মনের বিকাশ

লেখক
সত্যসন্ধ্য দেব

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন–‘‘মানুষের মধ্যে রয়েছে দেবত্বের বীজ, তাই মানুষের জীবনের লক্ষ্য হ’ল বহিঃপ্রকৃতি ও অনন্তঃপ্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রমের মাধ্যমে সে অন্তর্নিহিত দেবত্বকে প্রকাশিত করা৷’’

একটা কলি থেকে যেমন ফুল ফুটে ওঠে তেমনি আমাদের অন্তরের ঐশ্বর্য্যকে বিকশিত করতে হবে৷ আপন অন্তরের সৌরভকে ছড়িতে দিতে হবে সমাজে৷ তখনই আসে মানুষের জীবনের সার্থকতা৷ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বলেছেন ঃ ‘আমরা এ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়াছি উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত–একটা বাণী প্রচারে জন্য৷ আলোকে জগৎ উদ্ভাসিত করিবার জন্য যদি গগনে সূর্য উদিত হয়, বিতরণের উদ্দেশ্যে বন মধ্যে কুসুমরাজি যদি বিকশিত হয়, অমৃতময় বারিদান করিতে তটিনী যদি সাগরাভিমুখে প্রবাহিত হয়–যৌবনের পূর্ণ আনন্দ ও ভরা প্রাণ লইয়া আমরাও মর্ত্তলোকে নামিয়াছি একটা সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য৷ যে অজ্ঞাত গূঢ় উদ্দেশ্য আমাদের ব্যর্থ জীবনকে সার্থক করিয়া তোলে তাহা আবিষ্কার করিতে হইবে–ধ্যানের দ্বারা, কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার দ্বারা৷’’ (তরুণের স্বপ্ণ)৷

কী সেই ধ্যান? মেন হবে আমাদের কর্ম? কিভাবেই বা আমরা আমাদের অন্তর্নিহিত দেবত্বকে বিকশিত করতে পারি?

একটি ফুলে যেমন থাকে কতকগুলি পাঁপড়ি সমস্ত পাঁপড়িগুলির সুসামঞ্জস্যপূর্ণ বিকাশে যেমন সমগ্র ফুলের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে, তেমনি আমাদের জীবন কুসুমের পাঁপড়ি হল ৩টি–দেহ, মন ও আত্মা৷ এই তিনটির সুষম বিকাশের ওপর নির্ভরকরে আমাদের ব্যক্তিত্ব৷ মানুষের এই ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্যে তাই যেমন শরীরের উপযুক্ত চর্চার প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন মানসিক ও আত্মিক অনুশীলনের৷ দেহের সুস্থতা বিধানের জন্যে যেমন উপযুক্ত খাদ্য ব্যায়াম ও চিকিৎসর প্রয়োজন, মনের জন্যেও তদ্রুপ অনেককিছু করণীয় আছে৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা সাধারণতঃ মনের এই প্রয়োজনের দিকে তাকাই না৷ ফলে স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের মনের বিকাশ রুদ্ধ বা বিঘ্ণিত হয়ে যায়৷ অথচ মনেই মানুষ বড় হয় আবার মনেই মানুষ ক্ষুদ্র হয়৷ মনকে যদি সৈনিক বলি, তাহলে দেহটাকে বলতে হয় বন্দুক৷ বন্দুক বা অস্ত্র ভাল না হলে যেমন সৈনিক ঠিক লড়তে পারে না, দেহ সুস্থ না হলে মানুষ ঠিকমত কাজ করতে পারবে না–এটা সত্য৷ কিন্তু সৈনিকের সাহস, মনোবল, কৌশলের গুরুত্ব যুদ্ধে সবচেয়ে বেশী৷ একজন মহাপুরুষ ও একজন অতিসাধারণ মানুষের তফাৎটা দেহে নয়–মনে–আত্মিক শক্তিতে৷ তাই মনের দিকে তাকানো–মনের বিকাশের জন্যে সচেষ্ট হওয়া প্রত্যেকেরই কর্ত্তব্য৷

এখন এই মনকে কিভাবে বিকশিত করব, তা জানতে হলে আগে মনের ক্রিয়াকলাপ কিভাবে চলে সে সম্বন্ধে আমাদের জনেতে হবে৷

মন একটা অত্যন্ত সুক্ষ্ম শক্তি৷ অনেকে মস্তিষ্ক্ ও মনকে অভিন্ন ভাবেন, কিন্তু তা নয়৷ মৃত্যুর পর মানুসের মস্তিষ্ক্ যথাস্থানে থাকে, কিন্তু তারমন থাকে না তো৷ আর মন থাকে না বলেই মস্তিষ্কের কার্য্যকলাপ বন্ধ হয়ে যায়৷ অনেকে মনকে মস্তিষ্কের একটা গুণ মাত্র (Property) বলে ভাবেন৷ তাও হতে পারে না৷ তাহলে মন মস্তিষ্ক্ তথা মানব দেহকে চালাতে পারত না৷ মনকে অনেকে মস্তিষ্কের উপরে পারিপার্শ্বিকতার প্রতিফলন বলে ভাবেন৷ তা যদি হ’ত তাহলে একই পরিবেশে সকলেরমন একই ধরণের হ’ত, বৈচিত্র্য থাকত না৷ অথচ এই বৈচিত্র্যই হল স্বাভাবিক–প্রাকৃত ধর্ম৷ তাছাড়া মস্তিষ্ক্ অতিরিক্ত মনের শক্তি ভারতের অসংখ্য যোগীর জীবনে অনেকেই প্রত্যক্ষ করেছেন৷ একজন যোগী বহু দূরে ঘটনা কি করে জানছেন? তার মস্তিষ্ক্ তো একটা জায়গাতে রয়েছে৷ এক্ষেত্রে সেই যোগী এক জায়গায় বসে থাকলেও তিনি তাঁর সূক্ষ্ম মনকে দূর স্থানে পাঠিয়ে খবর জেনে নেন৷ রামকৃষ্ণদেব, ত্রৈলঙ্গস্বামী প্রভৃতির জীবনে এধরণের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী সঙ্গে যাঁরা ঘনিষ্ঠ তাঁরাও এ ধরণের বহু ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী৷

মন সাধারণতঃ মস্তিষ্ক্ ও স্নায়ুমণ্ডলীর মাধ্যমে কাজ করে বা নিজেকে প্রকাশ করে৷ ঠিক যেমন সূক্ষ্ম অদৃশ্য বিদ্যুৎ শক্তি পাখা, বাল্ব, মোটর প্রভৃতির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করছে৷ মস্তিষ্ক্ হ’ল মনের প্রধান কার্য্যালয়৷ মস্তিষ্ক্ থেকে বেরিয়ে গেছে মূল স্নায়ুগুচ্ছ–সুষুম্না কাণ্ড৷ মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে তা প্রবাহিত হয়ে গেছে নিম্নদিকে৷ তার মাঝে মাঝে রয়েছে কতকগুলি চক্র৷ যা থেকে স্নায়ুগুলি বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেহে৷ যোগবিজ্ঞানে এই চকরগুলির নাম নীচের থেকে মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা৷ এই ছয়টি চক্রের উপরে মস্তিষ্কের কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে সহস্রার চক্র৷ আর আমাদের শরীরের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ ন্দ্বিনয়ন্ত্রণ করে যে কতগুলি গ্রন্থি–সেগুলিারও নিয়ন্ত্রিত হয় চক্রগুলির দ্বারা৷ এই সব গ্রন্থি থেকে একধরণের রসক্ষরণ হয়৷ তা অস্বাভাবিক হলে মনে প্রবৃত্তিগত অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়৷ যেমন লোভ বা ক্রোধের নিয়ন্ত্রক গ্রন্থি থেকে রসক্ষরণ ঠিকভাবে না হলে যথাক্রমে মানুষ অতি লোভী বা খিট্খিটে মেজাজের হয়ে যায়৷ তাই মনের যে ৫০টি বৃত্তি তা সুনিয়ন্ত্রিত থাকে যদি চক্র, গ্রন্থি ও ঐ স্থানের স্নায়ুমণ্ডলী সুস্থভাবে কাজ করে৷ তাই কিভাবে এই গ্রন্থিগুলিকে, চক্রগুলিকে ও স্নায়ুমণ্ডলীকে সুস্থ ও সবল করা যায় বা ন্তুজানতে হবে৷ যোগের যম, নিয়ম, আসন, বচক্রশোধন, তত্ত্বধারণা প্রভৃতির প্রয়োজনীয়তা এইখানে আর প্রাণায়ম, প্রত্যাহার প্রভৃতির মুখ্য উদ্দেশ্য মনের একাগ্রতা অর্জন৷ জড়ানো সূর্যের আলোকে কেন্দ্রীভূত করলে যেমন আগুন জ্বলে ওঠে, তেমনি বিক্ষিপ্ত মনকে যোগের এই সমস্ত প্রক্রিয়ার সাহায্যে একাগ্র করলে মনের মধ্যে অসীম শক্তির স্ফূরণ হয়৷ ধ্যানের মুখ্য উদ্দেশ্য মানবপ্রবাহকে পরমাত্মার দিকে বহিয়ে  দেওয়া৷ যোগ কথাটারর্থই হ’ল ‘সংযোগঃ যোগ ইত্যুক্তির জীবাত্মাপরমাত্মনঃ’–অর্থাৎ জীবত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সংযোগই যোগ সাধনা৷ ঠিক যেন একটা বিরাট পুকুর–গ্রীষ্মের দাবদাহে শুকিয়ে কাঠফাটা হয়ে গেছে তারপর বন্যা এল‘ কিন্তু পুকুরের চারদিকে খুব উঁচু পাড় তখন দৃশ্যটা কেমন? চারিদিকে জল নেই, তারপর একটা নালা কেটে পুকুরের সঙ্গে এই বন্যার জলকে ‘যোগ’ করে দেওয়া হ’ল অমনি বাইরের জলরাশি পুকুরের ভেতরে প্রবেশ করে পুকুরটাকে পূর্ণ করে দিল৷ ঠিক তেমনি, বিশ্বের সর্বত্র অনন্ত ব্রহ্ম বিরাজমান৷ আমরা তাঁর ভেতরেই৷ অথচ সেই অনন্ত শক্তি ও আনন্দ–স্বরূপ ব্রহ্মের মধ্যে থেকেও আমাদের অন্তর নিরানন্দও শক্তিহীন মৃতপ্রায় মনকে অনন্ত ব্রহ্মের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে হবে৷ তাই যোগসাধনা৷ আর তখনই দেখব, আমাদের মন শক্তি ও আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠবে৷

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন,‘‘আনন্দমার্গেও অষ্টাঙ্গিক যোগের সাধনায় দেহাত্মাবোধযুক্ত সাধক ধীরে ধীরে তার অস্ফূট মননশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারে আর সেই উন্নত মনের সাহায্যে শেষ পর্যন্ত আধ্যাত্মিক স্থিতি লাভ করে৷ এই আত্মিক স্থিতিতে, এই স্বচ্ছ স্থিতিতেই সে পায় সত্যিকারের আনন্দ’’ এইটাই যোগ সাধনার লক্ষ্য৷