু৷ তাঁদের   ঈশ্বর সংক্রান্ত বাণী, উপদেশ, রচিত শাস্ত্র, নির্দেশিত আচার অনুষ্ঠান অনুসারে ও তাঁদেরই নাম বা ভাব অনুসারে ধর্মমতগুলোর নামকরণ হয়েছে৷ এইভাবেই উদ্ভব হয়েছে বৌদ্ধধর্মমত, খ্রীষ্টধর্মমত, ইসলাম ধর্মমত ইত্যাদি৷

২) ধর্ম সব যুগের সব মানুষের ক্ষেত্রে সমান, সর্বাদিসম্মত৷  অন্যদিকে রিলজ্‌ন বা ধর্মমত এক একটা গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় অনুসরণ করে চলে৷ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাম্প্রদায়িকতাকেই প্রশ্রয় দেয়৷ আসলে রিলিজন্‌ কেন্দ্রিক গোষ্ঠীভাবের নামই সাম্প্রদায়িকতা৷ এ এমন বিশ্বাস যা সূর্যের উদয়-বিলয় এর মত সর্বাদিসম্মত নয়৷ বিপদ-আপদের, যন্ত্রণার, দুশ্চিন্তার, আতঙ্কের বা দুর্র্ভগ্যের বিষয় হচ্ছে প্রতিটি রিলিজনই সৌভ্রাতৃত্বের বাণীর প্রচার করেছে, কিন্তু এই সৌভ্রাত্ব সীমিত করে রেখেছে নিজেদেরই সম্প্রদায়ের মধ্যে৷ এই সৌভ্রাত্রের  বাণীর ঠেলায় মধ্যযুগীয় পৃথিবীতে যত রক্তপাত ঘটেছে তাদের অধিকাংশই সাম্প্রদায়িক সৌভ্রাত্রের  স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবেই সংঘটিত  হয়েছে৷ কেবল মধ্যযুগ কেন, সুপ্রাচীন পৃথিবীতেও বার বার তথাকথিত ধার্মিকেরা ধর্মের মোড়কে অজ্ঞ, সরল মানুষকে আলোক (?) দানের নামে অনেক ক্ষেত্রেই একটা বিপর্যয় ঘটিয়েছে৷ নির্মম সত্যটা হল--- এই ধর্মমত-রিলিজন্‌ জিনিষটা মানুষের আধ্যাত্মিক মুক্তি বা প্রগতি তো দূরের কথা, স্থূল জাগতিক স্বাচ্ছন্দ বিধানেও নিজেদের অযোগ্যতা-অপদার্থতা প্রতিপদে প্রমাণ করে এসেছে, আর তা তা ঢাকতে   সুবিধাভোগের চূড়াটা ধরে রাখতে ---ধর্ম বিপন্ন বলে জিগির তুলে নিরীহ-অজ্ঞ-সরল মানুষকে  সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পথে ঠেলে দিয়েছে৷ মজা লুটেছে ধর্মের ধবজাধারীরা, রক্ত ঝরেছে, প্রাণ কেড়েছে নিরপরাধ সাধারণ মানুষের৷ মানুষের সত্যিকারের ভালবাসা না রেখে, কেবল কোন ক্ষুদ্র জাগতিক উদ্দেশ্য-পূর্তির নিমিত্ত রিলিজনের এই সকল ধবজাধারীরা অর্থবল,বুদ্ধিবল, অস্ত্রবল কোনটাই প্রয়োগ করতে বাদ রাখেনি, কসুর করেনি৷

৩) ধর্ম হল ভিতরের জিনিস, সর্ব সত্তায় ব্যাপ্ত হয়ে থাকে তিলে যেমন তেল থাকে, দুধে যেমন ঘি থাকে তেমনি এক সত্তাগত বৈশিষ্ট্য৷ অন্যদিকে ধর্মমত পোশাকের মত  বাইরের জিনিস৷ তাই ধর্মমত বা রিলিজন্‌ যেখানে সংখ্যায় অনেক, ধর্ম সেখানে মাত্র একটি মানুষের অসীমকে পাওয়ার এষণা৷

৪) ধর্ম পালটানো যায় না, অপরিবর্তনীয় পালটাতে পারলে  তার অস্তিত্বই থাকে না৷ অন্যদিকে ধর্মমত মুহূর্তে মুহূর্তে পালটানো যায়৷ কেউ ইচ্ছা করলে সকালে বৌদ্ধ, দুপুরে শিখ, বিকালে  মুসলমান, সন্ধ্যায় জৈন আবার রাতে অন্যধর্মে যেতে পারে৷ দুধ কী  তার শ্বেতত্ব পালটাতে পারে? বেড়াল বাঘ হতে পারে?

৫) ধর্মসাধনার জন্যে বাহ্যিক কোন বস্তুর প্রয়োজন নেই৷ সাধনার জন্যে কেবল প্রয়োজন অণুমানস সত্তার৷ অন্যদিকে রিলিজন্‌ বা ধর্মমত আচার-উপাচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব৷

৬) ধর্মের পূজারীর দৃষ্টিভঙ্গী হয় সংশ্লেষাত্মক-বহুর মধ্যে  এক কে দেখে, সর্বং খলিদং ব্রহ্ম, জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে, সে জাতির নাম মানুষ জাতি৷ অর্থাৎ দেশ কালও পাত্রের অতীত বলে এতে স্বজাতীয়, বিজাতীয় ও স্বগত ভেদ নেই৷ ধর্ম যুগে  যুগে মানুষকে ঐক্যসুত্রে আবদ্ধ করার বাণী প্রচার করেছে৷ অপরদিকে ধর্মমতাবলম্বীর দৃষ্টিভঙ্গী বিশ্লেষণাত্মক মানুষ কে দেখতে পায়না, দেখে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ইত্যাদি৷ শুধু তাই নয়, প্রতিটি মানুষকে একই অখণ্ড মানব সমাজের অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করতে প্রতি পদ-বিক্ষেপে নিষেধ করেছে, আর এই নিষেধাজ্ঞার সমর্থনে হাজির করেছে অজস্র যুক্তিহীন নজির, অজস্র বস্তাপচা পুঁথির ছেঁড়াপাতা৷ আসলে ধর্মমত /রিলিজন মানুষের মনকে  স্থাণুত্বে পর্যবসিত করে রাখতে চায়৷ --- কারণ যা থেমে থাকে শোষিতের শোষণযন্ত্র তাকেই সহজে কায়দার মধ্যে এনে ফেলতে পারে৷ অথচ এই স্থিতিশীলতা মানসধর্মের বিরোধী৷

৭) ধর্ম মানুষকে পরস্পর অকৃত্রিম আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ করে,  সমভাবাপন্ন করে৷ কারণ প্রেম, স্বতন্ত্রতা ও সমতা এর ভিত্তি৷ --- পক্ষান্তরে ধর্মমত মানুষের মনে হীনমন্যতা মহামান্যতার বীজ বপন করে, পরধর্মবিদ্বেষী করে, এমন কী অন্যের ধর্মমতকে  ধবংস করটাকে নিজের ধর্মপালনের অঙ্গ ভাবতে শেখায়--- যার ফলশ্রুতিতে মূর্ত্তি মন্দির ধবংস, রক্তপাত মাঝে মাঝেই ঘটে৷

৮) ধর্ম মানুষকে ধর্মসাধনার আবশ্যিক অঙ্গ হিসেবে জগতের কল্যাণে বৃহত্তর স্বার্থে আত্ম নিবেদনে উদ্বুদ্ধ করে৷ ধর্মের ভাবাদর্শে মনুষ্য জীবনের সার্থকতা--- বহির্জগতের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করতে করতে পূর্ণতার পথে চলা৷ তাই মানুষ হয় বাস্তববাদী বিজ্ঞানমনস্ক৷ কেননা ধর্ম বৈবহারিক জ্ঞান ও যুক্তিসিদ্ধ বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত৷ এত রয়েছে পারমার্থিক সত্যোপলব্ধির যুক্তিসংগত প্রচেষ্টা৷ কিন্তু, পক্ষান্তরে, ধর্মমত মানুষকে বাস্তব-বিমুখ ভাববাদী করে, অথচ যত আসক্তি লোভ লালসা পার্থিব বস্তুতেই তাই মানুষ আত্মকেন্দ্রিকতার, ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊধের্ব উঠতে পারে না৷ ফলে মানুষকে অন্ধবিশ্বাসের ফাঁদে ফেলে শোষণের জাল পাতে৷ শুধু সেখানেই সমর্থন যেখানে স্বার্থসিদ্ধির ধান্দা আর দলাদলি৷