মানব জীবনে বিজ্ঞান ও ধর্ম

লেখক
সৌমিত্র পাল

পুর্ব প্রকাশিতের পর

জড়বিজ্ঞানীদের প্রাথমিক ধারণাকে যুক্তির আলোকে সংশোধন করেছেন শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী তাঁর কালজয়ী দর্শনশাস্ত্র --- আনন্দমার্গ’, ‘ভাব ও ভাবাদর্শপ্রভৃতি গ্রন্থে৷ তিনি প্রমাণ করেছেন যে শক্তিকণা সৃষ্টির আদি উৎস বা মূল উপাদান নয়৷

সূক্ষ্ম শক্তিকণা আবির্ভূত হয়েছে ইন্দ্রিয়াতীত সূক্ষ্মতম  সত্তা পরমচৈতন্য Supreme Consciousness) থেকেই৷ প্রকৃতপক্ষে  এই সূক্ষ্ম চৈতন্যসত্তাই সৃষ্টির মূল উপাদান তথা আদি উৎস৷ সৃষ্টির আদি উপাদান হিসাবে এই সত্তা সকল সত্তার মধ্যেই নিমজ্জিত বা শায়িত  সর্বব্যাপী অসীম সত্তা বিশেষ৷ দর্শন অনুযায়ী এই অসীম চৈতন্যসত্তা ও শক্তিকণার  মাঝে আছে আরেকটি সত্তা যাকে ভাবসত্তাবা মানসিক সত্তাও বলতে পারি৷ এই মানসিক সত্তাই  আমাদের প্রতি মূহুর্তে কর্মের প্রেরণা দেয় যা শক্তির সাহায্যে বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করি৷ আনন্দমার্গ দর্শণ অনুযায়ী আদি সৃষ্টির উৎস হলেন সূক্ষ্ম অনাদি অসীম অনন্ত চৈতন্যসত্তা৷ প্রকৃতির প্রভাবাধীন হয়ে এই সুক্ষ্মসত্তা ধীরে ধীরে স্থুল রূপ প্রাপ্ত হয়েছে৷ স্থুল রূপ বলতে কী বুঝব? প্রকৃতির পঞ্চভূত (ব্যোম্-মরুৎ-তেজ-অপ-ক্ষিতি) এবং পঞ্চতন্মাত্র (রূপ-রস-গন্ধ--শব্দ) এদের  একক বা সম্মিলিত পরিমন্ডলে যা প্রসূত বা সৃষ্টি হয়েছে তাই স্থূলরূপ তথা জড় বস্তুদেহ৷ জড়বস্তু দেহ  বলতে আমাদের চতুর্দিকে আকাশ বাতাস সাগর পাহাড় এমনকি প্রাণীদেহ পর্যন্ত  সবকিছুকেই বোঝায়৷ জড় বস্তুকণা ভাবসত্তা কিংবা শক্তিকণা কোনটাই স্বতন্ত্র সত্তা নয়৷ এরা মূল সত্তা চৈতন্যেরই Fundamental Stuff) স্থূল বিকাশ মাত্র৷  আনন্দমার্গ দর্শনে পরম চৈতন্যাকে ব্রহ্মনামেও ডাকা হয়৷ ব্রহ্মের আরেক নাম আনন্দ--- আনন্দম্ ব্রহ্ম ইত্যাহু৷ আনন্দ স্বরূপ ব্রহ্ম থেকেই সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে সবকিছু তাতেই লালিত পালিত হচ্ছে৷ আবার তাঁর মধ্যেই একদা সবকিছু বিনাশ প্রাপ্ত হচ্ছে৷  অর্র্থৎ সৃষ্টি স্থিতি ও প্রলয়  এই ত্রিধারা ঘটে চলেছে চক্রাকারে বিরাট ব্রহ্মদেহের মাঝেই৷ ভাবলেই অবাক হতে হয়! ভারতবর্ষের প্রাচীনতম দর্শন বেদ-এ এরই অনুরনন পাই৷

‘‘আনন্দাদ্ধ্যেব ঋল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে

আনন্দেন জাতানি জীবন্তি

আনন্দং প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্ত্ বা ৷’’

ব্রহ্ম সৃষ্টি( Generator), স্থিতি (Operator), ও বিনাশ(destroyer)-এর মূল নিয়ন্ত্রক৷ তাই তাকে ঈশ্বর’ (ঈশ্ ধাতুর অর্থ নিয়ন্ত্রণ করা) নামেও অভিহিত করা হয়৷

যাইহোক সৃষ্টির এই আদি উৎস খঁুজতে গিয়ে জড়বিজ্ঞানীরা শক্তিকণা পর্য্যন্ত পৌঁছে গিয়ে যেই হারিয়ে ফেলেছেন৷ এরপরে আর তাঁরা এগোতে পারেন নি৷ আদি উৎস সূক্ষ্মতম চৈতন্যসত্তাকে বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছেন৷  এখানেই জড় বিজ্ঞানীদের অপূর্ণতা অসারতা তৈরী হয়েছে৷ অন্যদিকে ধর্ম বিজ্ঞানীরা  মনের গবেষণাগারে নিরন্তর অনুশীলন চালিয়ে অসীমসত্তাকে  উপলব্ধি করেছেন৷ এটাই ধর্মবিজ্ঞানীদের সফলতা৷ অন্যদিকে জড় বিজ্ঞানীদের এই অপূর্ণতা স্বীকার করে নিয়েই বিজ্ঞানী জিনস্ মন্তব্য করেছেনঃ ‘Little is left of the foreboding materialism of the Victorian scientist. Physics is moving in the direction of the philosophical idealism’’ এই অপূর্ণতা (অসফলতা) সম্পর্কে বিশ্ব বন্দিত বিজ্ঞানী, আইনস্টাইন তাঁর আত্মজীবনীতে তাৎপর্যপূর্ণভাবেই লিখেছেন ঃ ‘All my attempts to adopt the theoretical foundation of physics to this new type of Knowledge failed completely. It was as if  the ground had been pulled out from under one, with no firm foundation to be seen  any where upon which one could have built..’’  জড় বিজ্ঞানের এই অপূর্ণতা আসলে অসীম চৈতন্যকে আবিষ্কার করার অক্ষমতা ৷ আর এই অক্ষমতাকে ঢাকবার জন্য অনেক সময় চৈতন্যর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে তাঁরা বলে থাকেন যে চৈতন্য আসলে কল্পনা প্রসূত বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়৷ কিন্তু আসল সত্যিটা হল এই যে ব্যষ্টি মনে চৈতন্য প্রসুপ্ত থাকে বলেই ব্যষ্টিমনে চৈতন্যের কল্পনা (ভাব) জাগ্রত হয়৷ এটা কোন অলীক কল্পনা হতে পারে না৷ প্রকৃতির সত্ত্ব-রজ ও তমোঃ--- এই ত্রিগুণ বন্ধনে পরমচৈতন্য বস্তু দেহে আবদ্ধ হয়৷ চৈতন্যের আস্তিত্বিক সম্ভাবনা বস্তুর মধ্যে অন্তর্নিহিত অবস্থায় থাকে বলে চৈতন্যকে আনন্দমার্গ দর্শনে পুরুষ সত্তা বলা হয়৷ পুরে শেতে যঃ সঃপুরুষ অর্থাৎ  সবকিছুর মধ্যে যে সত্তা শায়িত বা নিমজ্জিত আছেন তিনিই পুরুষসত্তা---চৈতন্য৷ জীবের মধ্যে চৈতন্যের সম্ভাবনা যে নিহিত রয়েছে তা একটি সুন্দর উদাহরণ সহযোগে  শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী মন্তব্য করেছেন৷ 

‘‘ বটবৃক্ষের সম্ভাবনা বটবীজের মধ্যেই নিহিত থাকে৷ জল, মৃত্তিকা বায়ু ও আলোকের সাহায্যে সেই সম্ভাবনাই স্ফুর্ত হতে থাকে৷  তেমনি আমরা যাকে চৈতন্য বলে বুঝি তা কোন উড়ে এসে জুড়ে বসা অদ্ভূত জিনিস নয়৷ প্রতিটি বস্তুকণার মধ্যে চৈতন্য অস্ফুট ভাবে রয়েছে৷’’

সুষ্ঠু ধমার্নুশীলনের মাধ্যমেই সাধকের মনে প্রসুপ্ত চৈতন্য জাগ্রত হয়৷ জীবনের  এক পরম শুভমূহুর্তে ধর্ম সাধনার পর্র্যয়ক্রমে সাধক চৈতন্যেই সমাহিত হয়ে যায়৷ সিদ্ধ হয় তাঁর জীবনের পরমলক্ষ্য৷ তবে বর্তমানে চৈতন্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে জড়বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি  Out look) বদলেছে৷

প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ক্লিফোর্ড এই চৈতন্যের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েই মন্তব্য করেছেনঃ

‘Consciousness is the reality which produces in our minds preceptions of  the motions of the brain’’

বিজ্ঞানী জিনস্ ও এই সত্যকে স্বীকার করেই বলেছেনঃ

‘Universe is a thought in the mind of God ’’

অর্র্থৎ সমগ্র জগৎটাই পরম চৈতন্যের মন থেকে প্রসূত বা উদ্ভূত৷ সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র চৈতন্যেরই  অস্তিত্ব ছিল--- আর কোনকিছুরই  অস্তিত্ব ছিল না৷ তিনি ভাবলেন নিজেকে বহুরূপে প্রকাশ করবেন৷ তাঁর যেমন ভাবনা তেমনই কাজ৷ উপনিষদের ভাষায় --- ‘‘একোহম্ বহুস্যাম’’ অর্র্থৎ তিনি এক ছিলেন বহুতে প্রকাশিত হলেন৷ তাঁর মানস সত্তা বা ভাবলোক থেকেই জন্ম নিল পাঞ্চভৌতিক জীব জগত৷ আর এদের মাঝেই অস্ফুট (বিমূর্ত) হয়ে তিনি নিজ লীলা করে চলেছেন কীভাবে তাঁর লীলার ধারা প্রবাহিত হচ্ছে? সংক্ষেপে বলা যায় যে সৃষ্টিচক্রের ধারায় অনাদি সক্ষ্ম চৈতন্য থেকেই স্থূল জগতের জন্ম হল৷ এই স্থূল জগতের বস্তুকণাতে প্রকৃতির (প্রকৃতি মানে প্রকার সর্জনী শক্তি) চাপে  প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ হচ্ছে৷ এর ফলস্বরূপ বস্তুকণা প্লাজমা(প্রাণ)তে রূপায়িত হচ্ছে৷ এই ক্ষুদ্র প্লাজমা (অবিকশিত প্রাণ) বিবর্তনের ধাপে ধাপে বিকশিত হতে হতে মানুষে উন্নীত হয়েছে৷ এখানেই  তার বিকাশের ধারা শেষ হয়ে যায়নি৷ মানব মন আরো বিকশিত হতে চায়৷ এই বিকাশের ধারা শেষ হয় যায় নি৷ মানব মন আরো বিকশিত হতে চায়৷ এই বিকাশের ভাবনাই তার মনকে(আদি উৎস) অসীম চৈতন্যের অভিমুখে নিয়ে যায়৷ অসীমের সাথে এক করে দিতে চায়৷ অসীমের সাথে মিলিত হওয়াধর্মসাধনাব্যতিরেকে সম্ভব নয়৷ নদীর চরম বিকাশ  ঘটে যেমন সাগরের সাথে মিশে গেলে, ঠিক তেমনি মনের চরম বিকাশ ঘটে চৈতন্যে সমাহিত হলে৷ এই চৈতন্যকে উপনিষদের ভাষায় তমসা বিনাশক জ্যোতির্ময় পুরুষ বলা হয়৷ তাঁতে মন সমাহিত হলে  মানুষ নিজেই ক্রমাম্বয়ে জ্যোতির্ময় পুরুষে রূপান্তরিত হয়ে যায়৷ কেটে যায় তাঁর জীবনের সসকল তমসা (অন্ধকার) এখানে তাঁর সুদীর্ঘ পথ চলার অবসান হয়৷ একদা যে উৎস (অনাদি চৈতন্য) থেকে উৎসারিত হয়ে সে এসেছিল এই ধূলির ধরণীতে, পুনরায়ে সেই উৎসতে ফিরে গিয়ে  চিরতরে বন্ধন মুক্ত(প্রকৃতির ত্রিবিধবন্ধন বা ত্রিগুন--- সত্ত্ব’, রজঃ ও তমঃ-এর বন্ধন থেকে মুক্ত) হয়৷  এই মুক্তিকেই ঋষি গৌতমবুদ্ধের বৌদ্ধধর্মমতে নির্র্বনলাভ করা বলেছেন৷    (ক্রমশঃ)