নব আদর্শে---নব উদ্দীপনায় সবাই হোক উজ্জীবিত

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

মনুষ্য জাতির ইতিহাসে দেখা গেছে যখনই কোন মহাপুরুষ, মনীষী, সমাজ সংস্কারক, নূতনের বার্তাবহ মানুষের কল্যাণে, নিপীড়িত মানবতার সংকট মোচনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, জ্ঞানের আলোকবর্ত্তিকা ঊধের্ব তুলে ধরেছেন তখনই অন্ধকারের পিশাচেরা, ভাবজড়তার ধবজাধারীরা নিজেদের সর্বনাশের আতঙ্কে যূথবদ্ধভাবে তার বিরোধিতা করেছে, চক্রান্ত করেছে---এমনকি ছলে-বলে-কৌশলে তাদের হত্যার ষড়যন্ত্রও করেছে৷ প্রাচীন যুগের সেই সদাশিবের সময় থেকেই একই ধারাপ্রবাহ বয়ে চলেছে৷ পাহাড়ে-পর্বতে ছড়িয়ে-ছিঁটিয়ে থাকা মানুষজনকে এক সূত্রে গেঁথে, বিবাহ ব্যবস্থার প্রচলন করে’ মানব সমাজকে একটা বিধিবদ্ধ রূপ দিয়েছিলেন সদাশিব৷ এছাড়াও বৈদ্যক শাস্ত্রের সৃষ্টি, সঙ্গীত-নৃত্যে সুর-তাল-ছন্দের প্রবর্ত্তন, আধ্যাত্মিক জগতে তন্ত্রসাধনার পথ নির্দেশনা, এসবই তাঁর অবদান৷ সদাশিবের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ খুব সহজে সম্ভব হয়নি৷ তৎকালীন বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গে সংগ্রাম করেই তাঁকে জয়যুক্ত হতে হয়েছিল৷ পরবর্তীকালে শ্রীকৃষ্ণের সময়েও একইরকম ঘটনাপ্রবাহের অবতারণা হয়৷ বাল্যকাল থেকেই শ্রীকৃষ্ণ দূরাচারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হন ও পরিশেষে ধর্মরক্ষার্থে, সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাকল্পে তাঁকে মহাভারতের যুদ্ধেরও পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে হয়৷ এইভাবে পরবর্তী সময়কালে যীশুখ্রীষ্ট, সক্রেটিস, গ্যালিলিও, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, ঋষি অরবিন্দ, রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অন্যান্য বহু মনীষীগণকে বিভিন্ন সময়ে কপটাচারী, ভণ্ড, দুর্নীতিপরায়ণ, ব্যষ্টিবর্গের অত্যাচার, নিপীড়ন, লাঞ্ছনা এমনকি মৃত্যু যন্ত্রণা পর্যন্তও ভোগ করতে হয়েছে৷ এই ধারাপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই মানুষের সর্বাত্মক মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত আনন্দমার্গকে জন্মলগ্ণ থেকেই তথাকথিত হীন স্বার্থবাদী, লোভী, মুনাফাবাজ, ভেজালদারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত, অর্থপিশাচদের বিরুদ্ধাচরণের সম্মুখীন হতে হয়েছে৷

হিংসা ও সন্ত্রাস কবলিত বর্তমান পৃথিবীতে কোথাও বর্ণবিদ্বেষ, কোথাও জাতিবিদ্বেষ, কোথাও ধর্মবিদ্বেষ, চতুর্দিকে অবিশ্বাস, অসন্তোষ, অস্ত্রের ঝনঝনি আর মানবতার গ্লানি৷ একদিকে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে বিশাল সম্পদের পাহাড়, বৈভব আর ঐশ্বর্য্যের প্রাচুর্য, অপরদিকে কোটি কোটি মানুষের বুভুক্ষা, শোষণ যন্ত্রণা, নির্যাতন, অন্নহীন, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন, শিক্ষাহীন, চিকিৎসাহীন অবস্থায় দিনযাপন৷ সাধারণ মানুষের দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন সংস্থানের চেষ্টাতেই সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত, প্রাণধর্ম মৃতপ্রায়, নীতিবাদ বিবর্জিত, প্রেম-প্রীতি,-ভালোবাসা, স্নেহ-মায়া-মমতা ইত্যাদি সুকুমারবৃত্তিগুলো হারিয়ে মানুষ আজ নির্জীব জড়ে পর্যবসিত৷ মানবতার এই চরম অবক্ষয় ও অবমূল্যায়নের হাত থেকে রক্ষাকল্পে মহাসম্ভূতি তারকব্রহ্ম শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী প্রবর্ত্তন করলেন সর্বানুসূ্যত দর্শন ‘আনন্দমার্গ’৷ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সর্বস্ব হারানো  মানুষের মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে আশার আলো, শোনাতে হবে আশ্বাস বাণী, দিতে হবে ভরসার আশ্রয়স্থল৷ অধ্যাত্মবাদের পরশমণি দিয়ে তিনি মানুষের অন্তরে জ্বালিয়ে তুললেন সহস্র প্রদীপের আলোকমালা, জাগরিত করে দিলেন অন্তরাত্মার শক্তি ও দুর্জয় সাহস৷  পুরুলিয়ার পাহাড়-জঙ্গলের প্রাকৃতিক পরিবেশ ঘেরা আনন্দনগরে গড়ে তুূললেন সেবা ও সাধনার পীঠস্থান৷ তাঁর অমোঘ আকর্ষণে লক্ষ লক্ষ অতি সাধারণ মানুষেরা সেবা কার্যে এগিয়ে এলো, সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীগণ তাঁর এই বিশাল কর্মযজ্ঞে নিজেদের সমর্পিত করলেন৷ একদিকে আনন্দমার্গ দর্শনের মাধ্যমে মানুষকে তিনি দিলেন অষ্টাঙ্গিক  যোগ কেন্দ্রিক আধ্যাত্মিক পথের নির্দেশনা, অপরদিকে সমাজকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্যে, সর্ববিধ শোষণমুক্ত মানব সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি প্রবর্ত্তন করলেন প্রাউট Prout) বা প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব৷  এছাড়াও তিনি শেখালেন ‘নব্যমানবতাবাদ৷’  শুধুমাত্র মানুষই নয়, এ পৃথিবীতে প্রতিটি জীব, জড়, উদ্ভিদ সকলেরই সমান অধিকার, প্রত্যেকেরই সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার, উন্নতির পথে এগিয়ে চলার অধিকারকে তিনি স্বীকৃতি দিলেন নব্যমানবতাবাদের মাধ্যমে৷

আনন্দমূর্ত্তিজীর সুযোগ্য নেতৃত্ব, পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় আনন্দমার্গ ও প্রাউটের বিজয়রথ এগিয়ে চলল দেশ থেকে দেশান্তরে৷ নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষদের জন্যে চলতে লাগল দেশে বিদেশে সেবাকার্য৷ বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে স্বীকৃতিও প্রদান করা হ’ল আনন্দমার্গের বিভিন্ন শাখায় বিপুল সেবা ধর্মের৷ আনন্দমার্গের এই ব্যাপক, প্রসার ও জনপ্রিয়তায় দুর্নীতিপরায়ণ, মানবতাবিরোধী, কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীগুলি ভীত-সন্ত্রস্ত হ’ল৷ শুরু হ’ল আনন্দমার্গের নামে অপপ্রচার, মিথ্যাচার---নেমে এল আঘাত বিভিন্ন দিক থেকে৷ ভারতবর্ষের কেন্দ্রে পুঁজিবাদীদের ধবজাধারী সরকার পুঁজিপতিদের অঙ্গুলীহেলনে আনন্দমার্গের প্রসার রুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে কোমড় বেঁধে লাগল---লেলিয়ে দেওয়া হ’ল সিবিআইসহ বিভিন্ন এজেন্সীগুলোকে৷ কিন্তু কঠোর নীতিবাদী, আপোষহীন সংগ্রামী, আধ্যাত্মিকতায় সমুন্নত লক্ষ লক্ষ আনন্দমার্গের অনুগামীগণ পরমপুরুষের কৃপায় নিঃস্বার্থ সেবাকার্যের মাধ্যমে সেইসব বাধা-বিপত্তিকে উপলখণ্ডের মত সরিয়ে নিজেদের কর্তব্য নিষ্ঠায় অবিচল রইলেন৷ পরবর্তীকালে পশ্চিমবাঙলার কমিউনিষ্ট শাসকবর্গও একই পথ বেছে নিল৷ কমিউনিষ্টরা চরম আঘাত হানল ১৯৬৭ সালের ৫ই মার্চ আনন্দমার্গের মূল কেন্দ্র আনন্দনগরে৷ পাঁচ জন সর্বত্যাগী সেবাব্রতী সন্ন্যাসীকে হত্যা করে, আনন্দনগরের সমস্ত রকমের সেবা কার্যের জন্যে নির্মিত পরিকাঠামোগুলিকে ধবংস করে একটি শ্মশানে পরিণত করল৷ এতদ্সত্ত্বেও আনন্দমার্গকে দমিয়ে রাখা যায়নি৷ পুনরায় পরমপিতার আশীর্বাদে ও মহাকৌলিক আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পাতে অচিরেই আনন্দমার্গের সেবা ধর্মের গতিধারা প্রবল উচ্ছ্বাসে এগিয়ে চলতে লাগল৷

এমতাবস্থায় অন্ধকারের পিশাচেরা সংঘটনের প্রাণপুরুষ মহাসম্ভূতি তারকব্রহ্ম শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী জব্দ করার লক্ষ্যে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল রচনা করল৷ ১৯৭১ সালের ২৯শে ডিসেম্বর ভোর ছ’টায় সিবিআই সাজানো মিথ্যা অভিযোগে ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে তাঁকে পটনা থেকে গ্রেপ্তার করে’ বক্সার জেলে নিয়ে আসে৷ ২৮শে ডিসেম্বর একাদশী থাকায় তাঁকে প্রায় ৬০ ঘণ্টা একনাগারে অন্নজল ব্যতিরেকে থাকতে বাধ্য করা হয়৷ এছাড়া জেলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, সিবিআই ও কারা কর্তৃপক্ষের নিরন্তর নির্যাতনে তাঁকে সর্বদাই বিব্রত করা হ’ত৷ ২৫শে ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ থেকে একনাগাড়ে তিন দিন তাঁকে খাবার দেওয়া হয়নি৷ এইভাবেই তাঁকে ক্রমাগত নির্যাতন ও উৎপীড়নের মুখোমুখী হতে হয়৷ ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে বাঁকিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয়৷ ওই বৎসরের জুন মাসে তাঁর মাতৃদেবীর তিরোধানের পর প্রথা অনুযায়ী পারলোকিক ক্রিয়াকর্মও করতে দেওয়া হয়নি৷ এইভাবে প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক উৎপীড়নের পরেও তিনি তাঁর লক্ষ্যে ছিলেন স্থিরসংকল্প৷ শেষ পর্যন্ত ১৯৭৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী রাত ১১টায় জেলের ডাক্তার ঔষধের নামে তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে৷ ঔষধটি খাবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন ও সকালে জ্ঞান ফিরে পাবার পর তাঁর (১) সারা শরীরে প্রচণ্ড দুর্বলতা বোধ, (২) সারা শরীরে স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া, (৩) দু’চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়া, (৪) মস্তিষ্কে দারুণ যন্ত্রণাবোধ, (৫) মস্তিষ্কের নিস্ক্রিয়তাবোধ হতে থাকে৷