মহিলা মহল

লেখক
একর্ষি

পূর্বপ্রকাশিতের পর,

এবার দেখা যাক--- সমাজের চোখে, সমাজে নারী স্থান--- (ক) সুপ্রাচীনকালে পৃথিবীর সর্বত্র নারীতন্ত্র বা মাতৃগত কুলব্যবস্থার প্রচলন ছিল৷ আজকের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যে দোষ-ত্রুটি--- মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও ওই দোষ-ত্রুটির বাইরে ছিল না৷ মানুষ মায়ের পরিচয়েই নিজের পরিচয়ে দিত, গুণবতী মায়ের কথা বলে গৌরব বোধও করত৷ স্বভাবতই সে যুগে সমাজে মেয়ের ছিল দারুণ কদর, লোকে নিজের মেয়ের গৌরবে আদিখ্যেতা করে বেড়াত৷ তাই পিতৃগৃহে নারীর একটা পরিচয় ছিল ---‘কন্যা’ কন্‌+ যৎ+ টা= কন্যা ৷ ‘কন্‌’ ধাতুর একটা অর্থ হল আদরের ছোট জিনিস, আর ‘কন্যা’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে আদরের ছোট মানুষটি৷ মানুষ ভাবত--- কন্যা ক’দিনই বা আমাদের সংসারে থাকবে, দু’দিন পরে তো পরের ঘরে চলে যাবে তাই মেয়েকে সবসময় সাজিয়ে গুছিয়ে ভালমন্দ খাইয়ে রাখত৷ প্রাক্‌-মহাভারতীয় যুগ পর্যন্ত এ চলটা বজায় ছিল৷ কেননা তখন মেয়ের বিয়ে দেওয়া তেমন কোন বোঝা ছিল না৷ সেজন্যে মেয়ের আদরের একটুও খামতি ছিল না৷

বাঙলায় প্রাচীন ও মধ্যযুগে  (ব্যবহারিক জীবনে সর্বত্র মানা না হলেও) নারী মাতৃদেবীর আসনে অলংকৃত ছিল৷ এর সূত্রপাত বৌদ্ধীয় বজ্রযান তন্ত্রের হাত ধরে৷ এই তন্ত্র বাঙলায়  এসেছিল আজ থেকে ১৭০০ বছর আগে৷ বৌদ্ধতন্ত্রে বজ্রযানে প্রথমে ভাবকলা উদ্ভূত নারীর যে প্রাথমিক পরিচয়---মাতৃরূপে৷ কারণ হিসাবে বজ্রযানী তান্ত্রিকদের মত হচ্ছে---শিশু জন্মের  পরক্ষণেই নারীকে পায় মাতৃরূপে৷ তাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শ্রেয়স্কৃতিতে নারীর প্রাথমিক পরিচায়টাই হল যে সে ‘মা৷ নারীর শেষ পরিচয়টাও হল সে ‘মা’ মাতৃত্বেই তার পূর্ণতা৷ কারণ শিশুর কাছে নারী প্রথমে মাতৃরূপে আবির্ভূত হয়, আর জীবনে পূর্ণত্ব প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সে মাতৃরূপে সমাজে পরিচিতি লাভ করে৷ স্মরণীয়, বজ্রযানী তন্ত্র এই মূলভাব বা মূলমন্ত্রের ওপর দাঁড়িয়ে৷ শৈবতন্ত্র আধারিত বাঙলায় সেদিনকার বজ্রযানী-ভাবপোষিত বাঙালী নারী মাত্রকেই মাতৃভাবে গ্রহণ করেছিল৷ আজও নারীর প্রতি মাতৃভাবাত্মক দৃষ্টি বাঙালীর সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য৷ এর থেকেই বাঙলার মানুষ এখনো সকল নারীকে ‘মা’ সম্বোধন করে চলেছে--- যেমন ঠাকুরমা, দিদিমা, কাকিমা, খুড়িমা, জ্যেয়াঠাইমা, পিসিমা, মাসিমা, বউমা, , রানীমা, গুরুমা ইত্যাদি৷ রাঢ় বাঙলায় বরাবরই অন্য যে কোন দেশের তুলনায় নারী স্বাধীনতা খুব বেশী ছিল৷ হাটে বাজারে, গ্রামে-গঞ্জে মেয়েরা অবাধে ঘুরে বেড়াত, এখনও বেড়ায়৷ ক্ষেত-খামারে নারী-পুরুষ সমানভাবে পরিশ্রম করত ও করে, এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও পুরুষের পাশে দাঁড়িয়ে নারীও সমানভাবে যুদ্ধ করত৷ কোন কৃত্রিম সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল না৷

মানব ইতিহাসে অসংখ্য নজির আছে--- ‘‘নারীরা কেবল নারীকেই গৌরবান্বিত করেনি, সমস্ত মানব জাতিকেই গৌরবান্বিত করেছে৷ দর্শনে, আধ্যাত্মিকতায়, সমাজ সংস্কারে, শিক্ষার ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে--- কোথাও নারীরা পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই৷ জটিল দার্শনিক তত্ত্বের সমাধানেই হোক বা সামাজিক-শিক্ষানৈতিক সংস্কারেই হোক সর্বক্ষেত্রেই মেয়েরা  পুরুষের মতই সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে৷ বিপদে আপদে পুরুষকে প্রেরণা জোগাতেও নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য৷’’