নেতাজীর সমন্বয়বাদ ও প্রাউটের সংশ্লেষণাত্মক মানবতাবাদ

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

নেতাজীর চিন্তাধারার মূল কথা হ’ল–সমন্বয়বাদ৷ তিনি বলেছেন, ‘‘That synthesis is called by the writer samyavad—the Indian word, which means literally—the Doctrine of Synthesis or equality’’—(Indian Struggle by Netaji).

বলাবাহুল্য নেতাজীর সাম্যবাদ ও মার্কসের সাম্যবাদ এক নয়৷ মার্কসের সাম্যবাদ কেবল আর্থিক স্তরে সীমাবদ্ধ৷ কিন্তু নেতাজীর সাম্যবাদ জীবন ও সমাজের সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত৷ মানুষের ভৌতিক Physical ও আত্মিক প্রগতির সাম্য, সমাজ জীবনের অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, শিল্পকলা, ধর্মনীতি–সকল দিকের সুসামঞ্জস্য পূর্ণ বিকাশই নেতাজীর কাম্য ছিল৷ তাই একে ব্যাখ্যা করে আরও পরিষ্কার করে বলা হয়েছে The doctrine of synthesis বা সমন্বয়বাদ৷

আত্মিক ও দৈহিকের সমতা ঃ ভারতের ইতিহাস বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে নেতাজী বলেছেন–‘‘আধ্যাত্মিক দিকের ওপরে অতিরিক্ত জোর দেওয়ার জন্যে ভারতের বিজ্ঞানের বিকাশ হতে পারেনি৷ ঐহিক জীবনে, প্রাকৃতিক ক্ষেত্রে ভারতবর্ষ দুর্বল হয়ে রয়েছে৷ ...আমাদের গৌরবোজ্জ্বল যুগগুলিতে আত্মা ও দেহের, চৈতন্য ও জড়ের দাবীর মধ্যে একটা মধ্যপথ বা সমন্বয় বের করা হয়েছিল৷ এর ফলে দুই ক্ষেত্রেই একই সঙ্গে সমান অগ্রগতি হতে পারে৷ আত্মা ও দেহের মধ্যে এমন এক পারস্পরিক সম্বন্ধ রয়েছে৷ যার দরুণ দেহকে তুচ্ছ করলে যে দেহেরই ক্ষতি হয় তা নয়, পরিণামে অধ্যাত্ম জীবনেও মানুষকে দুর্বল করে ফেলে৷ আজকাল ভারত কেবল দৈহিক শক্তিহীনতা নয়, আধ্যাত্মিক ক্লান্তিতেও ভুগছে৷ এটা আমাদের জীবনের একটা দিককে তাচ্ছিল্য করবার পরিণাম৷ যদি আবার আমাদের আত্মমর্যাদা ফিরে পেতে হয় তবে দৈহিক ও আত্মিক দুই ক্ষেত্রেই আমাদের একই সঙ্গে এগুতে হবে৷’’ –নেতাজীর এই উক্তির মধ্যে তাঁর আদর্শের একটা সুস্পষ্ট রূপরেখা খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না৷

গান্ধীজী ও নেতাজীর আদর্শের তুলনা ঃ এখন দেখা যাক্ গান্ধীজীর আদর্শের সঙ্গে নেতাজীর আদর্শের পার্থক্য কোথায়? গান্ধীজী ছিলেন প্রাচীনতার ভক্ত৷ তিনি প্রাচীনতার মোহে এমনই আবদ্ধ ছিলেন যে আধুনিক বিজ্ঞান, যন্ত্রশিল্প, উন্নত জীবনমান–এ সব কিছুকেই তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন৷ এইখানেই নেতাজীর সঙ্গে গান্ধীজীর চিন্তাধারার সর্ব প্রথম সংঘাত৷ কেননা, বিবেকানন্দের মানস শিষ্য নেতাজী চেয়েছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার সমন্বয়–ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের সমন্বয়৷ নেতাজী এক্ষেত্রেও তাঁর সমন্বয়বাদের প্রয়োগ করেছেন৷

অর্থনীতি ক্ষেত্রে গান্ধজী পুঁজিবাদের ওপর আঘাত হানার পক্ষপাতী ছিলেন না৷ গান্ধীজী বলেছেন, ‘‘আমি কারও সম্পত্তি কেড়ে নিতে চাই না, তা চাইলে অহিংসার বিধান থেকে বিচ্যুত হতে হবে৷’’ (স্পীচেস্ অ্যাণ্ড রাইটিংস্ অব্ মহাত্মা গান্ধী পৃঃ– ৩৮৪–৮৫)৷ গান্ধজী বলেন, ‘‘আমি পরামর্শ দিই যে, ধনবানরা কোটি কোটি টাকা উপার্জন করতে পারে কিন্তু তা সকলের সেবায় উৎসর্গ করার জন্যেই করবে৷’’ (হরিজন ২২–২–৪২)৷ গান্ধীজীর এই তত্ত্ব ‘‘অছিবাদ’’ নামেই খ্যাত৷

সুভাষচন্দ্র অছিবাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি৷ পুঁজিপতিরা স্বেচ্ছায় সকলের সেবায় তাদের ধন উৎসর্গ করবে–এই অবাস্তব বিশ্বাসের ওপর তিনি দেশের দরিদ্র জনগণের ভাগ্য ছেড়ে দিতে প্রস্তুত নন৷ নেতাজী পুঁজিবাদী কাঠামোর অবসান চেয়েছিলেন৷ ১৯৩৮ সালে হরিপুরা কংগ্রেসের সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমাদের সমগ্র কৃষি ও শিল্প ব্যবস্থাকে সামাজিক মালিকানার অধীনে অনবার জন্যে রাষ্ট্রকে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে’’৷ কৃষিক্ষেত্রে তাঁর মত–‘‘জমির উৎপাদন বৃদ্ধি করবার জন্যে কৃষিকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে৷’’ শিল্পের ক্ষেত্রে তিনি যন্ত্র শিল্পকে স্বাগত জানিয়েছেন৷ –অথচ আধুনিক বিজ্ঞান ও যন্ত্রশিল্পের প্রতি গান্ধীজীর ছিল অহেতুক ঘৃণা–তিনি গ্রামে গ্রামে প্রাচীন পন্থায় কুটীর শিল্প গড়ার ওপর জোর দিতেন৷

কৌশল হিসেবে গান্ধীজীর অহিংসাবাদকে সংগ্রামের বিশেষ স্তরে মেনে নিলেও সকল সময়ের জন্যে একটা অচল অনড় দর্শন হিসেবে একে নেতাজী কখনও মেনে নিতে পারেন নি৷ নেতাজী বরণ করেছিলেন বিবেকানন্দের শক্তিবাদকে৷ এ সমস্ত কারণেই কালক্রমে গান্ধীজীর ও নেতাজীর মধ্যে বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল৷

সুভাষ ও মার্কস ঃ এখন বিচার করা যাক সুভাষচন্দ্রের চিন্তাধারার সঙ্গে মার্কসবাদের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য কোথায়? নেতাজী অথনৈতিক আদর্শ হিসাবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী–তা পূর্বেই বলেছি৷ তিনি বলেছেন, ‘‘আজকাল সমাজতন্ত্রের নোতুন চিন্তা ভারতে আসছে পাশ্চাত্য থেকে ও তা অনেকেরই চিন্তাধারায় বিপ্লব আনছে, কিন্তু এদেশে সমাজতন্ত্রের চিন্তা এমন কিছু নোতুন নয়৷ আমাদের এরূপ মনে হয় এই কারণে যে আমরা ইতিহাসের যোগসূত্র হারিয়ে ফেলেছি৷’’ প্রাচীন ঋগ্বেদের বিখ্যাত মন্ত্র ‘‘সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সংবো মনাংসি জানতাম,/ দেবাভাগং যথা পূর্বে সংজানানা উপাসতে৷...’’ এর মধ্যেও তো পাই পূর্ণ সমাজতন্ত্রেরই চিন্তাধারা৷ মন্ত্রে বলা হয়েছে–‘‘আমরা সবাই একই সাথে চলব, একই ধরণের মনের ভাব প্রকাশ করব, আমাদের মন এক হোক, পুরাকালে দেবতারা যেমন যজ্ঞের হবি সমান ভাবে ভাগ করে খেতেন, আমরাও তেমনি বিশ্বের সমস্ত সম্পদ সমভাবে বণ্ঢন করে গ্রহণ করব৷...’         

এরপর আগামী সংখ্যায়