নিন্দাবাদের বৃন্দাবনে বাঙালী

লেখক
একর্ষি

ছ) শৈব ভাবাদর্শগত দিক থেকে বাঙলা কর্ম্ম সংস্কৃতির দেশ৷ ‘কর্ম’ বিষয়ে কী উচ্চ ধারণা, কী অপরিসীম শ্রদ্ধা--- ‘কর্মই ব্রহ্ম’! এখনকার ডাক্তার, মাষ্টার, কেরানি, দোকানি, পূর্ত্তবিদ, উকিল ইত্যাদি পেশার মত পেশা ভিত্তিক নবশাখ সম্প্রদায় সৃষ্টির আগেই কয়েক হাজার বছর ধরেই তার ধারা  বজায় ছিল৷ জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার তাগিদেই বাঙালীর আদি পেশা ছিল--- চাষ করা, তাঁতবোনা ও মাছ ধরা৷ কাজেই সেখানে কর্মে অনীহা ঘৃণা, বা ছোট বড় ভাবার কোন জায়গা ছিল না৷ জাত-পাতের বালাই ছিল না৷ অথচ সেই বাঙলায় কালচক্রে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নানা কারণে যেমন ভোটের রাজনীতি, কর্মনাশা শ্রমিক আন্দোলন (মানে---রাজনীতি করলে বা ট্রেড-ইউনিয়ন করলে, একবার  নেতা হতে পারলে আর কাজ করতে হবে না কেউ কিচ্ছু করতেও বা বলতেও পারবে না, তার ওপর আছে ‘কে আমি জানিস? আমি দাদার লোক!) সঙ্গে বিকৃত ধর্মমতের কর্ম সম্পর্কে মনোভাব, ছোট-কাজ-বড়-কাজ, কী ধরণের কাজ সেই বিচারে মানুষের মূল্যায়ণ ও শঙ্করাচার্যের ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উঁচু-নীচু ভেদাভেদের আবহ তথাকথিত সাক্ষর শিক্ষিত মানুষের মনে কর্মের প্রতি অনীহা ও ঘৃণার মনোভাব তৈরী করেছে৷ তাহলে ভাবুন, বাঙালী চরিত্রে যে বদনামের বোঝা চেপেছে তাতে জনগোষ্ঠীগতভাবে বাঙালী কতটা দায়ী? পরিবেশের নঞর্থক প্রভাব (পূর্বাদ্র তত্ত্ব) কিছুটা থাকলেও এ সবই সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তির গভীর ষড়যন্ত্রের সুদূর প্রসারী ফল নয় কী?

জ) মোটামুটি সবারই জানা, নৃতত্ত্ববিদদের অভিমত---বাঙালী একটা মিশ্র জনগোষ্ঠী৷ অষ্ট্রিকো -নিগ্রোয়েড-দ্রাবিড়য়েড-মঙ্গলয়েড-আর্য রক্তছাপের শঙ্কর জাতি৷ তাই উত্তরাধিকার সূত্রে জীনগতভাবে বাঙালী নিগ্রো ও অষ্ট্রিকদের মিশ্রণে সৃষ্ট দ্রাবিড়দের কাছ থেকে পেয়েছে বুদ্ধিমত্ত ও আধ্যাত্মিকতা, মঙ্গোলীয়দের কাছ থেকে  পেয়েছে ‘ভাবপ্রবণতা’, আর্যদের কাছ থেকে নিয়েছে গৌরবর্ণ, জাঁকজমকপূর্ণ জীবন আর কর্মপটুতা৷ সেইসঙ্গে বাঙলার প্রকৃতিও বাঙালীকে দিয়েছে শান্তস্বভাব-অন্তর্মুখিতা-ভাবপ্রবণতা, চিন্তাশীলতা - বিচারশীলতা - উদারতা-অতিথি পরায়ণতা ও দুর্জয় রণজয়ী প্রতিস্পর্দ্ধী শক্তি৷ এদের নিয়েই (এগুলির সহাবস্থানে-সঙ্করায়ণে) বাঙালী চরিত্রে লগ্ণ হয়েছে আবেগপ্রবণতা, যুক্তিশীলতা, স্বাধীনচেতা মনোভাব ও নোতুনকে বরণ করে নেওয়ার মানসিকতা৷ এতেই তৈরী হয়েছে বাঙ্গালীর স্বভাবধর্ম তথা  প্রাণধর্ম৷ অভ্যাস, চেষ্টা বা ইচ্ছা শক্তি দিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিকে অনুকূলে আনা যায়, কিন্তু স্বভাব বা প্রাণধর্ম পালটানো যায় না৷ তবে সাময়িকভাবে দমন অবদমন-প্রদমণে-উৎপীড়নে তাকে আড়াল করা বা ভুলিয়ে রাখা যায় বটে, কিন্তু মাটির নীচের ঘুমন্ত বীজের মতই উপযুক্ত জল হাওয়ায় অঙ্কুরোদগমের মতই একদিন তা বেরিয়ে পড়ে৷ বাঙালী চরিত্রে কালি ছেটানোর আগে বাঙালীর স্বভাবধর্মের তথা প্রাণধর্মের কথা ভুললে চলবে কেন? গ্রাম বাঙলায় তো একটা প্রবাদই আছে---স্বভাব যায় না মোলে...৷’ বস্তুতঃ সচরাচর কোন জীবই তার স্বভাবধর্ম ত্যাগ করে না, ব্যতিক্রমী ব্যবহার দেখলে বুঝতে হবে সেটা তাৎক্ষণিক কোন ক্রিয়ার প্রতিবর্ত ক্রিয়া মাত্র, স্বভাবজাত নয়৷

ঝ) আর একটা কথা না বলেই নয়৷ বিতর্কিত চাঞ্চল্যকর বা অস্বাভাবিক কোন ঘটনা বা সংবাদ হঠাৎ চাউড় হলে অনেক সময় অমূলক বা মিথ্যা হবার সম্ভাবনা থাকে৷ তাই ভুল তথ্য বা মিথ্যে সংবাদ পরিবেশনের দায় এড়াবার জন্য আগেই প্রতিবেদকগণ সাফাই গেয়ে রাখেন যে ‘অমুক সংবাদ মাধ্যম তথ্যের, ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই করেনি৷ সেই রকম বাঙালী চরিত্রের দুর্বল-নেতিাবাচক দিকগুলো ফলাও করে জাহির করার সময়ও সেগুলো কতটা সত্য বা যথার্থ, জীনগত বা কোন ভৌমপরিবেশ কিংবা দূরনিয়ন্ত্রিত সুপরিকল্পিত কার্যকারণ সম্পর্কের অনিবার্য প্রতিফল তা সমালোচক, প্রতিবেদক, ঐতিহাসিক-কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী পণ্ডিত কেউই প্রকৃত ব্যাপারটা যাচাই করেন না বা ন্যাজ উল্টে দেখেন না৷ মহারাজ মহানুভাব! যেমন দেখা শুনা তেমন বলা-লেখা! যা কিছু রটে তা কিছু বটে---এই প্রবাদবাক্য  তাঁদের কাছে আপ্তবাক্য৷ ভিতরের সত্যটা প্রকাশ করে বাঙালীকে কলঙ্ক মুক্ত করার বাঙালীকে ওই দুর্বল-নেতিবাচক চরিত্রের অবগুণ থেকে মুক্ত করার কোন পথও বাতলান না তাঁরা৷ নিন্দাবাদের বৃন্দাবনে বাঙালীর-কলঙ্ককীর্ত্তন করে তাঁরা আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন৷ ব্যাপারটা কেমন না এক রোগী এল ডাক্তারের কাছে রক্তপরীক্ষার ‘হাই সুগার’-এর (পি.পি. ও ফাষ্টিং উভয়েরই) রিপোর্ট নিয়ে৷ বলল---ডাক্তার বাবু, আমার তো কোন দিন সুগার টুগার ছিল না, একি হল? ডাক্তার বাবু বললেন--- দাঁড়ান,--- রক্তের এই পরীক্ষাটা করে আনুন৷ রিপোর্ট এলো ডাক্তার বাবু দেখে বললেন--- রাত দিন টেনশন্‌ করেন, রাতের পর রাত ঘুম হয় না? উত্তরে রোগী বলল--- ঠিক ধরেছেন ডাক্তারবাবু, কতগুলো পারিবারিক সমস্যা নিয়ে ইদানিং খুবই টেন্‌শনে আছি, রাতের পর রাত ঘুম আসে না, জেগে বসে থাকি....৷ ডাক্তারবাবু বললেন....না আপনার সুগারের অতীত ইতিহাস নেই, এইসব কারণে হঠাৎ-ই হয়েছে৷ এইরকম বাঙালী চরিত্র-দোষের রিপোর্টটাও সেইরকম বাঙালীর ‘জাতিসত্তা’র উন্মেষের শুরু থেকেই বিচার করা দরকার ছিল৷ কিন্তু কেউই তা করেননি৷ জোয়ার-ভাটা জাড্যত্ব-গতিশীলতা সব ক্ষেত্রেই আসে৷ ছন্দময় বাঙালীজীবনেও তার ব্যাতিক্রম নয়৷ কিন্তু মনুষ্য সৃষ্ট ভাটার দুঃসময়ে সাচ্চা নিরপেক্ষ স্পষ্টবাদী সাজার এমন মওকা ঘরে বাইরের বাঙালী বিদ্বেষীদের কেউই হাতছাড়া করেননি৷ একেবারে সোজা সপাটে ব্যাট চালিয়ে দিয়েছেন, যত দোষ ওই নন্দঘোষ বাঙালীর৷ বাঙালীর দুঃসময়ের বিপর্যস্ত অবস্থাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মূলধন করা হয়েছে৷ (ক্রমশঃ)