মুক্তির অধিকারী

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

আত্মজ্ঞানই হ’ল মুক্তির লক্ষণ, আর এই আত্মজ্ঞান মানুষ তখনই পায় যখন সে নিজ সুকর্মের ফলে মানুষের শরীর লাভ করে৷ মানবদেহ লাভ করলে তবে আত্মজ্ঞান হয়৷ দেখ, পশুজীবন ও মানবজীবন এই দু’য়ের মধ্যে মুখ্য পার্থক্য কী? দুই–ই পরমাত্মার সন্তান৷ একটি কুকুর, একটি বিড়াল আর একজন মানুষ–সবই পরমাত্মার সন্তান৷ কিন্তু দু’য়ের মধ্যে পার্থক্যটা এই যে, মানুষের বুদ্ধি উন্নত৷ মানুষ বোঝে যে শ্রেয় ও প্রেয়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? পশু এটা বুঝতে পারে না কারণ–তার মন ও বুদ্ধি অনুন্নত৷ পশুজীবন হ’ল জড়ের উপাসক৷ যে কোন পশুকে তুমি দেখবে যে সব সময় জড়ভোগে ব্যস্ত থাকে৷ জড়জগতের বাইরে তার আর কোনো দ্বিতীয় জগৎ নেই৷ মানুষের আছে স্থূল জগৎ কিন্তু এর সঙ্গে তাঁর আছে এক মানসিক জগৎ অর্থাৎ বৌদ্ধিক জগৎ৷ মানুষের আধ্যাত্মিক জগৎও আছে৷ সূক্ষ্মমন তথা সূক্ষ্মবুদ্ধির দ্বারা মানুষ ওইসব সূক্ষ্ম সত্ত্বাসমূহ, ওই সূক্ষ্ম বিভিন্ন লোক ব্দহ্মড়ন্দ্বব্জন্দ্ব, স্তরগ্গ–এর সংস্পর্শে এসে যায়৷ তুমি একটি কুকুরকে লাথি মারলে, এরপর তাকে রুটি খেতে দিলে৷ সে খেয়ে নেবে৷ একজন মানুষকে লাথি মার৷ তারপর তাকে পোলাও খেতে দাও, সে খাবে না৷ কেননা তার মন আছে, সে মনপ্রধান জীব৷ মনপ্রধান হওয়ার কারণেই সে মানুষ৷ মানুষ কথাটার অর্থই হ’ল যার মধ্যে মনই প্রধান৷

এই যে পশুজীবন, এই পশু–জীবনে পরে মনুষ্যজীবন আসে৷ লোকে বলে, আর কথাটা সত্যিও বটে যে, পশু প্রবৃত্তির দ্বারা পরিচালিত হয়, নিজের স্বতন্ত্র বুদ্ধির দ্বারা নয়৷ তার কর্মের কর্মফল তাকে ভোগ করতে হয় না৷ সেইজন্যে পশুর অধোগতির প্রশ্ণ ওঠে না, যদিও তার ক্রমশঃ উন্নতি হতে থাকে৷ এটা হয় কী ভাবে?

পশু জড়বস্তুর সাধনা করে৷ আর এই ভাবে চলতে চলতে প্রকৃতির সঙ্গে সংঘর্ষ হয়৷ এই ঘাত–প্রতিঘাতের কারণেই তার স্বাভাবিক প্রগতি হতে থাকে৷ এইজন্যে পশুদের মধ্যেও যে অধিক সংঘর্ষের সম্মুখীন হয়, সে অধিক উন্নত হয়ে যায়৷ বাইরের এক জংলী কুকুর আর পালিত কুকুরের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকে৷ পালিত কুকুর অনেক কিছু বুঝতে পারে, শিখে যায়, সংঘর্ষের কারণে তার অনেক উন্নতি হয়ে যায়৷ এই রকম উন্নতি হতে হতে এক সময় আসে যখন তার মন আরো অনেক উন্নত হয়ে যায়৷ অধিক উন্নত হওয়ার জন্যে তার মধ্যে এসে যায় স্বতন্ত্র বুদ্ধি৷ তাই পশুর জন্যে এগুলো হ’ল তার সুকৃতি৷

মানুষের শরীর পাওয়ার পর, তোমরা সবাই জান যে, মানুষের অতীত কালের অনুভব থাকে৷ অতীতেরও অভিজ্ঞতা তার মধ্যে থাকে কিন্তু ভবিষ্যতের অনুভূতি তার হয় না৷ ভবিষ্যৎ তো পরে ঘটিত হওয়ার ব্যাপার, এইজন্যে প্রত্যেক মানুষ ভবিষ্যৎকে ভয় পায়, অতীতকে নয়৷ অতীতের যে দুঃখজনক ঘটনা সেটা যখন মনে এসে যায় তখন কখনও কখনও মনে সে আনন্দ অনুভব করে এইজন্যে–সে ভাবে ওই বিপদে আমি কীভাবে সবকিছু সামলে নিয়েছিলুম৷ এই ভাবনাটা তার কাছে সুখাত্মক হয়ে যায় কেননা সেটা তো ছিল অতীত কালের বিষয়৷ কিন্তু ভবিষ্যতের জন্যে বিপদের ঝুঁকি নিতে হয়৷

এখন কথা হচ্ছে এই যে, পশুজীবনের অভিজ্ঞতা মানুষের মনে থাকে৷ তাই তুমি দেখবে  কোনো মানুষ লড়াই করার পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েও লড়াই করবার সুযোগটা সে পাচ্ছে না, হাতের ব্যবহার করার সুযোগও সে পাচ্ছে না৷ সে অবস্থায় সে কী করবে? বাঁদরের মত সে নিজে দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করবে, আর মুখে উঁ–উঁ–উঁ– আবাজ করবে৷ এটাই হ’ল পশুজীবনের অভিজ্ঞতা, বাঁদর জীবনের অভিজ্ঞতা৷ শিশু এরকমটা বেশী করে থাকে৷ কেন? এর কারণ হচ্ছে যে, শিশুর কাছে তো এই অভিজ্ঞতা অনেক নিকট কালের৷ এই জন্যে দেখবে যে মানব শিশু বাঁদরের মত অধিক সময় হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখবে কেননা এর আগের জীবনে গাছের ডালপালা তাকে ওইভাবে ধরে থাকতে হতো৷

পশুজীবনের অভিজ্ঞতা থাকার কারণে সে পশুজীবনকে ভয় পায় না কিন্তু তার সম্মুখে উঁচু আদর্শ না থাকলে, মানুষ হয়েও সে পশুত্বের দিকে চলে যাবে৷ এইভাবে মানুষের খুব সহজেই পতন হয়ে যায়৷ পশুভাবাত্মক কিছু দেখলে বা শুণলে তার মন প্রভাবিত হয়ে পরে, মনের পতন হয়ে যায় কেননা তার সেই রকমের অভিজ্ঞতা মনে সঞ্চিত আছে৷ অনেকে জিজ্ঞাসা করে মন কেন নীচে চলে যায়? এর উত্তরটা হ’ল, মন এইজন্যে নীচে চলে যায়, কারণ এর আগের স্তরেই সে পশু ছিল, সেই রকমের অভিজ্ঞতাও তার মধ্যে আছে৷ এইজন্যে মন সহজে নীচে চলে যায়৷

এই যে অধোগতি হয়, এর থেকে বাঁচার উপায় কী? উন্নতি করার সতত প্রয়াস বজায় রাখা৷ এই রকমের প্রয়াস যদি চলতে থাকে তবে নীচে পতিত হওয়া ক্ষন্ধ হয়ে যাবে৷ মনে শূন্যতা থাকতে পারে না৷ এইজন্যে মানুষের মন সম্পর্কে বলা Idle mind is a devil's workshop  অর্থাৎ অলস মন শয়তানের কারখানা৷ মন যদি শুভভাবনায় ব্যস্ত আছে তো ঠিক আছে, না হলে তার মন পশুজীবনের অভিজ্ঞতার দিকে সহজেই চলে যাবে৷ এটা তো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার৷ অন্যদিকে মানুষের সম্মুখে আছে উন্নত জীবন, দেবজীবন, যে জীবনে সেই মানুষটি তার মনকে আত্মায় রূপান্তরিত করতে পারে৷

 

উৎস

(আনন্দবচনামৃতম, সপ্তবিংশ খণ্ড)