কৈবর্ত বিদ্রোহ ঃ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সুসংগঠিত গণবিদ্রোহ

লেখক
সুকুমার সরকার

র্বপ্রকাশিতের পর,

(৯)  সমাজ-সংস্কৃতির এই সূত্র থেকেই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তুলে আনলেন সেই যুগের এই কৈবর্ত বিদ্রোহের মিসিংলিঙ্ক  ইতিহাসের অংশটুকু৷ কৈবর্ত বিদ্রোহের বিস্মৃত ইতিহাসের ধূম্রজাল থেকে  বেরিয়ে আসার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট ছিল৷ কেননা, ঐতিহাসিকমদের মতে ভীম বা দিবেবাক যদি উচ্চ রাজ আমর্ত্য হয়ে থাকেন, তবে রাজ অন্তপুরের এই সমর্থন ছাড়া এমন বিদ্রোহ করা সম্ভব ছিল না৷ অন্তত সেই যুগে৷ যখন সাধারণ মানুষের মধ্যে গণচেতনার কোনো উন্মেষই ঘটেনি৷

মিসিংলিঙ্ক ইতিহাসের এই অংশে দ্বিতীয় দেবপালের ধর্মপত্নী হিসেবে আনন্দমূর্ত্তিজী লজ্জাদেবীর নাম উল্লেখ করেছেন৷ কিন্তু অন্য ঐতিহাসিকরা লজ্জাদেবীকে প্রথম বিগ্রহ পালের স্ত্রী হিসেবে দেখিয়েছেন৷ এটা তাঁদের অনুমান৷ কেননা, প্রথম বিগ্রহপালের পক্ষে কোনো শিলালেখ আবিষ্কারের নির্দশন নেই৷ তাছাড়া রাজমহিষী হিসেবে একাধিক লজ্জাদেবীর নাম থাকতেই পারে৷ আর একটি কথা উল্লেখ করতেই হয়, তা হলো ঐতিহাসিকদের অনেকে দিবেবাক পরবর্তী কৈবর্ত রাজা হিসেবে দেখিয়েছেন ভীমকে৷ ঐতিহাসিকদের উল্লেখে আছে, প্রথম কৈবর্ত রাজা দিবেবাক৷ দিবেবাকের পুত্র রুদ্রোক৷ রুদ্রোকের পুত্র ভীম৷ তাঁদের এই দেখানোর পিছনে সূত্র বা যুক্তি হয়তো পরবর্তীকালে ভীমের নামে বেশকিছু কীর্তিস্তম্ভ বা কীর্তিগাথা দেখে৷ কিন্তু এমনও তো হতে পারে, কৈবর্ত বিদ্রোহের প্রধান নেতৃত্ব ছিল ভীমের হাতেই৷ যুদ্ধে তিনি নিহত হলে তাঁর ভাতুস্পুত্র দিবেবাক সেই নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ও রাজা হয়ে কৃতজ্ঞতা বশত পিতৃব্য ভীমের নামে সেইসব কীর্তিস্তম্ভ বা কীর্তিগাথা নির্মাণ করেন৷ অন্তত রমেশচন্দ্র মজুমদারের কথায়,  ‘‘অসম্ভব নহে যে, দিব্য প্রথমে মহীপালের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগদান করেন নাই, কিন্তু বিদ্রোহীদের হস্তে পরাজয়ের পর মহীপালকে হত্যা করিয়া তিনি বরেন্দ্রী অধিকার করিয়াছিলেন’’---এই উক্তি থেকে প্রমাণিত হয়৷ অর্থাৎ পাল রাজার সঙ্গে বিদ্রোহের নেতৃত্ব প্রথমে ভীম ছিলেন৷ ভীম যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হলে রাণী লজ্জাদেবী দিবেবাককে সেই দায়িত্বে ন্যস্ত করেন৷

তাছাড়া কৈবর্ত বিদ্রোহের ফলে বরেন্দ্র পাল রাজ্যের অবসানের পিছনে এই যে রাজ অন্তঃপুরবাসিনী রাণী লজ্জাদেবীর হস্তক্ষেপের কথা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী স্পষ্টতঃ বললেন রমেশচন্দ্র মজুমদারের কথাতেও তার সমর্থন মেলে৷ রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘‘রামপালের জীবন ও মৃত্যু উভয়ই বিচিত্র৷’’ তাঁহার কাহিনী ইতিহাস অপেক্ষা উপন্যাসেরই  অধিক উপযোগী৷ জীবনের প্রারম্ভে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার অমূলক সন্দেহের ফলে যখন কারাগারে শৃঙ্খলিত অবস্থায় নিদারুণ শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করিতেছিলেন, তখন অন্তর্বিপ্লবের ফলে বরেন্দ্রে পালরাজ্যের অবসান হইল৷ সেই  ঘোর দুযোর্গের দিনে অসহায় বন্দী রামপাল কিরূপে জীবন রক্ষা করিয়াছিলেন, ইতিহাস তাহার কোনো সন্ধান রাখে না৷’’

ইতিহাস অনেক কিছুরই সন্ধান রাখেনি৷ রাখলে ভারতবর্ষের ইতিহাস ভিন্নভাবে রচিত হতো৷ রাজ অন্তঃপুরের অন্তর্বিদ্রোহের খোঁজটা অন্তত করলে ইতিহাসকে ইতিকথার দ্বারে কড়া নাড়তে হতো না৷ কিন্তু আমরা ইতিহাসের খোঁজ করি না৷ আমরা শুধু ইতিকথার চর্বিত চর্বণ করি৷ ইতিহাসের উজ্জ্বল আলোর রেখায় ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করতে এগিয়ে আসি না৷ নইলে বাঙালি জাতির আদি কৈবর্ত ইতিহাস ভুলে বিভাজিত বিচ্ছিন্ন হবার পাঁয়তারা করতাম না৷

কৈবর্ত বিদ্রোহ শুধু বাঙলা ও বাঙালির নয় পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সুসংগঠিত গণবিদ্রোহ৷ জাত বাঙালির গর্বিত ইতিহাস৷ এই ইতিহাস বিস্মৃত হলে যেমন চলবে না, তেমনি এর প্রকৃত ঐতিহাসিক দিকগুলিকেও ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করতে হবে৷ ইতিকথার নিরস মসী অন্ধকারে নয়, ইতিহাসের উজ্জ্বল আলোয় সত্যকে বিধৃত করতে হবে৷ কৈবর্ত বিদ্রোহ আজ আর শুধু ইতিকথার নিরস পাঠ নেই কৈবর্ত বিদ্রোহের ইতিহাসকে আজ বাঙালি জাতিসত্তার সরস বিষয় হিসেবে তুলে ধরতে হবে৷ কেননা, কৈবর্ত পরিচয় বাঙালি জাতির গর্বিত আদি পরিচয়৷ আদি কৈবর্ত থেকেই বাঙালি জাতির পরবর্তী নমঃশূদ্র, চাকমা, মাহাতো, সদগোপ, মাহিষ্য, কোচ প্রভৃতি ছয়টি জাত বাঙালি জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছে৷ আর উত্তর জনপদে এই কৈবর্ত-কোচ থেকে বিবর্তিত, বিভাজিত রাজগুন, পোলিয়া, কলিতা, সিংহ সমন্বিত জাতিনাম রাজবংশী৷ এ সবই আদি কৈবর্ত বাঙালি জাতির গর্বিত ইতিহাস৷

কৈবর্ত বিদ্রোহের নায়ক দিবেবাক রাজা হয়ে ‘দনুজমর্দ্দন দেব’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন৷ ‘দনুজপুর’ নামে রাজধানীও স্থাপন করেছিলেন৷ তাঁর রাজ্যের সীমানা বরেন্দ্রবঙ্গ ছাড়িয়ে হরিকেল, বঙ্গ ডবাকেও বিস্তৃত হয়েছিল৷ ডক্টর নীহাররঞ্জন রায় বরেন্দ্র, হরিকেল, বঙ্গ ডবাকের বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত ‘দনুজমর্দ্দন’ নামাঙ্কিত মুদ্রার কথা উল্লেখ করেছেন৷

পাল সাম্রাজ্যের যুগে পাল রাজাদের মাঝখানে এমন একটি বিদ্রোহ ও রাজত্বের ইতিহাস সত্যিই জাত বাঙালিদের জ্যন গর্বের বিষয় ছিল৷ যদিও তা দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়নি৷ আনুমানিক খ্রিষ্টাব্দ থেকে খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মাত্র পঁচিশ ত্রিশ বছর রাজত্ব করার মধ্যেই রামপালের সঙ্গে যুদ্ধে পরবর্তী কৈবর্ত রাজারা পরাজিত হন৷ বরেন্দ্রবঙ্গ আবার পাল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়৷ তবু মাঝখানে অন্তর্ঝিলিকের মতো রয়ে চলা এই কৈবর্ত বিদ্রোহের ইতিহাস বাঙালি জাতির জন্য সত্যিই গর্বের ইতিহাস ছিল৷ কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজকের উত্তরবঙ্গে কৈবর্তের উত্তরসূরি কোচ রাজবংশীরা এই ইতিহাস নিয়ে গর্ববোধ করেন না৷ এই ইতিহাস তুলে ধরতে খুব একটা আগ্রহও দেখান না৷ এর পেছনে হয়তো আজকের রাজবংশীদের ‘না বাঙালি’ হয়ে ওঠার মানসিকতা কাজ করছে৷ কৈবর্তের ইতিহাস খুঁজতে গেলে হয়তো আসল জাত বাঙালির অস্থি, মজ্জা, শিকড় বেরিয়ে পড়বে৷ আজকের  রাজবংশীদের রাজনৈতিক হোতারা এই শিকড়ের সন্ধান করতে চান না৷ তাঁরা ভিন্ন পথে ভিন্ন নৃতত্ত্বের শোণিত খোঁজার অপচেষ্টা করছেন৷ কিন্তু শিকড়হীন বৃক্ষ বাঁচে কি? কৈবর্তরা বাঙালি জাতির আদি উৎস৷ উত্তরবঙ্গের আজকের  কৈবর্ত কোচ  রাজবংশীসহ সকল বাঙালিদেরও আদি উৎস৷ অবশ্য সেই উৎসের সঙ্গে উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন মোঙ্গোলিয়ান নৃগোষ্ঠীর মানুষের রক্তেও মিশ্রণও সমানভাবে প্রবাহিত৷ উত্তরবঙ্গের রাজবংশীরা একটি মিশ্র জনজাতি৷ তাঁদের এই ‘রাজবংশী’ বা রাজার বংশজাত’ হয়ে ওঠার পেছনেও আছে একটি গর্বিত ইতিহাস৷ কৈবর্ত বিদ্রোহের ইতিহাসের মতো সে ইতিহাসের মতো সে ইতিহাসও ছিল বিস্মৃত ইতিহাস৷ বিস্মৃত ইতিহাসের  পেছনেও আছে বরেন্দ্রবঙ্গের আরেক বীরাঙ্গনা নারী রাণী ফুলটুসি বর্ম্মণীর নাম৷ যিনি উত্তরবঙ্গের কৈবর্ত, কোচ, মেচ, রাভা, রাই, পোলিয়া, সিংহ, কালিতা প্রভৃতি বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর, বিভিন্ন উপাধিকারী প্রজাদের রাজার বংশজাত ‘রাজবংশী’ বলে গৌরাবাম্বিত করেছিলেন৷ সেই ইতিহাস কৈবর্ত বিদ্রোহের অব্যবহিত পরের ইতিহাস৷ পরবর্তী কোনো প্রবন্ধে সেই ইতিহাস তুলে ধরবো৷ এখানে শুধু এইটুকু বলবো, কৈবর্ত বিদ্রোহের ইতিহাস রাজবংশীদের গর্বিত ইতিহাস৷ বাঙালি জাতির গর্বের ইতিহাস৷ ভারতবর্ষের গৌরাবান্বিত ইতিহাস৷ সুতরাং এই ইতিহাসের চর্চায় ঐতিহাসিকরা আরও বেশি করে এগিয়ে আসুন! শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার মিসিংলিঙ্ক ইতিহাসের এক ঝলক সত্য কাহিনী বিধৃত করেছেন৷ তিনি পেশাদার ঐতিহাসিক ছিলেন না৷ তাছাড়া যে প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে এই কাহিনি বিধৃত করেছেন সেটাও ভিন্ন প্রসঙ্গ৷ সেখানে আকরিকের মতো উঠে এসেছে ইতিহাসের এই এক টুকরো ঝিকিল৷ পেশাদার ঐতিহাসিকদের কর্তব্য সেই আকরিক থেকে ঝিলিক খণ্ডকে পরিশীলিত করে পরিবেশন করা৷ তাঁর উল্লেখের সূত্র ধরে ঐতিহাসিক সন তারিখের দোরগোড়ায় পৌঁছানো৷ যে সূত্র এতদিন ছিল বিস্মৃত৷