নিন্দাবাদের বৃন্দাবনে বাঙালী

লেখক
একর্ষি

(পূর্বপ্রকাশিতের পর)

(১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক গবেষক, অধ্যাপক বাঙালী চরিত্রের কতগুলো দোষের কথা যেমন বলেছেন পাশাপাশি তার কারণও অনুসন্ধান করেছেন৷

(২) বাঙালী-চরিত্র সম্বন্ধে বিদেশীদের ধারণা কখনও ভাল ছিল না৷ মিথ্যা কথন, ভীরুতা,মামলা-প্রিয়তা, প্রবঞ্চনা প্রভৃতি বাঙালী চরিত্রে ছিল সুলভ৷

(৩) বাঙালী ভোগলিপ্সু কিন্তু কর্মকুন্ঠ৷ এর কারণ হিসাবে তিনি দেখিছেন---বৈরাগ্য-প্রবণ জৈন-বৌদ্ধ -বৈষ্ণব মতবাদ বাঙালী চিত্তে কর্মকুন্ঠা....প্রবল করেছে৷ এমন মানুষ ভিক্ষাবৃত্তি বা চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করে৷ ‘‘এই প্রসঙ্গে আরো বলেছেন৷

সুবিধাবাদ ও সুযোগসন্ধান, তোয়াজ ও তদবির প্রবণতা প্রভৃতির প্রাবল্য ও আত্মসম্মান বোধের অভাব, অন্যদিকে জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে যে দেবানুগ্রহজীবিতা রয়েছে তা ওই কর্মকুন্ঠারই প্রসূন৷’’

৪) বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য যুগে  আমরা বাঙালীকে কেবল তুক-তাক,দারু-উচাটন, ঝাড়-ফুক, বাণ-মারণ, বশীকরণ, কবচ-মাদুলী, হঠযোগতন্ত্র ও  ডাকিনী-যোগিনী নির্ভর দেখতে পাই৷

এ সবের কারণ খুঁজতে গিয়ে গবেষক যথার্থই বলছেন--- বিদেশী শাসন-শোষণের ফলে স্বাধীনভাবে আত্মবিকাশের সুযোগ মেলেনি বলেই হয়তো বঞ্চিত দরিদ্রের জীবনে আধ্যাত্মিক শক্তি লাভের প্রয়োজন, দৈবশক্তির সাহায্যে অলৌকিক উপায়ে বাঞ্ছা সিদ্ধির ও প্রয়োজন পূর্তির  এই আগ্রহ ও বাঁচার তাগিদেই অনন্যোপায় হয়ে মানুষের ভিক্ষাবৃত্তি, মিথ্যার আশ্রয় ও প্রতারণার  পথ বরণ আবশ্যিক হয়েছিল৷‘‘এই প্রসঙ্গে তিনি প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দৃষ্টিভঙ্গীরও পার্থক্য দেখিয়েছেন--- প্রতীচ্য মানুষ আত্মপ্রত্যয় নিয়ে বাঞ্ছাসিদ্ধির ও জীবনের নিরাপত্তার বাস্তব উপায় বের করেছে৷ আর প্রত্যয়হীন প্রাচ্য মানুষ অলৌকিক উপায়ে বাঞ্ছা সিদ্ধির ও জীবনের নিরাপত্তা উপায় সন্ধানী৷  আজ উদ্যমশীলতা ও আত্মপ্রত্যয় প্রতীচ্যের সম্পদ আর উদ্যমহীনতা ও দৈব নির্ভরতায় প্রাচ্য-মানবের পরিচয়৷’’ এই পার্থক্যের মুলে প্রতীচ্য মানুষের শোণা কথায় সন্দেহ ও অনাস্থা ও কৌতুহল, জিজ্ঞাসা, আত্মবিশ্বাস, উদ্যম ও অবিরাম প্রয়াস৷ আর প্রাচ্য মানুষের প্রয়াসহীন প্রাপ্তিলিপ্সা, আজন্ম লালিত বিশ্বাস-সংস্কারে নিষ্ঠা, প্রশ্ণহীন প্রত্যয় ও আত্মসামর্থে অনাস্থা৷ জিজ্ঞাসা ও আকাঙ্ক্ষার, প্রত্যয়ের ও উদ্যমের মেলবন্ধন না হলে জীবনে ও জীবিকায়, মনে ও মননে যে জীর্ণতা আসে.... তার সাক্ষ্য আজো আফ্রো-এশিয়ার  অনুন্নত ও আরণ্য সমাজ৷ ---কথাগুলো নির্মম সত্যকথা৷ কিন্তু বিজাতীয় জীবনধর্ম ও বিদেশী-পরদেশী শাসক-সমাজপতিদের শাসন-সংস্কৃতির বশীকার-বিকারে জীবনযুদ্ধে প্রবল ভাটার আবহে বাঙলা ও বাঙালী তথা প্রাচ্য যখন ছন্নছাড়া- হতোদ্যম - অবসন্ন-দিশাহীন, অন্যদিকে প্রতীচ্য তখন নবজাগরণের নবযৌবনের জোয়ারে দুরন্ত দুর্বার৷ এটা তো মাণতে হবে! এখন বাংলা ও বাঙালীর জীবনে একটা রেনেশাঁ দরকার যা বাঙালী জীবনের দশদিক একুল সবকুল সুনামির জোয়ারে  ভাসিয়ে নিয়ে যাবে৷

বিশ্বকবিও কাব্যের ললিত-খন্ডে বাঙালী চরিত্রের অবগুণের ওপর আঘাত করে বাঙালী জাতিসত্তার সম্বিত ফেরাতে চেয়েছেন৷ বঙ্গমাতাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন যে  বঙ্গসন্তানকে ---

‘‘তব গৃহ কোড়ে/চির শিশু করে রাখিয়ো না ধরে’’

পদপদে  ছোট ছোট নিষেধের ডোরে / বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালছেলে করে৷’’

‘‘রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করোনি৷’’ দোষটা কী

কবি বললেন ---

অন্নপায়ী বঙ্গবাসী/স্তন্যপায়ী জীব

অদৃষ্টের বন্ধনেতে / দাপিয়া বৃথা রোষে৷

অলস দেহ ক্লিষ্টগতি/ গৃহের প্রতি টান

অত্যাচারে মত্তপারা /কভু কি হও আত্মহারা?

দাস্য সুখে হাস্য মুখে / বিনীত জোড় কর৷’’ (ক্রমশঃ)