নূ্যনতম প্রয়োজন ও সর্বাধিক সুখ–সুবিধা

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

আমাদের এই সমাজের অসংখ্য আকর্ষণ, আর সেই আকর্ষণে আকর্ষিত হওয়াই মানুষের স্বভাব৷ মানুষের এই স্বভাবকে প্রশ্রয় দিয়ে কম্যুনিজম সবাইকে সমান সম্পদ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷ কিন্তু এই বিশ্বের জাগতিক সম্পদ সীমিত৷ তাই সকলকে কি সম পরিমাণ সম্পদ দেওয়া সম্ভব? সম্ভব নয়৷ আর শুধু তাই নয়, সেই প্রচেষ্টাও আপাতদৃষ্টিতে মনোরঞ্জক এক ভণ্ডামি৷ এখন কম্যুনিজম মৃত্যুশয্যায়৷ কম্যুনিজম ছিল এক ‘ইজম্’ (মতবাদ)–বাগাড়ম্বরপূর্ণ ভাষার ফুলঝুরি৷

সকলকে সম পরিমাণ সম্পদ দেওয়ার পরিবর্ত্তে সকলের জীবন যাপনের নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্ত্তির নিশ্চিততা প্রদানই সঠিক পদক্ষেপ৷ সাধারণ মানুষের আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নূ্যনতম প্রয়োজনের ব্যাসার্দ্ধও বেড়ে যাবে৷

অধিকতর স্বচ্ছল ও সাধারণ মানুষের মাঝের ব্যবধান ঘোচাতে নূ্যনতম প্রয়োজনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে৷ বিশেষ গুণসম্পন্ন বা প্রতিভাসম্পন্নগণ সমাজের সেবা যাতে আরও ভালভাবে করতে পারেন, সেই সুযোগ করে দিতেই তাঁদের সর্বাধিক সুখ–সুবিধার ব্যবস্থা করে দিতে হবে৷ এই কাজটা করার উদ্দেশ্যেই কিছুটা সম্পদ গুণীদের জন্যে আলাদাভাবে বরাদ্দ করে রাখতে হবে৷ কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে যে, গুণীদের এই সর্বাধিক সুখ–সুবিধার ব্যবস্থা করে দেওয়াটা যেন সাধারণের স্বার্থের পরিপন্থী না হয়৷ প্রতিভাবানদের সর্বাধিক সুখ–সুবিধার ব্যবস্থা করে দেওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষও যাতে সর্বাধিক সুখ–সুবিধা পায় তার ব্যবস্থাও করতে হবে৷

বিশেষ গুণসম্পন্নগণ সাধারণের থেকে বেশী আয় করবেন, আর এই আয়ের মধ্যেই থাকবে তাঁদের সর্বাধিক সুখ–সুবিধার ব্যবস্থা৷ কিন্তু সাধারণ মানুষকেও সর্বাধিক সুখ–সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হবে না৷ তারাও যাতে সর্বাধিক সুখ–সুবিধা পায় সেই প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে৷ তবুও বিশেষ গুণসম্পন্নদের সর্বাধিক সুখ–সুবিধা, আর জনসাধারণের সর্বাধিক সুখ–সুবিধার মধ্যের ফারাকটা থেকেই যাবে৷ কিন্তু এই ফারাকটা কমিয়ে আনার অন্তহীন প্রয়াস চালিয়েই যেতে হবে৷

কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক্৷ মনে কর, স্কুলের ছাত্ররা নূ্যনতম প্রয়োজন পেয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও যদি স্কুলে তাদের জলখাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, সেটা তাদের নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্ত্তির পর অতিরিক্ত সুখ–সুবিধা হিসেবে গণ্য হবে৷ আবার, সমস্ত  যাত্রীদের যদি বিনামূল্যে চা বা কফি দেওয়ার ব্যবস্থা হয়, তাহলে তাও সুখ–সুবিধা বলেই গণ্য হবে৷

সাধারণ মানুষকে যদি সর্বাধিক সুযোগ–সুবিধা না দেওয়া হয়, তাহলেও সমাজ এগিয়ে যাবে, কিন্তু ভবিষ্যতে পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা সবসময়েই থেকে যাবে৷ এই নূ্যনতম প্রয়োজন ও সর্বাধিক সুযোগ–সুবিধার পরিমাণ সব সময়েই বাড়তে থাকবে৷ এই বিষয়টি প্রাউটের নব–সংযোজন৷

গুণীদের সর্বাধিক সুযোগ–সুবিধা যদি খুব বেড়ে যায় তাহলে সাধারণ মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজনগুলিও সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়ে দিতে হবে৷ উদাহরণস্বরূপ বিশেষ গুণসম্পন্নদের যদি মোটর বাইক থাকে আর সাধারণ মানুষের যদি সাইকেল থাকে, তাহলে সেই অবস্থাকে সন্তুলিত অবস্থা বলা যেতে পারে৷ কিন্তু বিশেষ গুণসম্পন্নগণ যদি মোটরগাড়ি পাবার অধিকারী হন তাহলে সাধারণ মানুষকে অনতিবিলম্বে মোটর সাইকেল পাবার ব্যবস্থা করতে হবে৷ প্রবাদ বাক্য আছে ঃ ‘সাধারণ জীবনযাপন আর অসাধারণ চিন্তন’৷ কিন্তু সাধারণ জীবনযাপন বলতে কী বোঝায়? ৮০ বছর আগের সাধারণ জীবনযাপন আর এখনকার সাধারণ জীবনযাপন এক নয়৷ যুগে যুগে তার পরিবর্ত্তন হয়৷ তাই যুগে যুগে নূ্যনতম প্রয়োজন ও সর্বাধিক সুযোগ–সুবিধা–দু’টোই পরিবর্ত্তিত হবে, আর দু’টোই ক্রমবর্দ্ধমান হবে৷ তা যদি না হয় তাহলে সমাজের অর্থনৈতিক উন্নতি হবে না৷

সেজন্যে যুগের সর্বনিম্ন প্রয়োজন পূর্ত্তির ব্যবস্থা সকলের জন্যে করা, ও গুণসম্পন্নদের কর্মের সামাজিক মূল্য অনুযায়ী সর্বাধিক সুযোগ–সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা করার সঙ্গে সাধারণ মানুষকেও যুগানুযায়ী সর্বাধিক সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা করাই আমাদের কর্ত্তব্য৷ প্রত্যেক যুগেই নূ্যনতম চাহিদা ও সর্বাধিক সুযোগ–সুবিধা প্রদানের আর্থিক মূল্য নির্দ্ধারণ করতে হবে, ও পরবর্ত্তী যুগে তা পুননির্দ্ধারণ করতে হবে – এই ভাবে চলতেই থাকবে৷ এই পদ্ধতিতে মানুষের জীবনযাপনের মানকে ক্রমশঃই বাড়িয়ে যেতে হবে৷

জীবনের সুখ–সুবিধা

জীবনের সুখ–সুবিধা বলতে সেগুলিকেই বোঝায় যেগুলি মানুষের জীবনযাপনকে সহজ করে৷ ‘প্পনুন্ব্ধম্ভ’ (সুখ–সুবিধা) শব্দটি লাতিন ‘প্পন্দ্বুব্ভব্দ’ থেকে উদ্ভূত৷ ইচ্ছার পূর্ত্তি অথবা অবস্থাকে সহজতর করাই এর অর্থ৷ জাগতিক ও মানসিক আশা–আকাঙক্ষা পূর্তির উপাদান সমূহকে বলা হবে সেই যুগের সুখ–সুবিধা৷ সাধারণ মানুষকে সেই সুখ–সুবিধা সর্বাধিক দেবার ব্যবস্থা করতে হবে৷ যেমন, আগেকার দিনে পানীয় জলের জন্যে লোকে কুঁয়ো খুঁড়তো, ও সেখান থেকে জল নিয়ে ঘরে যেত৷ কিন্তু পরবর্তীকালে জলাধার তৈরী করে নলের মাধ্যমে ঘরে ঘরে জল সরবরাহ করা